Advertisement
০৫ মে ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

ইতিকথার সূত্রে ইসলামের লোকায়ন

গা জি মিয়াঁর বস্তানি’টা খুলে একটু চিন্তা করে পড়তে পারলে দুনিয়া জাহানের রকমারি চটকদার ভালমন্দ সব কথাই জানা যায়, এই রকম একটি ধারণা উনিশ শতকের শেষে আলোকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী মীর মশাররফ হোসেন বাঙালি সমাজে চারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। হওয়ারই কথা।

কংকোয়েস্ট অ্যান্ড কমিউনিটি/ দি আফটারলাইফ অব ওয়ারিয়র সেন্ট গাজি মিয়াঁ। শাহিদ আমিন। ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ৮৫০.০০

কংকোয়েস্ট অ্যান্ড কমিউনিটি/ দি আফটারলাইফ অব ওয়ারিয়র সেন্ট গাজি মিয়াঁ। শাহিদ আমিন। ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ৮৫০.০০

গৌতম ভদ্র
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

গা জি মিয়াঁর বস্তানি’টা খুলে একটু চিন্তা করে পড়তে পারলে দুনিয়া জাহানের রকমারি চটকদার ভালমন্দ সব কথাই জানা যায়, এই রকম একটি ধারণা উনিশ শতকের শেষে আলোকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী মীর মশাররফ হোসেন বাঙালি সমাজে চারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। হওয়ারই কথা। ‘গাজি’ খেতাবটা ওজনদার, কেবল মুজাহিদ বা ধর্মযোদ্ধারাই পায়। খোদ আল্লার নির্দেশিত পথে ইসলাম ধর্মপ্রচারের জন্যই গাজিদের জীবন নিবেদিত, কোরানে ইমান প্রতিষ্ঠা করতে কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে অকুতোভয়ে শহিদ হওয়াটাই সেই জীবনের প্রাপ্তি। লোকমুখে প্রবাদ আছে, ‘মরে তো শহিদ, মারে তো গাজি’। একাদশ শতকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা আলিম অল্‌-বিরুনি লিখেছেন যে গজনির সুলতান সবুক্‌তিগিন ভারতে ইসলাম ধর্ম প্রচার জীবনের ব্রত বলে স্বীকার করেছিলেন, উপাধিও নেন অল-গাজি। তাঁরই উত্তরসূরি সুলতান মামুদের আমল থেকে নানা ছোটবড় গাজির আনাগোনা এই উপমহাদেশে চলতেই থাকে। সারা দেশের আনাচে কানাচে, গ্রামে বা মহল্লায় আছে এঁদের থান বা আস্তানা, নজরগাহ, কবর বা মাজার; আবার মাজারকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে সাজানো স্মৃতিসৌধ, দরগা বা রওজা। গাজি বেরাদরির সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ সুফি সিলসিলার লোক, কেউ বা দরবারি সেনানী, আবার কেউ কেউ লোকঐতিহ্যের নিছক কল্পনায়ক। নানা এলাকার সাধারণ লোকে নানা বিশিষ্ট নামে নিজেদের গাজিদের চেনে ও মানে। উত্তরপ্রদেশের নামজাদা গাজি মিয়াঁ হলেন ফৈজাবাদের কাছে বহরাইচের সালার মাসুদ, এক দুর্ধর্ষ জেহাদি বীর, সালার মানেই তো প্রধান। বাংলায় ত্রিবেণীর ওয়ালি দরাফ খান গাজি। কাফেরদের শায়েস্তা করে তিনি গঙ্গা মায়ের স্তোত্র লিখেছিলেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো সাবেকি বাঙালি বামুনদের স্তোত্রটি কণ্ঠস্থ ছিল। কানপুরের মাকনপুর থেকে উত্তরবঙ্গের বগুড়া পর্যন্ত আজও মাদার শাহ ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ গাজিদের ডঙ্কা-নিশান ওড়ানো হয়। ভাটি এলাকার ঘুটিয়ারি শরিফের বাঘবাহাদুর মোবারক শাহ গাজির রাজ এখনও অটুট। গত হাজার বছরের ভারতীয় ইসলামের প্রসার, বিবর্তন ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের সামূহিক ইতিবৃত্তে, নানা কিংবদন্তি ও বিক্ষিপ্ত প্রত্নসাক্ষ্যের বুনটে, এ হেন ইসলামি ক্রুসেডার বা জেহাদি বীরদের কুদরতি, কেরামতি এবং নানা অ্যাডভেঞ্চারের কল্পকথা ও ইতিকাহিনি গ্রথিত আছে। সেই বৃত্তান্তগুলি মহম্মদ হাসান কাতিল থেকে হেনরি ইলিয়ট, ইলিয়ট থেকে গারসাঁ দ্য তাসি-র মতো অনুসন্ধিৎসুরা সংকলিত করেছেন, জ্ঞানের ভাণ্ডারে খামতি নেই। কিন্তু আদত কথা হল, গাজিদের ইতিকথা কেবল পাঠ্য নয়, বরং অনেক বেশি দৃশ্য ও শ্রাব্য, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পারফরমেটিভ’। জনপরিসরে নানা অনুষ্ঠানে আগে হামেশাই তাঁরা উঁকিঝুঁকি মারতেন, আজও সময়সুযোগ বুঝলেই হাজির হন। পুথি-কিসসার আসরে, গাজির পটে ও গানে, দরগাতে বাৎসরিক মেলায়, উরস বা গাজির মৃত্যুবার্ষিকীতে বার হওয়া নানা ঝান্ডা-মিছিলে, কাওয়ালদের গলায়, দফালি বা ঢোলকিয়াদের বাজনায়, কোনও না কোনও গাজির স্মৃতি উদ্‌যাপিত হয়। এই বছরেও তো জ্যৈষ্ঠ মাসে কাঠফাটা রোদে বহরাইচের পথে গাজি সালার মাসুদের জিয়ারতে বেরিয়েছিলেন হাজারো মোমিন ও ভগৎ, স্মৃতি উদ্‌যাপনের ওই মিছিলে দফালিরা যথারীতি সঙ্গত দিয়েছিল মিছিলের জিগিরকে, ‘চলে গাজি কি নগরিয়া, অপনি জিন্দগি বনানে, শুয়ি কিসমত জাগানে, জি কি বিপত্তা (দুঃখ) শুনানে, চলে গাজি কি নগরিয়া।’ একেবারে যেন ‘ভোলাবাবা পার করেগা’-র মতো জিগিরের রাজসংস্করণ।

ভারতীয় গাজিদের কুরসিনামায় সালার মাসুদ আদি শহিদ, বংশমর্যাদায় নৈকষ্য কুলীন, খোদ সুলতান মামুদের ভাগ্নে। একাদশ শতকেই অযোধ্যা ও উত্তরপ্রদেশের দোয়াব অঞ্চলে বিজয়নিশান উড়িয়ে কাফেরদের হাতে একটি যুদ্ধে প্রাণ হারিয়ে তিনি জিন্নতবাসী হন। অবশ্য সমসাময়িক কোনও দরবারি ইতিহাসে তাঁর নামগন্ধ নেই। সে ইতিহাসের হিসেবে একেবারে ত্রয়োদশ শতকে সরযূর পরপারে ইসলামের প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটে। কেবল লোকমুখেই গাজির কথা ফিরতে থাকে। ত্রয়োদশ শতকের শেষে আমির খসরু প্রথম লেখেন যে বহরাইচের শহিদ সিপাহসালারের মাজারের খোশবুতে সারা হিন্দুস্তান আমোদিত। চতুর্দশ শতকে সালারের দরগায় রইস ও গরিবগুর্বো ভক্তদের ভিড় পর্যটক ইবন বতুতার নজর এড়ায় না। ছশো বছর ধরে গাজির জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে। তারই জেরে ঐতিহাসিকদের একচোখোমি এড়ানোর জন্যই যেন জাহাঙ্গিরের আমলে সুফি চিস্তি সিলসিলার তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক আবদুর রহমান গাজি সাহেবের চরিতকথা লেখেন, নাম দেন মিরাত-ই-মাসুদি। রচনার মাঝে ফাঁকফোকর ছিল। লেখককে স্বপ্নে দেখা দিয়ে গাজি মিয়াঁ ফাঁকগুলি পূরণ করে দেন, সব মুশকিলের আসান হয়। স্বপ্নে সিদ্ধ এই জীবনীর প্রামাণিকতা নিয়ে রহমানি পাঠকদের আর সন্দেহ থাকে না, দরবারি ঐতিহাসিকদের নীরবতা তুচ্ছ হয়ে যায়।

বারো বছর বয়সেই সালার মাসুদ সুলতান মামুদের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন, মুলতান থেকে অজমেঢ়ের নানা জায়গায় জেহাদে নেতৃত্ব দেন। পরে দরবারি রাজনীতির খেয়োখেয়িতে বিরক্ত হয়ে অযোধ্যার সতরেখে থিতু হন; পরে বহরাইচে মহুয়া গাছে ঢাকা একটা সূর্যকুণ্ডকে শোধন করে নিজের স্থায়ী আস্তানা গাড়েন। এলাকার বনেজঙ্গলে তিনি শিকার করতেন, বাসিন্দাদের আবাদিতে উৎসাহ দিতেন, এমনকী আশপাশের হিন্দু চৌধুরী ও মুকদ্দমদের সঙ্গে নিয়মিত রাজস্ব আদায়ের বন্দোবস্তও তিনি করে ফেলেন। আবদুর রহমানের বৃত্তান্তে সালারের রাজ্যপাট যেন মোগলাই শাসনের একটি প্রভাতী সংস্করণ। এই আস্তানা থেকেই তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা ইলাহাবাদ ও বারাণসী পর্যন্ত জেহাদি অভিযান চালায়। ১০ জুন ১০৩৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিয়ে ঠিক হয়, তখন সালারের বয়স মাত্র উনিশ বছর। ওই দিনই জমিদার সোহেলদেব ও হরদেবের নেতৃত্বে বিশাল হিন্দুবাহিনী তাঁর পাট আক্রমণ করে, পাটরক্ষার ডাকে বরবেশে সালার মাসুদ যুদ্ধে যান। ওই যুদ্ধে ইসলাম ধর্মপ্রচারের পুণ্যব্রতে তিনি শহিদ হন। নিজের বিয়ের দিনই শাহাদত প্রাপ্তি, এই রকম মহিমান্বিত উরস বা মৃত্যুর দিন আর কোনও ভারতীয় গাজির ভাগ্যে ঘটেনি।

এ ভাবেই সপ্তদশ শতকে আবদুর রহমান ‘শহিদের শাহজাদা’ সালার মাসুদের একটি নিটোল চরিতকথা লিখেছিলেন, একেবারে আদর্শ গাজিনামা। একবিংশ শতকে সেটি খুলে পড়েছেন শাহিদ আমিন, তাঁর পড়ার ঝোঁকটি একেবারে আলাদা। ইসলামের আঞ্চলিক ও লোকবিশ্বাসের অনুপুঙ্খ লেখা তাঁর উদ্দেশ্য নয়, গাজি পিরকে ঘিরে হিন্দু-মুসলমানের সম-অন্বয়-বাদী ভাবভালবাসার পটচিত্রও তিনি আঁকতে চাননি। প্রচলিত এই সব ছকের বাইরে গোষ্ঠীস্মৃতির সূত্র ধরে হিন্দু ও মুসলমান সমাজের ‘সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের অসাম্প্রদায়িক ইতিহাস’ লেখাটা তাঁর উদ্দেশ্য। সেই জন্য আরও অনেক খণ্ডকথা ও নথি তিনি গাজির বস্তানির মধ্যে তালাশ করেছেন, সেগুলির মাধ্যমে মিরাত-ই-মাসুদি-র সঙ্গে সওয়াল জবাব জমিয়েছেন। তাঁর পাঠে ধরা পড়েছে ভারতে ইসলাম প্রচারের এক নতুন প্রেক্ষিত।

‘থোড়া করে গাজি মিঞা, বহুত করে দফালি।’ গাজির হালহকিকতের মরণোত্তর সজীব আর্কাইভস-এর সন্ধান দফালিদেরই জানা আছে। উত্তরপ্রদেশে ছড়ানো শতেক গাজির থানে ও মেলায় ঢোলক বাজিয়ে এরাই গাজির পালা গায়, আম আদমির কাছে এদের পালাকীর্তনই স্মৃতিজাগানিয়া ‘পারফরমেন্স’। ইসলামি অতীতকথায় এইগুলি নানা সময়ের অভিযোজন, কালের নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে যোজনাগুলি একটি একটি লোকভাষ্যও বটে। গত দেড়শো বছর ধরে দফালিদের গাওয়া পালার অনন্য আর্কাইভসে সমৃদ্ধ শাহিদের সন্দর্ভটি। এই মহাফেজখানার খণ্ড খণ্ড পালা আখ্যানে সালার মাসুদের জেহাদি বীর বৃত্তান্ত রূপান্তরিত হয় ভিন্ন রসের রূপকথায়, সালারের নাম বদলে যায়, আদুরে ডাক হয়ে ওঠে; যেমন, বালে (বাচ্ছা) মিয়াঁ, বালে দুলহা (বর), গাজনা (প্রসন্ন) দুলহা, এমনকী সালার ছনালা (ছেনাল)। এই প্রত্যেকটি নামকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা কথা-কণিকা, ওই সব কথাকণিকার টানে হাজির হয়েছে কত বর্ণাঢ্য চরিত্র। যেমন, অন্ধ জোহরা বিবি গাজির কৃপায় দৃষ্টি ফিরে পান, গাজির সঙ্গেই তাঁর বিয়ে ঠিক হয়। শাদির দিনে গাজির মৃত্যুর পর বাগদত্তা রূপেই তিনি তাঁর দুলহার মাজারের আজীবন সেবিকা হন, দুলহার মাজারের পাশে তাঁরও কবর হয়। ঠিক এমনই লোরচন্দ্রের দুয়োরানি আমিনা সতী নিজের হাতে বালে মিয়াঁকে খাইয়েছিলেন, গাজি সাহেবের পাতানো বোন তিনি। জাসু আহির বা রাজা নন্দকিশোরের অবহেলিত বন্ধ্যা স্ত্রী মশো তো গাজির আশীর্বাদেই পুত্রবতী হন। এমনকী গাজির নীলি ঘুড়িটা আজও বহরাইচের মাঠে ঘাটে রাতবিরেতে ঘুরে বেড়ায়, এলাকার দেখভাল করে। এই সব লোককথার অনুষঙ্গ সহজাত নৈপুণ্যের সঙ্গে শাহিদ বিচার করেছেন, টুকরো টুকরো অধ্যায়ে দেখিয়েছেন প্রত্যেকটি কথাসুতলি কী ভাবে তেলি, আহির বা জোলা সমাজের দৈনন্দিন উদ্বেগ, আশা ও প্রত্যাশার রঙে ছোপানো। তাই বালে মিয়াঁর বরকতে কুঠও সারে, আমও ফলে। গাজির জেহাদি ইতিহাসের বস্তানিতে বাঁধা আছে অসংখ্য ছোটবড় ইতিকথা, তার ফেকড়া ধরেই চলে ইসলামের লোকায়ন, সমূহের নিজস্ব বুদ্ধি ও বোধের আকারে গড়ে ওঠে দেশজ ইসলামের প্রচার ও প্রসার ভারতী।

জোরের সঙ্গেই শাহিদ আমিন বলেছেন যে, ইতিকথাগুলি সবসময় একে অপরের পরিপূরক নয়, প্রায়শই ভিন্নমুখী, মাঝে মাঝে জড়াপট্টি হয়ে যায়, মাঝে মাঝে আলাদা থাকে, বিন্যস্ত থাকে। কোনও রকম সরল অবধারিত সম-অন্বয়ের বোধে সেগুলি মিলেমিশে একাকার হয়নি। বরং সময়ের চাপে কথাগুলির বয়ানের ঝোঁকে প্রতিসরণ ঘটেছে, কথনের স্বরেও তারতম্য ধরা পড়ে। সপ্তদশ শতকে লেখা আবদুর রহমানের ফারসি ইতিহাসে গাজির হিন্দু প্রতিপক্ষদের বুদ্ধি ও সাহসের অভাব নেই, অবস্থাবিশেষে কেউ কেউ গাজির মিত্রও। উনিশ শতকে ওই একই বৃত্তান্তের ইনায়েত হুসেন কৃত অনুবাদে লশকর-ই-ইসলামের হুঙ্কারেই কাফের যোদ্ধারা কাপড়চোপড় নোংরা করে ফেলে। কোনও কোনও দফালির গীতিতে গাজির জেহাদি সেনার দাপটে বারাণসীর দেবপুরী একেবারে সাবাড় হয়ে যায়। অন্য পক্ষে, অষ্টাদশ শতক থেকেই ওয়াহাবি পুস্তিকাগুলিতে একনাগাড়ে বলা হয়েছে যে ‘বুতশিকন’ (মূর্তিভঙ্গকারী) সালার মাসুদের ভজনা তো আসলে ‘বুতপরসত’ বা মূর্তিপূজা, বেশরিয়তি, ঘোর ইসলামবিরোধী। পাশাপাশি আর্যসমাজী শিক্ষকরাও জানাতে ভোলেন না যে, গাজির কাহিনিটাই গালগল্প, আদ্যন্ত অনৈতিহাসিক। এ হেন মিয়াঁর থানে পুজো মানত সবই অশিক্ষিত হিন্দু নিম্নবর্গ ও মহিলাদের কুসংস্কার, শুদ্ধ ধর্মের সত্যার্থ প্রকাশে সেইগুলি অচিরেই বিলুপ্ত হবে। জল গড়িয়ে যায়। বিশ শতকের যুক্তিসিদ্ধ সমাজতত্ত্বের গবেষণায় গাজি মিয়াঁ স্থান পান লোকসংস্কৃতি চর্চার চুবড়িতে।

দরাফ খান গাজির উপরে লেখা একটি নিবন্ধে ভারতীয় জনমানসে ইসলামের প্রসারের চরিত্রবিচারে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘তুর্কানা’ ও ‘সুফিয়ানা’ বর্গের প্রয়োগ করেছিলেন। কী ভাবে ভারতে ইসলামি সংস্কৃতির লড়াকু মনোভাব কালপ্রবাহে সৌহার্দ্যের ভাবনায় বোধিত ও রূপান্তরিত হল, সেই ক্রমবিচারই তাঁর অন্বেষার লক্ষ ছিল। দুই কোটিনিষ্ঠ তত্ত্বটির জোর স্বীকার্য। তবে সংস্কৃতির অন্বয় নির্ণয়ে তত্ত্বটি একমুখী, একটিমাত্র অক্ষরেখায় ক্রমবিবর্তন নির্দেশিত হয়েছে। পক্ষান্তরে গাজি মিয়াঁর ইতিবৃত্তের যে অনেকান্ত পাঠ শাহিদ আমাদের কাছে পেশ করেছেন, তাতে দ্বন্দ্ব ও ভেদবোধ, সহিষ্ণুতা ও সমঝোতার নিয়ত চতুষ্কোণী প্রতিচ্ছেদ ঘটেছে, একটির বোধ আর একটিকে সব সময় নাকচ করেনি। নানা সংস্কৃতি ও ভাবের বেণীবন্ধনের খোপে ভারতীয় ইসলামের নকশা তৈরি হয়েছে। বেণীবন্ধনের গিঁটগুলি কোথাও বা আলগা, কোথাও বা আঁটসাট। বিচার-বিশ্লেষণে প্রত্যেকটি গিঁটের জোরই যাচাই করতে হবে, প্রতিটি গ্রন্থিক্ষেত্রের স্বাতন্ত্র্যকে মর্যাদা দিতে হবে। তবেই সামগ্রিক আলোচনায় ধরা পড়বে নকশার ছাঁদের নিজস্ব সূক্ষ্ম কারিকুরি, চেনা যাবে ছোটবড় প্রতিসরণের ধর্মান্ধ, ধর্মিষ্ঠ ও ধর্মনিরপেক্ষ ছোপছাপ ও চিহ্নগুলিকে।

ঐতিহাসিককে এক সময় না এক সময় তাঁর গাজিনামাকে শেষ করতেই হয়। কিন্তু প্রতি বছরে গাজি মিয়াঁর উরসের দিনে লোকের ঝান্ডা-মিছিল চলতেই থাকে, ঐতিহ্যের নকশিকাঁথায় নতুন করে ছুচসুতোর ফোঁড় পড়ে। ‘চলে গাজি কি নগরিয়া’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE