Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

কেন? কেন? কেন?

ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে জব্বর তিনটে ধাঁধার সমাধান পেতে কোমর কষছে পেল্লায় মেশিন। শুরু হয়ে গিয়েছে দৌড়। নাউ অর নেভার।পা তালপুরীতে জেগে উঠল দৈত্য। দু’বছর পরে, আবার। সে এক যন্ত্র। পেল্লায়। মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় মেশিন। মাটির নীচে সুড়ঙ্গ। বৃত্তাকার। দৈর্ঘ্যে সাতাশ কিলোমিটার। এ হেন টানেল ইয়া মোটা ইস্পাতের চাদরে মোড়া। সেই নলের ভেতর বিপরীত মুখে ছুটছে দুই স্রোত। বাঁকা পথে তাদের ছোটাতে হাজারও আয়োজন। লোহালক্কড়, চুম্বক, ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম, এবং কুলিং ব্যবস্থা। যাতে দুটো স্রোতের তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ২৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০৪
Share: Save:

পা তালপুরীতে জেগে উঠল দৈত্য। দু’বছর পরে, আবার। সে এক যন্ত্র। পেল্লায়। মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় মেশিন। মাটির নীচে সুড়ঙ্গ। বৃত্তাকার। দৈর্ঘ্যে সাতাশ কিলোমিটার। এ হেন টানেল ইয়া মোটা ইস্পাতের চাদরে মোড়া। সেই নলের ভেতর বিপরীত মুখে ছুটছে দুই স্রোত। বাঁকা পথে তাদের ছোটাতে হাজারও আয়োজন। লোহালক্কড়, চুম্বক, ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম, এবং কুলিং ব্যবস্থা। যাতে দুটো স্রোতের তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ২৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

স্রোত কীসের? ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রোটন কণার। হ্যাঁ, সেই কণা, যা হাজির সব পদার্থে। আকাশের তারায়, পৃথিবীতে, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, মানুষের দেহে চুল-নখেও। এমন কণার দুই স্রোত বিপরীত মুখে ছুটছে ভীমবেগে। স্পিড? প্রায় আলোর সমান। সেকেন্ডে ৩০০,০০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। এ রকম বেগে মুখোমুখি ছুটন্ত গুচ্ছ গুচ্ছ কণা। তার পর তাদের সংঘর্ষ। প্রোটন তখন চূর্ণবিচূর্ণ। ধ্বংসস্তূপে আরও ছোট কণার পাহাড়। তারা প্রায় সবাই অতি ক্ষণস্থায়ী। সেকেন্ডের হাজার লক্ষ ভাগের মধ্যে ভোল বদলে অন্য কণা। তো সেই আবর্জনায় বিশেষ বিশেষ ভগ্নাবশেষের সন্ধান। খড়ের গাদায় ছুঁূঁচের খোঁজ। আঁতিপাতি খোঁজ। বিজ্ঞানীরা বলেন, একটা খড়ের গাদায় একটা ছুঁঁচ নয়, একশোটা গাদা থেকে একটা ছুঁূঁচ বের করার মতো কঠিন কাজ।

এমন কাজ তো আগেও হয়েছে। জেনিভা শহরের কাছে বিশাল গবেষণাগারে ওই যে যন্ত্র, লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (এলএইচসি) যার নাম, সেখানে তো ২০০৯-এর নভেম্বর থেকে ২০১৩-র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ও রকম ঠোকাঠুকি আর জঞ্জাল খোঁজার কাজই করেছিলেন নানা দেশের কয়েকশো বিজ্ঞানী। ওঁদের পরিশ্রম যায়নি বিফলে। আবর্জনায় মিলেছিল সাত রাজার ধন মানিক এক কণা। যার খোঁজে হা-পিত্যেশ করে বসেছিলেন পৃথিবীসুদ্ধ পদার্থবিদরা। প্রতীক্ষা সঙ্গত কারণে। গুণবিচারে এমনই দামি সেই কণাটি যে, এক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ঠাট্টাচ্ছলে তার নাম দিয়েছিলেন ‘গড পার্টিক‌্ল’। ঈশ্বর কণা। বিজ্ঞান ঈশ্বর মানে না, তিনি তার ঘোর শত্তুর, তবু খানিক রেগেমেগেই যেন বিজ্ঞানীপ্রবর ওই কণার নামে ‘গড’-এর শরণ নিয়েছিলেন। কয়েক দশক ধরে খোঁজ চলছিল কণার, টিকি মিলছিল না তার, আর সেই কণার গুরুত্ব বোঝাতে আস্ত একখানা বই লিখছিলেন বিজ্ঞানী। টিকি না পেয়ে বিরক্তি প্রকাশে বইয়ের নাম দিচ্ছিলেন ‘গডড্যাম পার্টিক‌্ল’। দূরছাই কণা। পাবলিশার ‘ড্যাম’ ছেঁটে রাখলেন শুধু ‘গড’। ব্যস। কণা নাম পেল জুতসই। কণার গুরুত্ব বিচার করলে নামের মধ্যে ঈশ্বর আমদানিতে বাহবাও দিতে হয়। আস্তিকের কাছে ভগবান যেমন সব কিছুর চালিকাশক্তি, জগৎসংসার এগোচ্ছে তাঁর দয়ায়, কণা-রাজ্যে গড পার্টিক‌্লও তেমনই মহিমাময়। সে বস্তুকে বানায় ভারী। সে না থাকলে পদার্থের থাকত না কোনও ওজন। তখন গ্র্যাভিটির টানে বাঁধা পড়ত না কোনও কিছু। তৈরি হত না গ্যালাক্সি গ্রহ নক্ষত্র। থাকত না পৃথিবী হাতি-ঘোড়া লোক-লশকর। ব্রহ্মাণ্ড হত শুনশান। কেবল কিছু তাপ আর জ্যোতি। তা না হয়ে, এই যে আজকের মতন দশা, এ সবই সেই একটা মাত্র কণার করুণায়। সে ঈশ্বরতুল্য বটেই।

হ্যাঁ, জঞ্জালের মধ্যে মিলেছিল সেই ঈশ্বর। প্রাপ্তিসংবাদ ঘোষণামাত্র ধন্যি ধন্যি। বহুকাঙ্ক্ষিত কণা মেলায় বিশেষজ্ঞদের স্বস্তি। এক বছরের মধ্যে এ বাবদে নোবেল প্রাইজ। প্রাপক দুই পণ্ডিত। পিটার হিগ‌্স এবং ফ্রাঁসোয়া এঙ্গলার্ট। সেই যাঁরা ১৯৬৪ সালে পেপার লিখে বলেছিলেন মহা গুরুত্বপূর্ণ ও-রকম একটা কণা থাকতেই হবে। সত্যি যখন হয়েছে সেই ভবিষ্যদ্বাণী, তখন তো বিজ্ঞানের সেরা শিরোপা তাঁদের অবশ্যপ্রাপ্য। এত কাণ্ডের পর মনে হতে পারে বুঝি রাজসূয় যজ্ঞ শেষ, নটেগাছ মুড়োলো।

ধুৎ, একটা দুটো নোবেল প্রাইজে বুঝি গবেষণা শেষ হয়? আয়ু শেষ হয়নি এলএইচসি মেশিনের। স্রেফ শাট-ডাউন চলছিল তার। পাক্কা দু’বছর। এই দীর্ঘ সময়ে বিজ্ঞানীরা ছুটি কাটাননি। বরং এলএইচসি-র চুম্বক, ইলেকট্রনিক্স, কুলিং সিস্টেম বেশি উন্নত করেছেন। যাতে ফের বাড়তি উদ্যমে কাজে নামতে পারে যন্ত্র। পারে দ্বিগুণ ক্ষমতায় কাজ করতে। ক্ষমতা মানে প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষের আঘাত। প্রথম দফায় প্রোটন-প্রোটন যত জোরে ধাক্কায় লিপ্ত হত, এই দ্বিতীয় দফায় সেই সংঘর্ষ হবে তার দ্বিগুণ জোরে। কতটা? দুটো মালবাহী ট্রেনের মুখোমুখি ধাক্কায় যতটা জোর থাকে, ততটা। প্রোটন কণা একরত্তি। ওজন নেই বললেই চলে। তার সংঘর্ষে এতখানি ধুন্ধুমার? এ ধাঁধার উত্তর দেবে বিজ্ঞান। এক, প্রোটন কণা একরত্তি হলে কী হবে, সে যে ছুটছে ভীম বেগে। দ্রুতগামী যে কোনও বস্তু, তা সে যত হালকাই হোক, অন্য বস্তুকে জোরে ধাক্কা দিতে পারে। দুই, আলবার্ট আইনস্টাইন দেখিয়েছেন, আলোর কাছাকাছি বেগে ছুটলে বস্তুর ভারী হওয়ার প্রবণতাও বাড়ে। মোট কথা, এই দ্বিতীয় দফায় এলএইচসি দ্বিগুণ ক্ষমতাবান। ঠাট্টা করে গবেষকরা তাই এখন ওই মেশিনকে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার-এর বদলে বলছেন ‘লার্জার হার্ডার কোলাইডার।’

ঘুমভাঙা দৈত্যকে দ্বিগুণ ক্ষমতাবান করার দরকারটা কী ছিল? দ্বিগুণ ক্ষমতাশালী এলএইচসি-তে এ বার শুরু হচ্ছে নতুন এক্সপেরিমেন্ট। বিজ্ঞানে পরীক্ষা জিনিসটা কী? চমৎকার বলেছেন বিজ্ঞান-লেখক জর্জ জনসন— এক্সপেরিমেন্ট আসলে একটা জিজ্ঞাসা। প্রকৃতির উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া। জানতে চাওয়া এটা-সেটা ধাঁধার সমাধান। রহস্যভেদ। দ্বিতীয় দফায় এলএইচসি-তে নতুন এক্সপেরিমেন্টও এই ব্রহ্মাণ্ডের পেল্লায় কতগুলো ধাঁধার সমাধান খুঁজতে।

একটা ধাঁধা একেবারে টিকি ধরে টান দেয় বাস্তব অস্তিত্বের। ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে আজ কেবল পদার্থ আর পদার্থ। ম্যাটার। কণা। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন। অথচ, এ-সব কিছু থাকার কথা নয়। বিজ্ঞানী পল অ্যাড্রিয়েন মরিস ডিরাক ১৯২৮ সালে তাত্ত্বিক গবেষণায় আবিষ্কার করেছিলেন এক সত্য। ইলেকট্রন, প্রোটন যেমন কণা, তেমন তাদের দোসর বা যমজ কণাও আছে। ইলেকট্রনের দোসর পজিট্রন। প্রোটনের দোসর অ্যান্টিপ্রোটন। কণা আর তার দোসরের ফারাক? ইলেকট্রন আর পজিট্রনে তফাত কিছু নেই, তফাত কেবল তড়িৎ বা চার্জে। ইলেকট্রন যদি নেগেটিভ চার্জ-বিশিষ্ট হয় তো পজিট্রন পজিটিভ চার্জওয়ালা। প্রোটন পজিটিভ। অ্যান্টিপ্রোটন নেগেটিভ। ডিরাক ও রকম কণার নাম দিলেন অ্যান্টিম্যাটার। ম্যাটারের উলটো। খাতায়-কলমে গণিতে যার অস্তিত্বের ইঙ্গিত মিলল, সে কি বাস্তবে সত্যি আছে? জবাব দিলেন বিজ্ঞানী কার্ল ডেভিড অ্যান্ডারসন। পরীক্ষায় শনাক্ত করলেন পজিট্রন। প্রমাণ হল, গণিত ভুল সংকেত দেয়নি ডিরাককে।

অ্যান্টিম্যাটার বারবার ঠাঁই পেয়েছে কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে। নানা কারণে। একটা কারণ বড় বিচিত্র। ম্যাটার আর অ্যান্টিম্যাটার ছোঁয়া লাগলেই বিস্ফোরণ। দুটোই নিশ্চিহ্ন। পড়ে থাকবে শুধু এনার্জি। এই ব্যাপারটাই আমদানি করা হয় গল্পে। ভিন্গ্রহের জীব এসেছে পৃথিবীতে। সেই ইটি-র দেহ অ্যান্টিম্যাটার কণা (পজিট্রন, অ্যান্টিপ্রোটন ইত্যাদি) দিয়ে গড়া। এ দিকে পৃথিবীর মানুষের দেহে ম্যাটার কণা (ইলেকট্রন, প্রোটন ইত্যাদি)। হ্যান্ডশেক করতে ইটি হাত বাড়াল মানুষের দিকে। হাতে হাত লাগতেই— দুম। দুজনেই ফিনিশ। গল্প হলেও বিজ্ঞান এ ক্ষেত্রে নির্ভুল। ম্যাটার আর অ্যান্টিম্যাটার মিশলেই ধ্বংস অনিবার্য।

বিজ্ঞানের এই নিয়ম থেকেই রহস্যের জন্ম। ১৩৮০ কোটি বছর আগে এক ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাবিস্ফোরণে জন্মায় এই ব্রহ্মাণ্ড। জন্মের পর তাতে শুধু জ্যোতি। ক্ষণ কাল পরে যখন সেই জ্যোতি থেকে ধীরে ধীরে আবির্ভাব ঘটছে কণার, তখন ঠিক যে পরিমাণে জন্মেছিল ইলেকট্রন প্রোটন, সেই পরিমাণেই এসেছিল পজিট্রন, অ্যান্টিপ্রোটন ইত্যাদি। ম্যাটার আর অ্যান্টিম্যাটারের কণাদের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়িতেও তখন বাধা ছিল না কোনও। তা হলে তো জন্মের পরই ও-সবের মুছে যাওয়ার কথা। আজকের ব্রহ্মাণ্ডে তো পদার্থ বলে কোনও কিছু থাকা উচিত নয়। তবু কোন জাদুমন্ত্রে আজ ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে শুধুই ম্যাটার? জন্মকালের অ্যান্টিম্যাটার সব গেল কোথায়? ব্রহ্মাণ্ডে থাকা উচিত ছিল ‘নাথিং’। তার বদলে কিনা এত কিছু! দার্শনিকদের বিখ্যাত প্রশ্নটা— হোয়াই দেয়ার ইজ সামথিং রাদার দ্যান নাথিং?— ম্যাটার-অ্যান্টিম্যাটার প্রসঙ্গে টানতেই হয়।

আর, তা হলে এটাও জানাতে হয় যে, ওই ধাঁধার সমাধান জোগাতে পারে এই দ্বিতীয় দফার এলএইচসি। প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষে মিলবে যে-সব কণা, তারা জোগাতে পারে ক্লু। জানা যেতে পারে, কোন মন্ত্রবলে অ্যান্টিম্যাটার হাপিশ করে টিকে গেল কেবল ম্যাটার।

ধাঁধা আছে আরও এক। তার পোশাকি নাম ‘ডার্ক ম্যাটার’। কী জিনিস? তা হলে বলতে হয় গ্যালাক্সির কথা। গ্যালাক্সিগুলো ঘুরছে লাট্টুর মতো। এত বেগে, ভাবলে ভিরমি খেতে হয়। আশ্চর্য, অত জোরে ঘুরেও কিন্তু গ্যালাক্সিরা অটুট। গ্র্যাভিটি গ্যালাক্সির মধ্যে নক্ষত্রদের আঁটোসাঁটো টেনে রাখার কাজ করে বটে, কিন্তু লাট্টুর ঘোরার যে স্পিড, তাতে গ্র্যাভিটির টান উপেক্ষা করে নক্ষত্রদের দিগ্বিদিকে ছিটকে পালানোর কথা। তা ঘটছে না কেন? বিজ্ঞানীদের অনুমান, ভেলকি দেখাচ্ছে অজানা পদার্থ। এমন ম্যাটার, যা চেনা যায়নি আজ পর্যন্ত। সে রকম পদার্থের গ্র্যাভিটি নাকি বাড়তি আকর্ষণ-বল জুগিয়ে আঁটোসাঁটো বেঁধে রেখেছে গ্যালাক্সিগুলোকে। ‘ডার্ক’ মানে এখানে অন্ধকারে ঢাকা, অচেনা। ডার্ক ম্যাটার নাকি ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের চেনা পদার্থের ছ’গুণ পরিমাণে উপস্থিত।

তেমন পদার্থ থাকতেই হবে। জানা আছে শুধু এটুকু। যা জানা নেই তা হল, সেই পদার্থ আসলে কী, কেমন তার কণার চরিত্র। তা যে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন চরিত্রের নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে জাতের হলে তো গত ৮০ বছরে (হ্যাঁ, অত কাল আগে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব অনুমান করা গেছে) অচেনা হয়ে পড়ে থাকত না তারা।

কী হতে পারে ডার্ক ম্যাটারের কণা, তা নিয়ে গবেষকদের জল্পনা বহু দিন ধরে জারি। কিন্তু জল্পনায় কী লাভ, যদি তাদের হাতেনাতে ধরে ফেলা না-ই যায়? একটা ব্যাপারে অনেকের অনুমানে মিল। ডার্ক ম্যাটারের কণারা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনের তুলনায় অবশ্যই অনেক বেশি ভারী। ভারী বলেই তাদের গ্র্যাভিটির টানও বেশি। ওই আকর্ষণ বেশি না হলে গ্যালাক্সিকে আঁটোসাঁটো বাঁধা যেত না।

ডার্ক ম্যাটারের কণা ভারী হতে পারে ভেবে অনেকের ধারণা, দ্বিগুণ শক্তিমান এলএইচসি-তে দেখা মিলবে তাদের। কেন? কারণ এই মেশিনে তো প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষ অনেক বেশি জোরদার। মানে তাতে বেশি এনার্জি উৎপাদন। এ দিকে আইনস্টাইন বলে গিয়েছেন, এনার্জি আর ভর হল একই পয়সার এ পিঠ-ও পিঠ। ভর থেকে এনার্জি মেলে, এনার্জি থেকে ভর। সুতরাং বেশি এনার্জি থেকে বেশি ভরের— মানে, বেশি ভারী— কণা জন্মাতে পারে। দ্বিতীয় দফা এলএইচসি-তে, অতএব, ডার্ক ম্যাটার কণার দেখা মিলতে পারে।

আরও এক রহস্যের কিনারা করতে পারে এই যন্ত্র। রহস্যটা কী, তা জানতে একটা ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট করুন। টেবিলে রাখুন কিছু আলপিন। এ বার তার সামান্য ওপরে ধরুন একটা চুম্বক। কী দেখবেন? আলপিনগুলো হাইজাম্প দিয়ে চুম্বকের গায়ে লেপটে যাচ্ছে। অবাক কাণ্ড! আপনি বলবেন, না। বিজ্ঞানী বলবেন, হ্যাঁ। কেন? কেন নয়? একরত্তি একটা চুম্বক আলপিনগুলোকে নিজের দিকে টেনে নিল। চৌম্বক শক্তি দিয়ে। অথচ টান তো আরও একটা ছিল। পৃথিবীর গ্র্যাভিটির। হায়, পেল্লায় পৃথিবী কিনা টাগ-অব-ওয়ারে হেরে গেল ছোট্ট একটা ম্যাগনেটের কাছে! গ্র্যাভিটি দুর্বল। চুম্বক পালোয়ান। কেন? বিজ্ঞানীর কাছে এও এক ধাঁধা। তিনি এর সমাধান জানেন না। জানেন শুধু এটুকু যে, এর অন্যথা হলে প্রলয়কাণ্ড ঘটে যেত। কী রকম? গ্র্যাভিটি পালোয়ান হলে এক একটা নক্ষত্র হাজার লক্ষ কোটি বছর বাঁচত না। গ্র্যাভিটির টানে চটপট বনে যেত ব্ল্যাক হোল। নক্ষত্রের আয়ু দীর্ঘ বলেই তার চারপাশে টিকে থাকে গ্রহ। আর সেখানে আসতে পারে প্রাণ। নক্ষত্র যদি মরত জন্মের পর পরই, তা হলে কোথায় গ্রহ, কোথায় প্রাণ? গ্র্যাভিটি কেন দুর্বল, তার ব্যাখ্যাও নাকি মিলবে নতুন এলএইচসি-র সংঘর্ষে জাত কণা থেকে।

বড় বড় সব ধাঁধা সমাধান করবে কি নতুন এলএইচসি? তার সাফল্যের দিকে চরম উৎসাহী দৃষ্টি গবেষকদের। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেঞ্জামিন আলানাখ বলেছেন, ‘যদি সফল হয় নতুন এলএইচসি, ভূমিকম্প হবে বিজ্ঞানের দুনিয়ায়। আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে নাচব।’ আর যদি পেশিশক্তি বাড়িয়েও ব্যর্থ হয় নতুন মেশিন? সেই সম্ভাবনার কথা ভেবে মুষড়ে পড়েছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও এক বিজ্ঞানী ডেভিড টং। বলেছেন, ‘তা হলে গভীর বিষাদ নেমে আসবে পদার্থবিদ্যায়। মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসি যে শাস্ত্রটাকে, তাতে যবনিকা পড়ে যাবে।’

সবাই অবশ্য টং-এর মতো নৈরাশ্যবাদী নন। তাঁরা তাকিয়ে আছেন নতুন জায়গায় নতুন— এবং অবশ্যই অনেক বেশি শক্তিশালী— কোলাইডার মেশিন বানানোর দিকে। কিন্তু, সে সব তো এখন কেবল প্রস্তাবের পর্যায়ে। বড় যন্ত্র বানাতে চাই বেশি অর্থ। তা আসবে কোথা থেকে? কেউ জানে না। নতুন এলএইচসি ব্যর্থ হলে বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টাররা হয়তো অর্থব্যয়ের রাজসূয় যজ্ঞ থেকে হাত গুটিয়ে নেবেন। ব্রহ্মাণ্ডের বড় বড় রহস্য সমাধান তখন হয়তো গবেষকদের কাছে অধরা স্বপ্নই থাকবে চিরকাল।

বিজ্ঞানের চোখে এই ক্ষমতাবান এলএইচসি, সুতরাং, জীবন-মরণের প্রশ্ন। এসপার নয় ওসপার। নাউ অর নেভার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE