অ্যান ইকনমিস্ট ইন দ্য রিয়্যাল ওয়ার্ল্ড: দি আর্ট অব পলিসিমেকিং ইন ইন্ডিয়া। কৌশিক বসু। পেঙ্গুইন ভাইকিং, ৫৯৯.০০
কৌ শিক বসু কে, ভারতের মুখ্য অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই জানতে পেরেছিলেন স্বয়ং অধ্যাপক বসু। তাঁর বাড়ি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন যে মহিলা, তিনি পাশের বাড়ির পরিচারিকাকে অধ্যাপক বসুর পরিচয় দিয়েছিলেন এই ভাবে: ‘আরে, বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম বাড়ে, সেটা উনিই বাড়ান!’
এই বিশিষ্ট পরিচয়ের কথা কৌশিক বসু নিজেই লিখেছেন অ্যান ইকনমিস্ট ইন দ্য রিয়্যাল ওয়ার্ল্ড: দি আর্ট অব পলিসিমেকিং ইন ইন্ডিয়া বইটিতে। তাঁর যে কোনও লেখাই সুখপাঠ্য। এই বইটিও ব্যতিক্রম নয়। তবে, পাঠসুখের উপভোগ পেরিয়ে পড়লে এই বই একটা দীর্ঘ দ্বন্দ্বেরও গল্প— রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির দ্বন্দ্ব। তাঁর বা়ড়ির পরিচারিকার গল্পটাই যেমন। তিনি যদি কৌশিক বসুর বাড়িতে কর্মরতা না হতেন, তবে তাঁর জানার কোনও উপায় থাকত না, ঠিক কোন মানুষটি ‘বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ান’। কিন্তু, তিনি বিলক্ষণ জানতেন, দাম বাড়ানো-কমানো সরকারেরই হাতে। বাজার অর্থনীতির আড়াই দশক পেরিয়ে এসেও এই বিশ্বাস ভারতে সর্বজনীন। রাজনীতিকরাও জানেন, ভোটের বাজারে মূল্যস্ফীতির বাড়া অভিশাপ নেই। ফলে, রাজনীতি চায় যে কোনও ভাবে মূল্যস্ফীতির হারকে দমিয়ে রাখতে। কিন্তু অর্থনীতি জানে, মূল্যস্ফীতির চালচলন নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য সরকারের নিতান্ত কম। রাজনীতি আর অর্থনীতির বিপরীতমুখী স্রোতে কে কাকে কতখানি টেনে নিয়ে যায়, যেতে পারে, কৌশিক বসুর এই বইটি তারই আখ্যান।
তিনি ২০০৯ থেকে ২০১২, তিন বছর নর্থ ব্লকের বাসিন্দা ছিলেন। বিশ্ব-অর্থনীতি তখন বিপুল মন্দার গ্রাসে। তার আঁচ এসে লেগেছিল ভারতেও। এই তিন বছরে সরকারের অন্দরমহলের বহু টানাপ়ড়েনের সাক্ষী নিশ্চয়ই ছিলেন তিনি। কিন্তু, সেই ভিতরের খবরের আকর্ষণে এই বই পড়লে হতাশ হতে হবে। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ‘ভিতর থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি বলেই সদ্য-অতীত কিছু গোপন ঘটনাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসা যায় কি না, তা নিয়ে অত্যন্ত কঠিন কিছু নৈতিক প্রশ্ন আমার মধ্যে আছে।’
তবে, ব্যক্তির প্রসঙ্গ এসেছে। অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদে যোগ দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই অধ্যাপক বসু এক প্রবল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, নিজের প্রাপ্য সুবিধাগুলি আদায় করতেও মানুষকে যে ঘুষ দিতে হয়, তাকে আইনসিদ্ধ করে দেওয়া হোক। ভারতের আইনে ঘুষ নেওয়া এবং দেওয়া সমান অপরাধ। কাণ্ডজ্ঞান থাকলেই বোঝা সম্ভব, এই আইন থাকলে যিনি ঘুষ নেন এবং যিনি দেন, উভয়েই ঘটনাটিকে গোপন করতে চাইবেন। ফলে, নিজের প্রাপ্যটুকু পেতেও যাঁরা বাধ্য হয়ে ঘুষ দিচ্ছেন, তাঁদের স্বার্থরক্ষার কোনও পথ নেই। অধ্যাপক বসুর যুক্তি ছিল, এই ক্ষেত্রে (শুধু এই ক্ষেত্রেই, অন্যায্য কিছু অধিকার করার জন্য যে ঘুষ দেওয়া হয়, সেটি নয়) ঘুষ দেওয়াকে আইনি করে দেওয়া হোক, যাতে ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়ার পর অভিযোগ জানানোর উপায় থাকে। ঘুষখোররাও যেহেতু জানবেন, ঘুষ নিলে ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট, অতএব তাঁরাও ঘুষ চাইবেন না।
অত্যন্ত স্পষ্ট যুক্তি, ইনসেনটিভ বা প্রণোদনার ব্যবহারের একটা চমৎকার উদাহরণ। কিন্তু, ভারতীয় মিডিয়া! অধ্যাপক বসুকে ছেঁকে ধরেছিলেন অনেকেই, তিনি দুর্নীতিকে সমর্থন করছেন, এই অভিযোগে। সে সময় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে একটি কথোপকথনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক বসু। এমনিতেই দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত সরকার তাঁর কারণে আরও একটি বিতর্কে পড়েছে, ফলে অধ্যাপক বসুর খানিক অস্বস্তি ছিল। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে তিরস্কার করেননি, ভেবেচিন্তে কথা বলার পরামর্শও দেননি। বলেছিলেন, ‘আপনি দেশের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। নতুন, অপ্রচলিত চিন্তাকে আলোচনায় নিয়ে আসাই আপনার কাজ। আপনি সেটাই করেছেন।’ যুক্তির প্রতি, চিন্তার প্রতি এই উদারতাকে আজকের ভারতে অলীক মনে হয় না?
এই বইটি আসলে এক অন্তর্ঘাতেরও উপাখ্যান। সরকারি চিন্তার অচলায়তনে অর্থনীতির কাণ্ডজ্ঞান কী অন্তর্ঘাত ঘটাতে পারে, বইয়ের পাতায় পাতায় তার ইঙ্গিত রয়েছে। দুর্নীতির প্রসঙ্গটি যদি একটি উদাহরণ হয়, অন্য উদাহরণ খাদ্যশস্য। অধ্যাপক বসুর মতে, সরকার খাদ্যশস্যের নেট ক্রেতা হতে পারে না। বাজারে যখন জোগান প্রচুর, তখন কিনে জোগান কমলে সেই মজুত পণ্য বেচতে হবে। এবং, এখানেই দ্বিতীয় সংস্কার জরুরি। সরকারি গুদাম থেকে মাল কিনে তাতে যেন কেউ মুনাফা না করতে পারে, সে দিকে সরকারের প্রখর দৃষ্টি থাকে। অধ্যাপক বসু লিখছেন, বরং মুনাফা করতে দিলেই মানুষের লাভ। তাঁর মতে, বাজারে যখন জোগানের অভাব, তখন যদি সরকার তার গুদাম থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য বিক্রি করে, কিন্তু কাউকেই খুব বেশি পরিমাণে না দিয়ে অনেককে বিক্রি করে, এবং তার পর সেই শস্য নিয়ে কে কী করল, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র মাথা না ঘামায়, তবে বাজারের নিয়ম মেনেই এই বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে, এবং আখেরে চাল-গমের দাম কমবে। এফসিআই-এর গুদামে সব সময় খানিক পণ্য মজুত রাখতেই হবে, এই নীতিটিকেও বর্জন করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি, কারণ ‘সব সময় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য মজুত রাখার অর্থ, সেটুকু পণ্য কখনও বিক্রি না করা— তা হলে আর রাখা না-রাখার মধ্যে ফারাক কী?’ ভারতের খাদ্যনীতির সঙ্গে পরিচয় থাকলেই বোঝা যায়, পরামর্শগুলোর মধ্যে কতখানি বিপ্লব রয়েছে।
একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। দিল্লিতে সরকারি কর্তা হওয়ার সুবাদে যে লালবাতিওয়ালা গাড়িটি তিনি পেয়েছিলেন, তার সামনের সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধার চেষ্টা করায় তাঁর ড্রাইভার তাঁকে নিরস্ত করে জানান, তাঁর জন্য এই সব নিয়ম প্রযোজ্য নয়! সম্ভবত সে দিনই, নর্থ ব্লকে গাড়ি থেকে নামতেই এক জন অপরিচিত লোক এসে তাঁর হাতের ব্যাগটা নিয়ে দৌড় লাগায়। ইতালিতে গিয়ে এই ভঙ্গিতেই নিজের ব্যাগ খুইয়েছিলেন অধ্যাপক বসু। ফলে, ঘরপো়ড়া গরু হিসেবে ব্যাগ ছিনতাইকারীর পিছনে তিনি ধাওয়া করতে যাবেন, এমন সময় ড্রাইভার জানান, ঘাবড়ানোর কারণ নেই, সরকারি কর্তার ব্যাগ বেয়ারারাই বয়ে দেন। অধ্যাপক বসু দ্রুত বুঝে নেন, ভিন্ন এক দুনিয়ায় এসে পৌঁছেছেন।
তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে এমন হরেক কিস্সা শুনিয়েছেন লেখক। অর্থনীতির কচকচানিতে যদি আগ্রহ না-ও থাকে, শুধু এই গল্পগুলোর জন্যও বইটা পড়ে ফেলা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy