কবিতার সঙ্গেই তাঁর ওতপ্রোত সম্পর্ক। ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদক এবং বিশিষ্ট কবি হিসেবে সঞ্জয় ভট্টাচার্য আজও উজ্জ্বল বাংলা সাহিত্যে। জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন তো বটেই, ব্যক্তিগত ভাবেও কার্যত তাঁর অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সঞ্জয় ভট্টাচার্যের উপন্যাসের ভাষা সম্পর্কে বলেছিলেন ‘অন্যরকমের ভাষা, আধুনিক যে সব উপন্যাস লেখা হচ্ছে, সেরকম ছিল... নতুন ধরনের ভাষা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, মানে উপন্যাস হিসেবে আমার কাছে খুবই উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে সে উপন্যাসের পরিচয় হারিয়ে গেছে।’ এই হারিয়ে যাওয়ার উৎস সন্ধান করতেই বেরিয়েছে সঞ্জয় ভট্টাচার্য কথাসমগ্র ১ (সম্পা: ভূমেন্দ্র গুহ সুকল্প চট্টোপাধ্যায়। ধানসিড়ি, ২৭৫.০০)। ‘সঞ্জয় ভট্টাচার্যের আখ্যানবিশ্বে পরিভ্রমণ করে আত্মবিস্মরণের নৈতিক ‘পাপ’ স্খলন করার যথার্থ সময় এসেছে।’ এ বইয়ের শুরুতেই স্বীকার করেছেন অন্যতম সম্পাদক সুকল্প চট্টোপাধ্যায়। সঞ্জয়ের দু’টি উপন্যাস ‘মরামাটি’ ও ‘বৃত্ত’ এবং ‘ফসল ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের গল্পগুলি ঠাঁই পেয়েছে খণ্ডটিতে। সঙ্গে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিন্তু গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত গল্প-উপন্যাসের পঞ্জি। আর তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি তো রয়েইছে। ‘মানবসত্তাকে রেখায়িত করে সীমার দিগন্তে বাঁধার প্রয়াসকে স্রেফ না বলে দিয়ে অনাগত বিপুল সম্ভাবনার দুয়ারগুলিকে চিহ্নিত করতে করতে হেঁটে চলাই তাঁর সৃষ্ট চরিত্রপুঞ্জের বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে অস্তিবাদী দার্শনিক এবং লেখকদের অনুসারী সঞ্জয় এ দেশের তথাকথিত মার্কসবাদী সমালোচকদের উষ্মার কারণ হয়েছেন যথেষ্টই। স্তালিনীয় ভাবধারার অতিরেককে পাত্তা না দিয়ে ট্রটস্কিতে আস্থা, পরবর্তীতে গান্ধীবাদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন তাঁকে সততই রাজনৈতিকভাবে নিঃসঙ্গ করেছে।’ প্রাক্কথন-এ জানিয়েছেন সুকল্প। ‘মরামাটি’ উপন্যাসের প্রথম কয়েকটি লাইনই যেন চিনিয়ে দেয় কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যের অসমতল মনটিকে: ‘রেল-লাইনের উঁচু বাঁধটা সাপের মত আঁকাবাঁকা দেখা যায়— তার গা ঘেঁসেই পাহাড়ের বুনো দেয়াল। অথচ পাহাড় অনেক দূরে— দু’তিন মাইল ত খুব। বাঁধের এদিকে শুধু ক্ষেত— মেটে জলের সায়র— ওদিকে গাঁয়ের জংলা ডাঙ্গায় গিয়ে শেষ।’
চল্লিশের দশকের অবিভক্ত বাংলায় যখন মার্কসীয় দর্শনের ব্যাপ্তি, পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের উত্তাল বিরোধিতা, তখনই এক বিশিষ্ট কথাকার হয়ে উঠেছিলেন স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরেও মানুষজনকে করে তুলেছিল সংশয়ে দীর্ণ, যন্ত্রণাহত; তাদের দৈনন্দিনের হতাশা বিষাদ উৎকণ্ঠাই তাঁর গল্প-উপন্যাসের আখ্যানগদ্য হয়ে উঠেছিল। গৌতম অধিকারীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গল্পসংগ্রহ (কথারূপ, ৩০০.০০)। ‘সবার সাথে’, ‘ছোট বড় মাঝারি’ গল্পগ্রন্থের যাবতীয় রচনার সঙ্গে অগ্রন্থিত গল্পগুলিও একত্রিত এই সংগ্রহে। সাংবাদিকতায় বা জীবনাচরণে বামপন্থার প্রতি বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও তিনি ‘মুখ ও মুখোশের লড়াইয়ে, মুখটাকেই জয়ী করতে চেয়েছিলেন বলেই কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে ত্যাগ করতে হয়েছিল...’ জানিয়েছেন সম্পাদক। তাঁর মতের সমর্থনে তুলে এনেছেন বিজন ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার: ‘‘ ‘সোভিয়েত দেশ’ পত্রিকার কী একটা উপলক্ষে ডিনার পার্টির আয়োজন চলতেছিল। সেখানে বাঘা বাঘা সব লোকের আমন্ত্রণ। স্বর্ণদা যখন জানতে পারলেন যে, ওই ডিনার অনুষ্ঠানে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা আমন্ত্রিত নন, তখন তিনি প্রতিবাদ করে লিখিত চিঠি পাঠিয়ে জানান, আমার ভাবনার বাইরে যে দেশে প্রথম বিপ্লব ঘটেছে, যে দেশে প্রথম সাম্যবাদের পতাকা উড়েছে, যে দেশে প্রলেতারিয়েত শাসনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টি সক্রিয় ও সচেতন, সেই সোভিয়েত দেশের পত্রিকার নৈশভোজনে কী করে এই পত্রিকারই চতুর্থ শ্রেণির শ্রমজীবীরী আমন্ত্রিত হন না?’’ তাঁর গল্পগুলি আপাত সারল্য ও সহজ উপস্থাপনার আড়ালে আদতে বুদ্ধি ও মননে উজ্জ্বল, তাতে জানা কোনও গল্পই যেন অচেনা এক বাস্তবে মুক্তি পেত। এ নিয়ে সংগ্রহটির ভূমিকা-য় তাঁর গল্পের নির্মাণটি চিনিয়ে দিয়েছেন পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘স্বর্ণকমল তাঁর গল্পের জগতে যে বাস্তব তৈরি করেন অবশ্যই তার উৎস তাঁর সময় ও অভিজ্ঞতা। যে জগৎকে তিনি প্রত্যক্ষত চিনতেন না, তার বাইরে তিনি প্রায় পা রাখতে চাননি। আর বাস্তব মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত একটি সময়ের বহির্বাস্তব নয়, এ ওই বাস্তব থেকে জাত অন্তর্বাস্তবও। ওই বাস্তবের বিচিত্র নানা তল তিনি ধরেছেন।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy