যাঁরা ভারতমাতার সম্মান বাঁচানোর জন্য সিডিশন-চার্জকেই পিতা ঠাউরেছেন, যাঁরা কোর্টে জেএনইউ-এর ছাত্র-শিক্ষক ঠেঙাচ্ছেন, তাঁরা শুনলে নির্ঘাত শিউরে উঠবেন, যে, সিডিশন আইনটির সঙ্গে ভারতমাতার কোনও যোগাযোগ নেই। মূলত ভারতীয়দের দাবিয়ে রাখার জন্য ও-বস্তু চালু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, যে ট্র্যাডিশন বজায় রেখে স্বাধীনতার পরে আইনটি মাছি-মারা-কেরানির দক্ষতায় টুকে দেওয়া হয়। যাঁরা ট্রাকের গায়ে ‘মেরা ভারত মহান’ না লিখলে ফাইন করেন, সিনেমা হলে জাতীয় সংগীতের সময় উঠে না দাঁড়ালে হাজতে পাঠান, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে প্রেম করলে দেশদ্রোহী বলে রামঠ্যাঙানি দেন, তাঁরা এ কথা শুনলেও অবশ্যই আকাশ থেকে পড়বেন, যে, সে টোকার যা কোয়ালিটি, তা ক্লাস সেভেনের লাস্ট বেঞ্চারকেও হেলায় টেক্কা দেবে। বাকিটা সবটা হুবহু এক রেখে এক আধটা শব্দ শুধু দুমদাম বদলে যায়, যেমন ‘হার ম্যাজেস্টি’ বদলে হয়ে যায় ‘ভারত সরকার’, ‘দ্বীপান্তর’কে পালটে করা হয় ‘কারাবাস’। অর্থাৎ, ব্যাপার একই, শুধু রানিমাকে কুচ্ছিত বললে ব্রিটিশ আমলে দ্বীপান্তর হত, আর এখন জেলে পোরা হয় ‘ভারতমাতার ডানা নাই’ বললে। মোট কথা সবই রানিমার ঐতিহ্য, এর সঙ্গে ভারতমাতার কোনও সম্পর্ক নেই।
যাঁরা ‘কেন আফজল গুরু?’, ‘কেন আজাদির স্লোগান?’ এই নিয়ে ভরা মিডিয়ায় পঞ্চায়েত বসাচ্ছেন, আর ‘আমরা নই, ও পাড়ার মন্টু বাজে স্লোগান দিয়েছে’ জাতীয় আমতা-আমতা স্বীকারোক্তি আদায় করছেন, তাঁদের অধিকতর আশ্চর্য করার জন্য এও বলা যাক, যে, মার্কিনি পুলিশ হেফাজতেই মৃত্যু হোক বা ভারতীয় এনকাউন্টারে, ফাঁসি হোক বা ইলেকট্রিক চেয়ার, রাষ্ট্রের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন অন্যায় কিছু তো নয়ই, বরং গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত হিসেবে সর্বত্রই তোলা হয়ে থাকে। এবং যে অখণ্ডতার ধারণাটা নিয়ে এত অস্বস্তি, সেটাও আদতে ভারতীয় কিছু নয়, স্বাধীনতা-পূর্ব আইনানুযায়ী ওটা ‘ব্রিটিশ ভারত’-এর অখণ্ডতা। আমাদের পিতৃপুরুষরাও দেশভাগের সময় সে অখণ্ডতার তোয়াক্কা করেননি, আর আজকের পৃথিবীতে ওই নিরেট ধারণা বাতিলও হয়ে গেছে। ‘স্বাধিকার’-এর দাবি তুললে সভ্য দুনিয়ায় আজ কেউ সিডিশন চার্জ আনে না, এমনকী ব্রিটিশরাও না। ক’দিন আগেই স্কটল্যান্ডে বিচ্ছিন্নতার দাবিতে গণভোট হয়েছে, তার আগে হয়েছিল কানাডায়। জনতা চাইলে দেশ টুকরো হয়, চাইলে জুড়েও যায় (যেমন হয়েছে জার্মানিতে), এ কথা দুনিয়াসুদ্ধ সবাই জানে। ছুরি-কাঁচি-দাঙ্গা-মৃত্যুমিছিল সহ দেশভাগ করব নিস্পৃহতায়, আর শান্তিপূর্ণ স্বাধিকারের দাবি তুললে মড়াকান্না জুড়ব, এই অভ্যাস সমকালীন নয়, ভারতীয় পরম্পরাও নয়, মরে যাওয়া ব্রিটিশ উপনিবেশের এক চিলতে উত্তরাধিকার মাত্র। যাঁরা হনুমানের অপমান করার জন্য কেজরিওয়ালের পিন্ডি চটকান, কাঁধে ঝোলা আর দাড়ি দেখলেই ‘এই বোধহয় স্লোগান দিল’ ভয়ে যুবকদের থানায় জিম্মা করেন, তাঁদের অবশ্য এই সব জিনিস বোঝার কথা নয়।
bsaikat@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy