Advertisement
০২ মে ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

হিন্দু ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক

ভারতে আর কোনও ধর্মীয় প্রকাশনা এত সাফল্যের সঙ্গে হিন্দুত্বের বিপণন ঘটায়নি। অক্ষয়ের বই সেই প্রকাশনার অনন্য ইতিহাস।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০১
Share: Save:

অ ক্ষয় মুকুল পাঠকের উৎসাহ উশকে দিতে জানেন। তাঁর বইটি পড়ে এক দিন মেছুয়ার কাছে ১৫১ মহাত্মা গাঁধী রোডে হাজির হই। সে এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। সামনের ঘরে রামায়ণ, মহাভারত ও হরেক ধর্মগ্রন্থ। পাশের ঘরে কম্বল, জামাকাপড়, আয়ুর্বেদিক ওষুধ। প্লাস্টিকের বোতলে ঘি, গোমূত্র। জীবনে প্রথম ঠাহর হল, গোমূত্র কোক-পেপসির চেয়েও মূল্যবান, ৫০০ মিলির দাম ৮৩ টাকা।

বাড়ির নাম গোবিন্দ ভবন। ভারত জুড়ে রেল স্টেশনে ‘হুইলার’-এর মতো আমরা যে ‘গীতা প্রেস, গোরক্ষপুর’-এর বইয়ের দোকান দেখি, কিংবা হৃষীকেশের গঙ্গাতীরে ‘গীতাভবন’, সব কিছুর প্রাণকেন্দ্র মহাত্মা গাঁধী রোডের এই বাড়ি। এই গোবিন্দ ভবনের অধীনেই ১৯২৩ সালে তৈরি হয় গীতা প্রেস। কম দামে রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদ বাজারে এনেই থেমে যায়নি তারা। ১৯২৬ সালে বের হয় মাসিক ‘কল্যাণ’ পত্রিকা। অতঃপর ‘কল্যাণ কল্পতরু’ নামে ইংরেজি মাসিক। দুই প্রকাশনা এখনও রমরমিয়ে চলছে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজকাল অনলাইনে সেই পত্রিকার গ্রাহক হওয়াও যায়। ভারতে আর কোনও ধর্মীয় প্রকাশনা এত সাফল্যের সঙ্গে হিন্দুত্বের বিপণন ঘটায়নি। অক্ষয়ের বই সেই প্রকাশনার অনন্য ইতিহাস।

ইতিহাস কলকাতারও। গীতা প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা জয়দয়াল গোয়েন্দ্‌কা ও সম্পাদক হনুমানপ্রসাদ পোদ্দার রাজস্থান থেকে এসে কলকাতা, বাঁকুড়ায় ব্যবসা করতেন। রাজস্থানের মারওয়াড়ি সম্প্রদায়ের ইতিহাস, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার বাণিজ্যকুশলতা নিয়ে কয়েক বছর আগেই টমাস টিমবার্গ-এর দ্য মারওয়াড়িজ: ফ্রম জগৎ শেঠ টু বিড়লাজ বেরিয়েছিল। অক্ষয়ের বইটি আলো ফেলেছে কলকাতার লুপ্ত সাংস্কৃতিক ইতিহাসে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় এই শহরে ‘রডা অস্ত্র ষড়যন্ত্র’র কথা অনেকের জানা। রডা কোম্পানি এখানে মাউজার পিস্তল আমদানি করত, তাদের কেরানি শ্রীশচন্দ্র মিত্র সেখান থেকে বেশ কিছু পিস্তল সরিয়ে রাখেন। অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা অনেকেই এই চোরাই পিস্তল কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু সে পরের কথা! শহর জুড়ে ধরপাকড়, তল্লাশির সময় পিস্তলগুলি কোথায় ছিল? অক্ষয় জানাচ্ছেন, সেগুলি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল বড়বাজার এলাকার ঘনশ্যামদাস বিড়লা, ওঙ্কারমল সরাফ, প্রভুদয়াল হিম্মৎসিংকা প্রমুখ মারওয়াড়ি তরুণদের হেফাজতে। বিপ্লব কেবল বঙ্গসন্তানদের একচেটিয়া নয়। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর আমলে কলকাতার মারওয়াড়ি তরুণরাও সশস্ত্র আন্দোলনের ঘোড়ায় চড়েছিলেন, মনে করিয়ে দেন অক্ষয়। পরে অবশ্য ইতিহাস বদলে যায়। কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট অবসরের পর লন্ডনে বিড়লা কোম্পানিতে চাকরি নেন। আর বারীন ঘোষের ভক্ত হনুমানপ্রসাদ পোদ্দার হয়ে ওঠেন গীতা প্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক ও চালিকাশক্তি।

হনুমানপ্রসাদের বুদ্ধিতেই তখন গীতা প্রেস সুলভে ছাপছে রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণ। তাঁর সম্পাদনায় ‘কল্যাণ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় লিখছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। পরবর্তী কালে রাধাকৃষ্ণন, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি, ক্ষিতিমোহন সেন থেকে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়... কে নন? পত্রিকায় ছবি আঁকার জন্য সাহিত্যিক প্রেমচন্দ রেফার করছেন কলাভবনে অবন ঠাকুর, নন্দলাল বসুর ছাত্রদের। ছবি আঁকছেন ও সি গঙ্গোপাধ্যায়ও। গোরক্ষপুরের ধর্মীয় প্রকাশনাতেও যে বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট কী ভাবে প্রভাব ফেলেছিল, চমৎকার ধরে দিয়েছেন লেখক।

এসেছে হিন্দি ভাষা ও হিন্দুত্বের সম্পর্কও। তখন গোরক্ষপুরে বসছে নাগরী প্রচারিণী সভার অধিবেশন, প্রেমচন্দ থেকে সুমিত্রানন্দন পন্থ, ছায়াবাদী কবি নিরালা, হরবংশরাই বচ্চন সকলে কলম ধরছেন গীতা প্রেসের হয়ে। বসুধা ডালমিয়া একদা ভারতেন্দু হরিশচন্দ্রকে নিয়ে তাঁর বইয়ে দেখিয়েছিলেন, হিন্দি/ হিন্দু/ ভারতীয় গোছের শব্দগুলি ব্রিটিশ ভারতে কী ভাবে সচল ভঙ্গিতে অর্থ বদলাতে বদলাতে প্রায় এক রকম হয়ে যায়, সনাতনপন্থী ও সংস্কারপন্থীরা উভয়েই অন্যের শিবির থেকে আইডিয়া ধার করতে থাকেন, জন্ম নেয় ‘হিন্দু ঐতিহ্য’ নামের একটি নতুন জিনিস। অক্ষয় মুকুল দেখান, চল্লিশের দশক থেকে গীতা প্রেস কী ভাবে ওই নতুন ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক বনে যায়! যে হনুমানপ্রসাদ গাঁধীর ডান্ডি আন্দোলনে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, গোরক্ষপুরের জেলে দেবদাস গাঁধীকে দেখতে গিয়েছিলেন, প্রথম থেকেই একটি বিষয়ে তিনি নাছোড়। গাঁধী কেন হরিজনদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার দিতে চান! গীতা প্রেস বর্ণাশ্রমে বিশ্বাসী। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের বাইরে শূদ্র কেন ঢুকবে মন্দিরে? হনুমানপ্রসাদ পরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর বরাবরের বিশ্বাস ছিল বর্ণাশ্রম, গোমাতার সেবাই হিন্দু ধর্মকে বাঁচাতে পারে।

জওহরলাল নেহরু এবং বি আর অম্বেডকরের সঙ্গে এই সম্পাদকের অহি-নকুল সম্পর্ক তাই সহজেই অনুমেয়। হিন্দুরা একটি বিয়ে করবে, সম্পত্তিতে পুত্রসন্তানের পাশাপাশি বিধবা স্ত্রী, বিধবা পুত্রবধূরও অধিকার থাকা নিয়ে ‘হিন্দু কোড বিল’ পাশের সময় গীতা প্রেস ওই আইনের তুমুল বিরোধী। হিন্দু ধর্মে এ ভাবে হাত দেওয়ার সাহস হয় কী ভাবে? ‘‘দেশে হিন্দু নেই। পাকিস্তানের নেতারা সবাই মুসলমান, আর আমাদের নেতারা জাতীয়তাবাদী,’’ আক্ষেপ ‘কল্যাণ’ পত্রিকার। কংগ্রেসে মদনমোহন মালব্য, রাজেন্দ্রপ্রসাদ সহ একটা বড় গোষ্ঠী তখন নেহরুর বিরুদ্ধে, ‘কল্যাণ’পক্ষে।

অক্ষয়ের চমৎকারিত্ব এখানেই। তিনি কোনও তত্ত্বে যান না, শুধু তথ্যগুলি পর পর সাজিয়ে দেন। আর সেখান থেকে একটা কথা পরিষ্কার হয়ে যায়। ‘মুসলমানরা আমাদের হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করছে, নিজেদের বাঁচাতে আমাদের সংগঠিত হতে হবে’ গোছের কথা ‘কল্যাণ’ বারংবার বলেছে। হিন্দু ধর্মকে ওই পত্রিকাগোষ্ঠী বরাবর আক্রান্ত বা ভিক্টিম হিসেবেই দেখেছে। কখনও আক্রমণকারীর চরিত্রে ইংরেজ, কখনও অম্বেডকর, কখনও বা মুসলমানেরা। হিন্দুত্ব যে আদতে কোনও ধর্ম নয়, ভয় বা ঘৃণার মতোই একটি মানসিক অবস্থা, সেটি মোক্ষম ভাবে বেরিয়ে আসে ৫৩৯ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থ থেকে।

হিন্দু ধর্ম নিয়ে গীতা প্রেসের ধারণাটি প্রায় খিচুড়ি গোছের। এক দিকে বর্ণাশ্রমে বিশ্বাসী: কিন্তু হিন্দু ধর্মে যে তান্ত্রিক, শৈব থেকে বৈষ্ণব অনেকেই বর্ণাশ্রম মানেন না, সেই সূক্ষ্ম তফাত তারা কখনওই জানায় না। তারা বরং জানায়, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদি যে সব ধর্ম ভারতে উদ্ভূত, সকলেই হিন্দু। নাস্তিক চার্বাকও যে হিন্দু, উহ্য রয়ে যায়। যে ভাবে উহ্য রয়ে যান নিজামুদ্দিন আউলিয়া, সেলিম চিস্তির মতো মরমিয়া সুফি সাধক। ধর্মের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের এই ঝাঁঝালো ককটেলে তাই খ্রিস্টান ও মুসলমান দুই তরফই প্রায় হিন্দুর শত্রু বনে যায়।

চমৎকার বইটিতে শুধু দুটি ফাঁক রয়ে গেল। ১৯২৭ সাল থেকে গীতা প্রেসের উদ্যোগে দেশ জুড়ে ছাত্রছাত্রীদের গীতা-পরীক্ষা ও বৃত্তির কথা জানিয়েছেন অক্ষয়। বাইবেল সোসাইটি কিন্তু তার আগে এ জাতীয় পরীক্ষা নিত। গীতা-পরীক্ষা তার প্রভাব কি না, বলেননি অক্ষয়। ‘কল্যাণ’ আজও বেরোয়। প্রায় ৯০ বছর ধরে এ রকম ধর্মীয় পত্রিকা চালানো যে কত কৃতিত্বের, বারংবার উল্লেখ করেছেন লেখক। কিন্তু বলতে ভুলে গিয়েছেন, ‘কল্যাণ’ ভারতের সবচেয়ে পুরনো ধর্মীয় পত্রিকা নয়। রামকৃষ্ণ মিশনের ‘উদ্বোধন’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ তার ঢের আগে থেকে বেরোচ্ছে। গীতা প্রেসের মতো ‘ভিজিবিলিটি’ ওই দুই পত্রিকার ছিল না, সত্য। এবং গোমাতাকে রক্ষা, হরিজন-বিরোধিতা ইত্যাদি নিয়ে তারা কল্যাণের মতো উগ্র হিন্দুত্ব ছড়ায়নি, আরও বড় সত্য।

গীতা প্রেসের অন্যতম ইন্টারেস্টিং বিষয়: মেয়েদের নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা। থাকবন্দি সমাজে বিশ্বাস করে বলে ভাবে, ব্রাহ্মণ সবার উপরে। শূদ্র অম্বেডকর সবার নীচে। সে রকম ছেলেরা সবার উপরে। আধুনিক শিক্ষা মেয়েদের ‘নষ্টভ্রষ্ট’ করে, সহশিক্ষা দেশকে উচ্ছন্নে পাঠায়। অক্ষয়ের বইটি পড়ার পর গোবিন্দ ভবন থেকে জয়দয়াল গোয়েন্দকার লেখা ‘আদর্শ নারী সুশীলা’ নামে একটি পুস্তিকা কিনেছিলাম। সেখানে সুশীলাকে ভুল বুঝে তার স্বামী বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। সুশীলা ভাবে, স্বামী পরম দেবতা। ফলে তাঁর কথা মেনে নিতেই হবে। গীতাতেই তো সুখে নিস্পৃহ আর দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনা থাকার কথা বলা হয়েছে। নিষ্কাম কর্মের দার্শনিক ধারণাটি কাঁচা ভাবে চোলাই করে পতিভক্তির বোতলে পুরে দেওয়া হল। এটাই গীতা প্রেস, এটাই ভারতবর্ষ।

অক্ষয় মুকুল এ ভাবেই গীতা প্রেসের দুনিয়া চিনতে শেখান। সেকুলার ভাল, আর হিন্দুত্ববাদী মাত্রেই খারাপ গোছের আপ্তবাক্য না আউড়ে বুঝিয়ে দেন, দুটো পৃথিবীই মিলেমিশে থাকে। ফলে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যুক্তির ভেক-ধরা ভয় এবং ঘৃণার ফাঁদে পা দিলেই সর্বনাশ! সেখানেই এটি সাম্প্রতিক কালের অন্যতম উল্লেখ্য বই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE