Advertisement
০৭ মে ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

বাস্তব সত্যের অন্য দিক আঁকতে চান

এই প্রথম শক্তি বর্মনের চিত্রকলা নিয়ে একই গ্রন্থে লিখেছেন দুজন কলাবেত্তা: ইতালির রোজা মারিয়া ফ্যালবো ও ভারতীয় শিল্পবেত্তা বি এন গোস্বামী। বইটি সম্পাদনা করেছেন মারিয়া ফ্যালবো।

শক্তি বর্মন: আ প্রাইভেট ইউনিভার্স, সম্পা: রোজা মারিয়া ফ্যালবো। স্কিরা, মিলান ও আর্ট অ্যালাইভ গ্যালারি, নয়াদিল্লি, মূল্য অনুল্লেখিত

শক্তি বর্মন: আ প্রাইভেট ইউনিভার্স, সম্পা: রোজা মারিয়া ফ্যালবো। স্কিরা, মিলান ও আর্ট অ্যালাইভ গ্যালারি, নয়াদিল্লি, মূল্য অনুল্লেখিত

মনসিজ মজুমদার
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

শক্তি বর্মনের চিত্রকলা সম্বন্ধে গত দশ-এগারো বছরে অনেকগুলি বই প্রকাশিত হয়েছে। একটি কি দুটি ছাড়া সব বই-ই তাঁর প্রদর্শনীর ক্যাটালগের রাজকীয় সংস্করণ। মূলত তাঁর ছবির অ্যালবাম, সঙ্গে একটি মনোজ্ঞ প্রবন্ধ, যাতে সুঠাম আলোচনা থাকে শিল্পীর প্যারিস-নিবাসের প্রেক্ষিত, তাঁর চিত্রকলায় পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য বিষয়ের সমন্বিত রূপ এবং প্রদর্শিত ছবি নিয়ে বিশ্লেষণ ও মন্তব্য। আলোচ্য বইটি ব্যতিক্রম নয়, আবার ব্যতিক্রমও বটে।

এই প্রথম শক্তি বর্মনের চিত্রকলা নিয়ে একই গ্রন্থে লিখেছেন দুজন কলাবেত্তা: ইতালির রোজা মারিয়া ফ্যালবো ও ভারতীয় শিল্পবেত্তা বি এন গোস্বামী। বইটি সম্পাদনা করেছেন মারিয়া ফ্যালবো। কিন্তু তাঁর বা ডঃ গোস্বামী সম্পর্কে বইটির কোথাও কোনও পরিচিতি নেই। ডঃ গোস্বামী ভারতের কলা-গবেষণা জগতে বহুখ্যাত নাম, মিনিয়েচার চিত্র নিয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য ও বৈদগ্ধ্যের খ্যাতি আন্তর্জাতিক। দিল্লির একটি গ্যালারি, যারা এই বইটির যুগ্ম-প্রকাশক, জানালেন ইতালীয় কলা-লেখিকা মারিয়া ফ্যালবো সুইজারল্যান্ডের পৃথিবী-বিখ্যাত চারুকলার পুস্তক প্রকাশনা সংস্থা স্কিরা-র সঙ্গে যুক্ত। এখন অবশ্য ওই সংস্থার মালিক বার্লোস্কুনি এবং ঠিকানা ইতালির মিলান, যেখানে এই বই মুদ্রিত হয়েছে। ফ্যালবো দিল্লির কলামেলায় প্রথম শক্তি বর্মনের ছবি দেখেন, পরে প্যারিসে শিল্পীর সঙ্গে আলাপ করেন এবং একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন, যা এই বইয়ের সবচেয়ে মূল্যবান সংযোজন।

শক্তি প্যারিসে আছেন ১৯৫৬ থেকে। পশ্চিমি শিল্পকলার আধুনিকতাবাদী বিবর্তন তখন সম্পূর্ণ হয়ে প্রায় অস্তমান। যদিও মাতিস পিকাসোর মতো শিল্পীরা তখনও জীবিত ও সৃষ্টিশীল। অন্য অনেক পশ্চিম-নিবাসী ভারতীয় শিল্পী তখন আধুনিকতাবাদের শেষতম অবদান বিমূর্ত শৈলীর চর্চা করছেন। শক্তি কিন্তু অবয়বী ছবি আঁকাতেই মন দিলেন। কিন্তু এই পথ ছিল দুর্গম, অবয়বী বা মূর্ত চিত্রচর্চায় মৌলিক কিছু করার সুযোগ ছিল না, তেমনই সুসাধ্য ছিল না আশৈশব-লালিত কুড়ি-বাইশ বছরের ভারতীয় সংবেদনাকে পুঁজি করে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফরাসি নিসর্গ বা জীবনদৃশ্য আঁকা।

মারিয়া ফ্যালবো এই প্রসঙ্গ তোলেননি, কিন্তু বিশ্লেষণ করেছেন কেমন করে শক্তি এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। শক্তি ছবি এঁকেছেন দুই সংস্কৃতি, দুই নান্দনিক সংবেদনা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই কলা-ঐতিহ্যের সহজ মিলন ঘটিয়ে, যেমন সেই সময়ে ভারতে আধুনিকতাবাদীরা পশ্চিমি অভিব্যক্তিবাদের সঙ্গে তান্ত্রিক আধ্যাত্মিকতা মিলিয়েছেন একই ক্যানভাসে।

ফ্যালবোর মতে, হিন্দু ও ইউরোপীয় পুরাণের গল্প ও চরিত্র নিয়ে শিল্পী এক গভীর অন্তঃশীল জগৎকে রূপায়িত করেছেন, যা মূর্ত হলেও প্রতীকী এবং একান্ত ব্যক্তিগত। ছবির বিষয়ের উৎস স্বপ্ন ও স্মৃতি, যা মুছে ফেলে তাকেই তিনি নতুন করে রচনা করেন, আরোপিত করেন নতুন ভাবনায় সঞ্জীবিত পুরাণের গল্প। শক্তির ছবিতে ফ্যালবো দেখেছেন গভীর আশাবাদী মানবিক বোধের নান্দনিক উল্লাস, যা শিল্পী দর্শকমনে সংক্রামিত করতে চান, যা বাইরের নিষ্ঠুর জীবনবাস্তবতা থেকে দূরে নিয়ে যায় তাকে। কোনও পলায়নী প্রবণতা নয়, কারণ কোনও এক স্তরে আর্ট মাত্রেই হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনওখানে উত্তরণের প্রয়াস।

ফ্যালবোর চিন্তার এক দার্শনিক গভীরতা আছে, কিন্তু ভাষায় কোনও অস্বচ্ছতা নেই। তিনি শক্তির চিত্রকলাকে দেখার চেষ্টা করেছেন ভারতীয় ও ইউরোপীয় দুই দৃষ্টিকোণ থেকে। শক্তির কলাচর্চায় রোম্যান্টিকদের মতো অসীমের জন্য আকুতি খুঁজে পেয়েছেন, আবার রবীন্দ্রনাথের মতো দুর্মরতম আশাবাদের হদিশ পেয়েছেন। কোনও কোনও ছবি দেখে মনে পড়েছে ইয়েটসের কবিতা, এমার্সনের ‘উই আর নেভার ওল্ড’ বা মোৎসার্টের ‘দ্য ম্যাজিক ফ্ল্যুট’। কখনও ‘মহাভারত’ থেকে ‘গীতা’র সেই শ্লোক— ‘বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়’— গদ্যানুবাদে উদ্ধার করেছেন, কিন্তু শক্তির ছবির শৈলী, রূপাবয়বের বিশ্লেষণে তত মনোযোগ দেননি বা সমকালীন কলাপ্রেক্ষিতে শক্তির চিত্রকলার স্থান কী, সেই প্রসঙ্গ তোলেননি।

এই বইয়ের অপর প্রবন্ধ ‘মিক্সিং মিথ উইথ ডিজায়ার’— শক্তি বর্মন সম্বন্ধে বি এন গোস্বামীর রচনা। এর আগে তিনি শক্তির একটি প্রদর্শনীর ক্যাটালগের জন্য লিখেছিলেন ‘দ্য ওয়ান্ডার অব ইট অল’। ভিন্ন নাম হলেও দু’টি প্রবন্ধেই তিনি বলেছেন শক্তির ছবির অভিঘাত চমৎকারিত্ব বা বিস্ময়। এই বিস্ময়বোধ জাগানো ভারতীয় শিল্পকলায় নতুন নয়, বরং নান্দনিক আনন্দবোধের নানা লক্ষণের অন্যতম। লেখক পনেরো শতকের একটি ব্রোঞ্জ শিল্পকৃতির উদাহরণ দিয়েছেন। যদিও কাজটার নাম জীবন ও জ্ঞানবৃক্ষ তাতে এমন সব আপাত অপ্রাসঙ্গিক মোটিফের সমাবেশ আছে, যাতে বিস্মিতমুগ্ধ দর্শকমনে নানা প্রশ্ন জাগে, যার কোনও উত্তর নেই বা দর্শককেই যার উত্তর জোগাতে হয়। উত্তর না মেলা সত্ত্বেও দর্শক যে বিস্ময়ানন্দে আপ্লুত হন, তাতেই শিল্পের সার্থকতা। শক্তির নানা ছবি থেকে খুঁটিনাটি বর্ণনা-বিশ্লেষণ করে লেখক দেখিয়েছেন, সে-সবে আনন্দবিস্ময়ের উৎস চিত্রপটে নানা দেব-দেবী, মানব-মানবী, ইতিহাস আর শিল্পকলার নায়ক-নায়িকা, পশুপাখি এবং পুরাণকল্প বা সম্পূর্ণ অকল্পনীয় জীবজন্তুর পরস্পর অন্বয়হীন বহু বিচিত্র সমাবেশ। দেশ-কাল-সময়ের ব্যবধান, ধর্ম ও সংস্কৃতির ভিন্নতা এবং বাস্তব ও কল্পনার বৈরিতায় বৈচিত্রময় সে-সব মোটিফ দর্শককে আকৃষ্ট করে, কারণ অন্বয়হীনতার গভীরে থাকে কোনও গূঢ় অন্বয়ের ব্যঞ্জনা। কখনও শিল্পীকেও দেখা যায় এই সমাবেশে, তখন লেখকের মনে পড়ে গালিবের শায়ের: ‘দরবেশ বেশে, প্রতিদিন আমি নিশ্চুপে দেখি এই মহাজীবনের চলমান তামাসা।’ বা সারা জীবন যাদের বা যা দেখেছেন শিল্পী বাস্তবে ও কল্পনায়, সে-সব তুলে এনে ছবিতে একঠাঁই করেছেন স্বপ্ন ও স্মৃতির সূত্রে গেঁথে, স্থান-কালের সীমানা উপেক্ষা করে। এবং আমাদের কাজ যুক্তি-বুদ্ধিজাত জ্ঞান ও তত্ত্বের সংস্কারমুক্ত মনে খোলা চোখে এই ছবি দেখা।

শক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মারিয়া ফ্যালবো ছোট-বড় চব্বিশটি প্রশ্ন করেছিলেন এবং অধিকাংশ প্রশ্নই গভীর অনুসন্ধানী, কখনও দার্শনিক। উত্তরে শিল্পী তাঁর কলাদর্শ ও জীবনবোধ সম্পর্কে অনেক মননঋদ্ধ কথা বলেছেন। একটি খুব জরুরি প্রশ্ন ছিল। তাঁর ছবির জগতে স্বপ্ন ও স্বর্গের সুষমা। বাস্তব জীবনে এত হিংসা-হানাহানি শিল্পী কী চোখে দেখেন? শক্তি বলেছেন, তিনি আঁকতে চান বাস্তব সত্যের অন্য দিক। তাঁর মতে, প্রেম ও অহিংসা জীবন-জগতে মিথ্যে হয়ে যায়নি। যে খুন করে, সেও ভালবাসে। গ্রিক পুরাণের প্যান্ডোরার উল্লেখ করে বলেন, শত অমঙ্গলেও আশা নির্মূল হয়নি, এই আশাই তাঁর ছবির বিষয়। হিংসা আছে তাঁর ছবিতে, তবে তা প্রতীকী। শক্তি শিল্পীসুলভ উত্তর দিয়েছেন। আরও যে-সব দার্শনিক প্রসঙ্গ এই সংলাপে উঠে এসেছে, যেমন— শিল্পীর কোনও নৈতিক অবস্থান বা জীবনদর্শন আছে কি না, শিল্পীর কাছে জীবনের অর্থ কী, জীবনের অনিশ্চয়তা বা জন্ম, মৃত্যু ও বয়স বাড়ার কঠিন নিশ্চয়তা সম্পর্কে তাঁর মনোভাব কী। তাঁর ছবিতে স্বপ্নসুলভ চিত্রকল্প কি ফ্রয়েডীয় ইচ্ছাপূরণ, না কি জীবনসমস্যা থেকে পরিত্রাণের প্রয়াস? এই সব প্রশ্ন শক্তিকে অতি-প্রয়োজনীয় আত্মজিজ্ঞাসার সুযোগ দিয়েছে। সব পাঠকই এই অনবদ্য সংলাপ পড়ে এমনই আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হবেন, যদিও সব প্রশ্ন সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE