Advertisement
১১ মে ২০২৪
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

কবিপত্নীর জীবন ও সম্পর্কের রসায়ন

গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় অনুষ্ঠিত ‘কবিপত্নী মৃণালিনী ও ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষরবীন্দ্রনাথের বিরাট ব্যক্তিত্বের জ্যোতির প্রভাবে এই মহীয়সী মহিলার প্রভা একেবারে আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে। কিন্তু শান্তিনিকেতন স্থাপনে তিনি যেমন সর্বতোভাবে নিজের সাহচর্য, শক্তি, এমনকি অনটনের দিনে অলঙ্কারগুলি পর্যন্ত দিয়া সহায়তা করিয়াছিলেন, সংসারে তাহা একান্ত বিরল।

প্রদর্শনীর একটি ছবি।

প্রদর্শনীর একটি ছবি।

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৬ ০১:৪২
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথের বিরাট ব্যক্তিত্বের জ্যোতির প্রভাবে এই মহীয়সী মহিলার প্রভা একেবারে আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে। কিন্তু শান্তিনিকেতন স্থাপনে তিনি যেমন সর্বতোভাবে নিজের সাহচর্য, শক্তি, এমনকি অনটনের দিনে অলঙ্কারগুলি পর্যন্ত দিয়া সহায়তা করিয়াছিলেন, সংসারে তাহা একান্ত বিরল। মৃণালিনী দেবী সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছিলেন প্রমথনাথ বিশী তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে মৃণালিনীর সম্পর্কের নিবিড়তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রমথনাথের পরের উক্তিটিতে : ‘কবিপত্নী জীবিত থাকিলে বিদ্যালয় পরিবারটি নিশ্চয় আরও সুপিনদ্ধ হইয়া উঠিত।’

মৃণালিনী দেবীর (১৮৭৪-১৯০২) এই অবদান ও ব্যক্তিত্বের উপর আলো ফেলতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের উদ্যোগে এ বারের কবিপক্ষে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায়। শিরোনাম ‘কবিপত্নী মৃণালিনী ও ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়’। লিখিত তথ্য ও আলোকচিত্রের সমাহারে গড়ে উঠেছে এই প্রদর্শনী। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এই প্রদর্শনীতে অসামান্য কিছু আলোকচিত্র দেখার সুযোগ হল আমাদের। পাঠ্য-অংশের যে লিখনশৈলী তারও থাকে নিজস্ব চিত্রঋদ্ধতা। আপাতভাবে তা দৃশ্যগত না হলেও কল্পনায় তা তো ছবিও জাগায়। অর্থাৎ শব্দ সমাবেশের সংকেত থেকে জেগে ওঠে কল্পিত ছবি। সেই কল্পিত দৃশ্যতার সঙ্গে আলোকচিত্রের যে বিনিময়, তা তথ্যকে শুধু সম্পূর্ণতাই দেয় না, তাকে নান্দনিকভাবে সহনীয় করে তোলে। আলোচ্য প্রদর্শনীটি সে দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে এই প্রদর্শনী। একটি ধারায় রয়েছে মৃণালিনী দেবীর জীবন এবং রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ইতিবৃত্ত। আর একটি ধারায় এসেছে ব্রহ্ম বিদ্যালয়ের আনুষঙ্গিক তথ্য।

উপস্থাপনার সৌকর্যে দুটি বিষয়ই খুব শিল্পঋদ্ধভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। তবে আমরা এখানে সেই তথ্যের দিকে যাব না। আলোকচিত্রগুলোকেই একটু নিবিষ্টভাবে দেখার চেষ্টা করব। সেখানে অবশ্য একটি সমস্যা আছে। অধিকাংশ ছবিতেই উৎস নির্দেশ বা শিল্পীর নাম নেই। এত সুষ্ঠু এই উপস্থাপনায় এই অভাব অপ্রত্যাশিত লাগে।

আলোকচিত্রমালার প্রথম ছবি হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য খুলনা-র দক্ষিণডিহিতে মৃণালিনী দেবীর পিতৃগৃহের ছবিটি। সৌভাগ্যক্রমে এর শিল্পীর নামও উল্লিখিত আছে— কাজী সিরাজুল হক। ছবিটি রঙিন এবং ডিজিটাল যুগে তোলা। দৃশ্যমান ইটে তৈরি লালাভ রঙের এই দ্বিতল ভবনটি ঊনবিংশ শতকের গৃহ-স্থাপত্যের সুন্দর দৃষ্টান্ত। যদিও এটি রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরালয়, কিন্তু তাঁর বিবাহ এ বাড়িতে হয়নি। ৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩ বিবাহের দিন কনেকে তুলে আনা হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে।

রবীন্দ্রনাথ-মৃণালিনীর বিবাহের ঠিক পরে তোলা যুগল ছবিটি ঊনবিংশ শতকের আলোকচিত্রশৈলীর সমৃদ্ধ দৃষ্টান্ত। স্বাভাবিক উপস্থাপনার মধ্যেও এ ছবিতে এক ধরনের সংবৃত অলঙ্করণময়তা আছে, যা অনেকটা ‘বারোক’- রীতির অনুষঙ্গ আনে। ছোট্ট মাধুরীলতাকে কোলে নিয়ে কবিপত্নী ও কবির দ্বিতীয় যে ছবিটি সেটি পূর্বোক্ত ছবির তুলনায় অনেক সরল। দুজনকেই এখানে স্নিগ্ধ ও আবিষ্ট লাগে। দৃশ্যের বাস্তব যেমন ছবি তোলাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনই ছবি তোলার পদ্ধতিও বাস্তবকে কিছুটা প্রভাবিত করে।

শিলাইদহের কুঠিবাড়ি ও জোড়াসাঁকোর দক্ষিণের বারান্দা— দুটি ছবিই স্থাপত্যের অন্তর্গত বিভিন্ন তলের জ্যামিতিক বিন্যাসের অসামান্য দৃষ্টান্ত। আলো-ছায়ার দ্বৈতে সৃষ্টি হয়েছে এই জ্যামিতি, যা দৃশ্যতাকে সমৃদ্ধ বৈভব দিয়েছে। দক্ষিণের বারান্দা-র ছবিটি দেখলে অনিবার্যভাবে গগনেন্দ্রনাথের ছবির কথা মনে পড়ে। আর একটি স্মরণীয় নিসর্গ বিস্তীর্ণ প্রান্তরের উপর দিয়ে ট্রেন যাওয়ার দৃশ্য, পাশে জলার উপর ফুটে থাকা পদ্মফুল। এ রকম অজস্র ছবির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র-মৃণালিনীর স্মৃতি ঝংকৃত হতে থাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabindranath tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE