Advertisement
০৫ মে ২০২৪

দাড়ি থাকলেই টেররিস্ট

দাড়ি না থাকলেও। চামড়ার রং বাদামি হলেই হল। প্যারিসের ঘটনার পর এই সন্দেহ আরও বাড়বে। অপমানগুলো গিলে নিয়ে, হাসি দিয়ে ম্যানেজ করতে হবে।দাড়ি দেখলেই টেররিস্ট চেনা যায়, এ আমি প্রথম জানি ২০০২ সালে। যখন নিউ ইয়র্কের উপকণ্ঠে জার্সি সিটির এক শ্বেতাঙ্গ ট্যাক্সিচালক, সহাস্যবদনে, পিছনের সিটে বসা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ম্যান, ইউ লুক লাইক আ টেররিস্ট।’ ‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’ জিজ্ঞাসা করলে সে আমার সযত্নলালিত ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে। দাড়ি দিয়ে যে লোক চেনা যায়, সেটা ওখানেই প্রথম জানলাম, তা অবশ্য নয়।

মুসলিম হলেও আমি উগ্রপন্থী নই, জানাতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন এই চরিত্র। কর্ণ জোহরের ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবিতে।

মুসলিম হলেও আমি উগ্রপন্থী নই, জানাতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন এই চরিত্র। কর্ণ জোহরের ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবিতে।

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

দাড়ি দেখলেই টেররিস্ট চেনা যায়, এ আমি প্রথম জানি ২০০২ সালে। যখন নিউ ইয়র্কের উপকণ্ঠে জার্সি সিটির এক শ্বেতাঙ্গ ট্যাক্সিচালক, সহাস্যবদনে, পিছনের সিটে বসা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ম্যান, ইউ লুক লাইক আ টেররিস্ট।’ ‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’ জিজ্ঞাসা করলে সে আমার সযত্নলালিত ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে। দাড়ি দিয়ে যে লোক চেনা যায়, সেটা ওখানেই প্রথম জানলাম, তা অবশ্য নয়। এর আগে, সেই ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গাঁধীর হত্যাকাণ্ডের দিন আটকে গিয়েছিলাম শ্রীরামপুরের কাছে। পর দিন, আমার বন্ধু শৌভিক বলেছিল, ‘দিল্লি রোডের কাছে কী কাণ্ড! মোড়ে একটা করে ট্রাক থামাচ্ছে, আর নামিয়ে এনে পড়পড় করে দাড়ি ছিঁড়ছে। সে কী আওয়াজ, বুঝলি, রক্তারক্তি হয়ে যাচ্ছে।’ দিল্লিতেও শুনেছি দাড়ি দেখেই গলায় ভালবেসে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল জ্বলন্ত টায়ার। ও ভাবেই দেশপ্রেমিকরা হত্যাকারীদের চিহ্নিত করছিল। কিন্তু সে দাড়ি আমার ছিল না। বন্ধুরা যদিও বলে জন্ম থেকেই বস্তুটা আছে, কিন্তু, কথাটা সত্যি নয়। তখন আমার দাড়ি হয়ইনি। তাই দেবেশ রায়ের নায়িকা যেমন পেট থেকে পড়েই বুঝতে পারেনি নারী মাত্রেই ধর্ষণযোগ্য, তেমনই দাড়ি মাত্রেই শনাক্তকরণের চিহ্ন, এ অনুভব করতে আমার ২০০২ সাল অবধি সময় লেগেছিল।

ট্যাক্সিচালকের গলায় অবশ্য কোনও বিরূপতা ছিল না। এর আগেই জনৈক শিখকে নিউ ইয়র্কে দাড়ি দেখে পেটানো হয়েছে, জানা ছিল, কিন্তু সে তো বিচ্ছিন্ন ঘটনামাত্র। ট্যাক্সি ড্রাইভার তাই হাসছিল, যেন ওটা নেহাতই রসিকতা। এতই অ্যাবসার্ড ব্যাপারটা, যে, আমিও হাসছিলাম। বন্ধুরাও। এ যেন সেই ‘ছাগল ও রবীন্দ্রনাথ’ অনুরূপতার আমেরিকান সংস্করণ। আসলে চোখের সামনে তৈরি হচ্ছে নতুন বিশ্বব্যবস্থা, নির্মিত হচ্ছে সন্ত্রাসবাদী নামক এক ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ভিলেনের, বদলে যাচ্ছে ভোকাবুলারি, সেটা তখনও বোঝা যায়নি। জিনিসটা যে সিরিয়াস বিজনেস ক্রমশ জেনে যাব আমরা। অনেক পরে এক শ্বেতাঙ্গ সহকর্মিণীকে গপ্পটা করায়, সে রাগত স্বরে বলবে, ‘তার পরেও তুমি ওই ট্যাক্সিতে থাকলে?’ তাকে আর মুখ ফুটে বলতে পারব না, আমার কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ডে, ওটা যে কোনও অপমানজনক কথা, তা বুঝতে পারিনি মামণি, ক্ষুদিরামকেও তো লোকে সন্ত্রাসবাদীই বলত। বলতে পারব না, কারণ, ক্ষুদিরাম (অর্থাৎ কিনা, একাধারে সন্ত্রাসবাদী, অবিমৃশ্যকারী এবং শ্রদ্ধেয়)-এর ইংরিজি কী হয় আমার জানা নেই। কিন্তু বলা হোক বা না হোক, এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য, যে, আজকের দিনে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, ‘সন্ত্রাসবাদ = শয়তান’, এই সহজ সমীকরণটি গত শতাব্দীর শেষে তো নয়ই, এমনকী এই সহস্রাব্দের গোড়াতেও বিলকুল ছিল না। সত্যটা নির্মিত হতে সময় লেগেছে, হজম হতেও। অনেকে ঠেকে শিখেছে, যেমন সেই ইউরোপিয়ান পাইলট, যে সিকিয়োরিটি চেক ইনে ঢোকার আগে ইয়ার্কি করে বলবে, আমার ব্যাগে বোমা আছে, এবং তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করা হবে তাকে। তত দিনে বোঝা হয়ে গেছে, ‘নিগ্রো’ বা ‘গ্রিঙ্গো’র মতো ‘সন্ত্রাসবাদী’, ‘বোমা’ এই শব্দগুলো আর প্রকাশ্যে উচ্চারণ করা যাবে না। ওরা ইয়ার্কিরও বিষয় নয়। আইরিশ বিপ্লবের গৌরবোজ্জ্বল দীপ্তি থেকে উহারা চিরতরে পশ্চিম এশিয়ার অন্ধকারে নির্বাসিত।

আমার নিজের অবশ্য বুঝতে এতটা সময় লাগেনি। কারণ, ওই ট্যাক্সির ঘটনার মাসখানেকের মধ্যেই আমাদের তিন বন্ধুর ঘরে পুলিশ আসে। সেও নিউ জার্সিতেই। পুলিশ আমেরিকায় দুমদামই আসে, সে খুব বড় ব্যাপার নয়। কেউ কি ভুল করে ইমার্জেন্সি নম্বর ডায়াল করে ফেলেছিল? নাহ্, কেস তা নয়। আমরা তিন জনে নাকি বাইরে ছবি তুলছিলাম। পড়শিদের মধ্যে কেউ লাগিয়েছে, আর পুলিশও চলে এসেছে তদন্তে। আকাশ থেকে পড়ে ‘ছবি তোলা কি নিষিদ্ধ নাকি?’ জিজ্ঞাসা করলে পুলিশ বলে, ‘অ্যাবসলিউটলি নট।’ তার পর আমাদের নামধাম টুকে নিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। তার আচরণেও কোনও বিরূপতা ছিল না। কিন্তু আমাদের বোঝা হয়ে যায়, কেস সিরিয়াস। বদলে যাচ্ছে প্যারাডাইম, উলটে যাচ্ছে দুনিয়া, এ শুধু দাড়ির ব্যাপার নয়। এখন ছবি তোলা নিষিদ্ধ না হলেও, যা সন্দেহজনক, তা আসলে আমাদের প্রোফাইল। কারণ বন্ধুদের বাকি দুজন ছিল ক্লিন শেভ্ন।

ব্যাপারটা আরও ভাল করে বোঝা যায়, ২০০৫ সালে লন্ডন ব্লাস্টের পর, যার পোশাকি নাম ৭/৭। লন্ডননিবাসী বন্ধু দীপ্তায়ন ক’দিন বাদেই টিউব স্টেশনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ‘আঁখো দেখা হাল’ দেয়। ওরা বিকেলে ফিরছিল অফিস থেকে। স্টেশনে ঢোকার দরজার ভিতরে দেখে খানতিনেক পুলিশ গুঁতোগুঁতি করে কী যেন করছে। ভাল করে তাকিয়ে দেখে, ভূলুণ্ঠিত একটা কালো মাথা, কিঞ্চিৎ গোঙাচ্ছে। লোকটার মাথায় ঝোপের মতো চুল। পুলিশগুলোর মধ্যে এক জন তার পেটে ব্যাটন দিয়ে খোঁচা মারছে, গালাগালি দিচ্ছে, আর আর এক জন নির্বিচারে লাথি, ঘুসি চালিয়ে যাচ্ছে। ধরাশায়ী লোকটা দুর্বোধ্য, বিজাতীয় ভাষায় কী যেন বলছে চিৎকার করে, আর এ সবের ফাঁকে ফাঁকে বলছে ‘হেল্প, হেল্প!’ মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে, গাল কেটে গেছে, মেঝেতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। পাশে ওয়াকি-টকি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিয়োরিটির লোককে ‘কী হয়েছে মশাই?’ জিজ্ঞাসা করলে সে খুব উদাস গলায় বলে, ‘লোকটা বোধহয় (মে বি) টেররিস্ট।’

একটা ‘মে বি’-র বশে এই রকম মারা যায়? হতভম্ব হয়ে ‘কেন মশায়, আপনার এমন মনে হবার কারণ?’ জিজ্ঞাসা করায় নির্বিকার সিকিয়োরিটি উত্তর দেয়, ‘হি লুক্‌স লাইক দ্যাট।’ সঙ্গে আরও বলে, ‘হি ডিড নট স্টপ হোয়েন উই আস্কড হিম টু।’

ওই লন্ডনের টিউব স্টেশনেই ক’দিন বাদে পুলিশের হাতে মারা যায় ব্রাজিলিয়ান যুবক চার্লস মেনজেস, স্রেফ সন্দেহবশত। সে বেচারি কাজে যাবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, যখন সার্ভেলান্স টিম দেখে, তার চেহারা জনৈক সন্দেহভাজনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কথিত আছে, নজরদার অফিসার হিসি করতে ব্যস্ত থাকায় ভাল করে মিলিয়ে দেখার অবসর পাননি। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না, স্রেফ সন্দেহের বশেই তার শরীরে ঢুকে যায় গরম গরম বুলেট। জুলাই মাসের কোনও এক বিকেলে আর বাড়ি ফেরা হয় না মেনজেসের। দুনিয়ার জানা হয়ে যায়, আমারও, যে, শুধু দাড়ি নয়, বাদামি চামড়া আর কালো চুল, পুলিশ দেখে ভয় পাওয়া, বিচিত্র কায়দায় ইংরিজি বলা, সবই এখন শনাক্তকরণের চিহ্ন।

পুলিশ অবশ্য ভুল স্বীকার করে পরে। আমরাও এসব ছোটখাটো ভুলে অভ্যস্ত হয়ে যাই আস্তে আস্তে। বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল। নইলে ভুল নিয়ে এত হট্টগোল করতে গেলে তো গাঁ উজাড় হবার উপক্রম হবে। লন্ডন ব্লাস্টের আগেই বেরিয়ে গেছে ‘কনফেশন্‌স অব অ্যান ইকনমিক হিটম্যান’, যেখানে লেখক, প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জন পার্কিন্‌স জানাচ্ছেন, তাঁর মতো বিশেষজ্ঞরা আসলে মুখোশের আড়ালে পশ্চিমি বহুজাতিকের ঘাতকবাহিনীর অংশ ছাড়া আর কিছু নয়, যারা কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে স্রেফ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য পক্ষে টানতে চেয়েছিল সৌদি ও ইরান সহ ইসলামি দুনিয়ার নানা কট্টর স্বৈরতন্ত্রী মধ্যযুগীয় শাসকগোষ্ঠীকে— যারা ‘বন্ধু’ হয়েছে তাদের সাত খুন মাফ হয়েছে, বাকিরা আখ্যা পেয়েছে ‘মানবজাতির শত্রু’।

এ ছাড়া রিলিজ হয়ে গেছে তথ্যচিত্র ‘ফারেনহাইট ৯/১১’, যেখানে স্পষ্ট করে দেখানো হয়েছে, কী ভাবে পক্ষীমাতার মতো মার্কিন প্রশাসন আগলে রেখেছে গোটা সৌদি রাজকুলকে।

আর ২০০৭-এ নেওমি ক্লেইন লিখবেন ‘ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজ্‌ম’-এর উত্থানের উপাখ্যান, যেখানে দেখানো হবে, ইরাক যুদ্ধের ‘ডিজাস্টার’ হুট করে হওয়া কোনও ব্যাপার নয়, বরং এক সিস্টেমেটিক ‘শক থেরাপি’-র অংশ, যার উদ্দেশ্য হল সব বাধাবিঘ্ন উপড়ে ফেলে বহুজাতিক-নিয়ন্ত্রিত এক বিশ্বব্যবস্থার পথ নির্মূল করা।

জ্ঞানবৃক্ষের এ সব নতুন ফল খেলে ক্রমশ দেখা যাবে, গোটা ‘ওয়েপন্‌স অব মাস ডেস্ট্রাকশন’ নামক হুজুগটিই তো ভুল, টনি ব্লেয়ার যা স্বীকার করবেন অনেক পরে। ওবামা বলবেন, বুশের কাজকর্মের অনিচ্ছাকৃত ফল হল আইসিস। তালিবানদের তোল্লাই দেওয়া ভুল হয়েছিল, সেও কেউ কোনও এক দিন বলবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এ সব ভুলস্বীকারে গুরুত্ব দিলে মুশকিল। কারণ তত দিনে বোতল থেকে দৈত্য বেরিয়ে ফ্র্যাংকেনস্টাইন রূপ ধারণ করেছে, যুদ্ধ ছাড়া আর উপায় নেই।

অতএব শনাক্তকরণের চিহ্নরা ক্রমশ আরও পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। ভাষা ছাড়িয়ে ঢুকে যায় আইনি বিধিবদ্ধতায়। সে একদম সোজাসুজি বিভাজন, কোনও লুকোছাপা নেই। মার্কিনগামী তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের টিপছাপ নেবার সুবন্দোবস্ত হয়। উন্নত দেশের নাগরিকরা ছাড় পান, কারণ গরিব মাত্রেই সন্দেহভাজন। আমরা মানিয়ে নিই এ সবের সঙ্গে। কমবয়সিরা প্রথম বার বিদেশে আসার আগে দাড়ি কেটে আসবে কিনা জিজ্ঞাসা করে। ১৯৮৪-র দিল্লি শহরেও শোনা যায় এ রকম চল হয়েছিল। কিন্তু এ তো দিল্লি নয়, তাই শুনে আমরা হাসি। ওরে পাগল, এখন শনাক্তকরণের চিহ্ন কি একটা? চোখের রং, চামড়া, চুল, হাবভাব, কোনও দিন আমেরিকান সেন্টারে ইট মেরেছিলে কিনা, সবই এখন স্ক্যানারের তলায়, দাড়ি দিয়ে কী হবে? শাহরুখ খানের কি দাড়ি ছিল? জর্জ ফার্নান্ডেজ তো প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।

ওয়াশিংটনের এয়ারপোর্টে ফার্নান্ডেজের জামাকাপড় খুলে ‘স্ট্রিপ সার্চ’ করা হয়। ২০০২ এবং ২০০৩ সালে। পর পর দু’বার! শাহরুখ খানকেও অপদস্থ করা হয়েছিল দু’বার। ২০০৯-এ ‘মাই নেম ইজ খান’ সিনেমারই প্রোমোশনের সময় নিউ জার্সির এয়ারপোর্টে দু’ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল তাঁকে। ‘গ্রেফতার করা হয়নি’ বলে কর্তৃপক্ষ বার বার মাথা নাড়লেও তাঁর নাম যে কম্পিউটারের রেড অ্যালার্ট লিস্টে দেখিয়েছিল, এ অভিযোগ নাকচ করা যায়নি। ২০১২-য় নিউ ইয়র্ক এয়ারপোর্টে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শাহরুখকে দেড় ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পেশাল লেকচার দিতে যাচ্ছিলেন, পৌঁছে বলেছিলেন, এয়ারপোর্টে বসে থাকা তাঁর জন্য নিয়ম হয়ে গিয়েছে।

সরকারি তরফে অবশ্য বলা হয়, সবই র‌্যান্ডম চেকিং। শুনে আমাদের খ্যা-খ্যা করে হাসি পায়। আমরা জানি র‌্যান্ডম বলে কিছু হয় না। হাওড়া স্টেশনে চেকার যখন খপ করে কাউকে ধরে, সেও র‌্যান্ডম নয়। জামাকাপড় কিংবা হাবভাবে সন্দেহ হলে তবেই ধরে। আমরা শেয়ালদা স্টেশনে ‘কলেজ স্টুডেন্ট’ বলে টিকিট ফাঁকি দিয়েছি, বনগাঁ লোকালে ঝুলে পগার পার হয়েছি, এই সব টুপি আমাদের দিয়ে লাভ নেই।

তাড়া করা চলবেই। সেই অত্যাচারের জবাবে কেউ সত্যি উগ্রপন্থী হয়ে গেলে? ‘নিউ ইয়র্ক’ ছবিতে যেমন।

এ সব অবশ্য লিখিত-পড়িত ভাবে কোথাও নেই। তাতে হাসা থামে না। ইতিহাস তো স্রেফ লেখাপড়া আর সন-তারিখের সমাহার নয়, তাই শনাক্তকরণের চিহ্নগুলি ঘুরে বেড়ায় লোকগাথায়। ইমেল কিংবা হোয়াট্‌সঅ্যাপে। নানা রকম গুল্প চালু হয় বাজারে, যার ইংরিজি নাম জোক। শাহরুখ খান নাকি ইমিগ্রেশনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘মাই নেম ইজ খান।’ শুনে ইমিগ্রেশন অফিসার বলে, ‘অ্যান্ড ইউ আর ডান।’ ব্যক্তিগত স্তরেও কত ফাজলামি। দেশ থেকে ফিরেছে অলি নামের একটি মেয়ে। এয়ারপোর্টে ঝামেলা হয়েছে। এক ভারতীয় সহকর্মী আমাকে বলে, ‘ইংরিজিতে লেখা তো, অলিকে আলি পড়েছে।’

এই বাজারে অগণিত বুশ জোকের সঙ্গেও যোগ হয় একটি খাঁটি ভারতীয় রসিকতাও। শোনা যায় প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ নাকি মনমোহন সিংহের সঙ্গে নিজের স্ত্রীর আলাপ করিয়ে দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এই লোকটার দেশে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিম বাস করে। কিন্তু এক জনও টেররিস্ট নেই। ভাবো একবার।’ এরই সিরিয়াস ফর্ম হিসেবে আসে সোশাল নেটওয়ার্কে পপুলার হয়ে যাওয়া স্মার্ট ঘোষণা, ‘মুসলিম মাত্রেই সন্ত্রাসবাদী নয়, কিন্তু সন্ত্রাসবাদী মাত্রেই মুসলিম।’

এ সবের কিছুটা স্মার্টনেস, বাকি সবই রসিকতা। ইমিগ্রেশনে গুড়কে কে যেন ‘ব্রাউন সুগার’ বলে ডিক্লেয়ার করেছিল, সেই রকম। কিন্তু এই হিউমারের রং কালো। আদ্যিকালের ক্রিকেট টিমের মতোই কে জেন্টলম্যান আর কে প্লেয়ার— সেই বিভাজন এখানে স্পষ্ট। কোথাও কোনও সরকারি ঘোষণা নেই, কিন্তু লোকগাথায় আমরা জেনে যাই, আমাদের জানতে হয়, ধর্ম আর নামও, বাকি সব কিছুর সঙ্গে সুস্পষ্ট করে শনাক্তকরণের চিহ্ন হয়ে উঠেছে।

এ সব জোক, তাই আমরা ফিসফিসিয়ে বলি। শুনে খিলখিলিয়ে হাসি, কারণ আমরা ‘ওরা’ নই। ‘ওরা’ দুষ্ট, ‘ওরা’ বোম মারে, ‘ওরা’ উড়িয়ে দেয় টুইন টাওয়ার, ‘আমরা’ যে ‘ওরা’ নই, সেটা এ সব করে আমাদের প্রমাণ করতে হয়। আর প্রমাণ করতে হয় বলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আমরাই ‘ওরা’, সোহহং। আমাদের নাম অদ্ভুত, নিবাস তৃতীয় বিশ্বে, আমরা পুলিশ দেখে ভয় পাই, আমাদের হাবভাব সন্দেহজনক, উচ্চারণ কুচ্ছিত। আমাদের আমেরিকায় আসতে হলে আঙুলের ছাপ দিতে হয়, আমরা সন্দেহভাজনের দলে।

ফরাসি দেশে কিছু ধর্মোন্মাদ বন্দুকধারী এলোপাথাড়ি মানুষ শিকারে নামে। থিয়েটার ভর্তি হয়ে পড়ে থাকে মানুষের লাশ। আমরা সোশাল নেটওয়ার্কে ফরাসি পতাকায় নিজেদের প্রোফাইল পিকচার সাজাই। কারণ, আমরা সুসভ্য পশ্চিমেরই পতাকাধারী, গোটা দুনিয়া এবং নিজেদের কাছে এটা প্রমাণ করার দায় আমাদেরই। আমাদের এ উদ্যম নতুন করে কোনও হামলা শুরু হওয়ার ভয়ে নয়। নতুন করে কিছু হবার কোনও প্রশ্নই নেই, কারণ আমরা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত। আমরা জানি, যারা আস্ত প্লেনভর্তি মানুষ নিয়ে টুইন টাওয়ারে আছড়ে পড়ার পরিকল্পনা করে, মিউজিক কনসার্টে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়, সেই পিশাচদের তৈরির দায় আমাদের নয়। এও জানি, যারা এই দৈত্যকে বোতলের বাইরে এনেছে, তারা এখনও এক জঙ্গিকে নিকেশ করতে গিয়ে আর এক জঙ্গিকে তোল্লাই দিচ্ছে, আজও, এই লেখা লেখার দিনেও, বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে সিরিয়ার স্কুল, হাসপাতাল, আস্ত শহর, তৈরি করছে আরও কিছু জঙ্গিকে।

কিন্তু তার পরেও, এ কথাও একেবারেই অজানা নয়, আমাদের অর্থাৎ আপামর তৃতীয় বিশ্ববাসীরই দায় হল দাড়ি গোঁফ কামিয়ে, মাথা মুণ্ডন করে, ক্রমাগত প্রমাণ করে চলা, আমরা হত্যাকারীদের দলে নেই। সেই ১৯৮৪ সালের দিল্লিতে যেমন হয়েছিল।

bsaikat@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE