Advertisement
১৯ মার্চ ২০২৪

বুকের দুধের আইসক্রিম

বিক্রি হচ্ছে ইংল্যান্ডে। বিতর্কও চলছে খুব। এমনিতেই অনলাইন-এ, মানুষ-মায়ের বুকের দুধ বেশ হইহই বিক্রির আইটেম।এক স্কুপ আইসক্রিম। হ্যাঁ আইসক্রিমই তো! চামচে আলো করে বসে আছে সেই হদ্দচেনা আধা গলা-আধা জমাটবাঁধা তুলতুলে আদুরে জিনিসটা। সেই নিয়েই নাকি গোটা লন্ডনে মহা ফিসফিস! আসলে আইসক্রিমের রেসিপি-টা এক গদাম ঘুষি কষিয়েছে তামাম রক্ষণশীলকুলকে। কারণ, সেখানে ভ্যানিলার সঙ্গে, চমৎকার জুটি বেঁধে রয়েছে বিশুদ্ধ এবং একশো শতাংশ মাতৃদুগ্ধ।

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৫ ০১:৪২
Share: Save:

এক স্কুপ আইসক্রিম। হ্যাঁ আইসক্রিমই তো! চামচে আলো করে বসে আছে সেই হদ্দচেনা আধা গলা-আধা জমাটবাঁধা তুলতুলে আদুরে জিনিসটা। সেই নিয়েই নাকি গোটা লন্ডনে মহা ফিসফিস! আসলে আইসক্রিমের রেসিপি-টা এক গদাম ঘুষি কষিয়েছে তামাম রক্ষণশীলকুলকে। কারণ, সেখানে ভ্যানিলার সঙ্গে, চমৎকার জুটি বেঁধে রয়েছে বিশুদ্ধ এবং একশো শতাংশ মাতৃদুগ্ধ। মানে, মানুষ-মায়ের বুকের দুধ! লন্ডনের এক আইসক্রিম-নির্মাতা কোম্পানি ‘দ্য লিক্‌টেটরস’ এবং স্তন্যপান বিষয়ে আন্দোলনকারী ভিক্টোরিয়া হিলে-র যৌথ উদ্যোগে আইসক্রিমের এই রাজকীয় সংস্করণটি বাজারে পা রাখল এই ২৫ এপ্রিল। ‘রাজকীয়’ তো বটেই। লন্ডন এখন বিভোর যার জন্মের অপেক্ষায়, সে হল প্রিন্স উইলিয়াম ও কেট মিড‌্লটন-এর দ্বিতীয় সন্তান। হিলে ঠিক এই সময়টাই বেছে নিলেন ‘রয়্যাল বেবি গাগা’ নামে এই আইসক্রিমের সঙ্গে আমজনতার আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য। এর মাধ্যমে নাকি সমস্ত মা’কে তিনি মনে করিয়ে দিতে চাইছেন বুকের দুধ খাওয়ানোর উপকারিতার কথা। সঙ্গে এটাও জুড়ছেন, এমন অমৃত-স্বাদ আর কিচ্ছুতে মেলে না।

কনসেপ্টটা অবশ্য একেবারেই নতুন নয়। চার বছর আগেও এ জিনিস এক বার বাজারে মুখ দেখিয়েছিল। সৌজন্যে সেই ভিক্টোরিয়া হিলে। আবার, লন্ডনের ‘আইসক্রিমিস্ট’-এর আইসক্রিমওয়ালা ম্যাট ও’কনর-এর মাথাতেও তখন আইসক্রিম নিয়ে একদম
নতুন কিছু করার একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। এই অ্যাত্তগুলো বছরে আইসক্রিম নিয়ে তেমন তো কিছু হয়নি— ভাবছিলেন তিনি। আর এই ভাবনাটাই একদম খাপে খাপে মিলে গিয়েছিল হিলের সঙ্গে। ফলে জন্ম হল ‘বেবি গাগা’র। তিরিশ আউন্স মতো দুধের জোগান ভিক্টোরিয়াই দিলেন (তাঁর নিজের বুকের দুধ, তখন তিনি সবে মা হয়েছেন), যা দিয়ে প্রায় জনাপঞ্চাশেকের আইসক্রিম বানানো যায়। কিন্তু ১৪ পাউন্ড দামের সেই আইসক্রিম যখন বেশ রমরম করে বিকোচ্ছে ক্রেতাদের মধ্যে, ঠিক সেই সময়ই এল কোপ। ও’কনরকে আদেশ করা হল, তিনি যেন তাঁর দোকানের সমস্ত মায়ের-দুধে-তৈরি পণ্য বন্ধ করে দেন। কারণ হিসেবে বলা হল ওয়েস্টমিনস্টার কাউন্সিল-এর কাছে জমা পড়া অভিযোগের কথা।

তা ছাড়া মার্কিন পপ তারকা লেডি গাগা-ও তখন বিস্তর চটেছেন। আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দিচ্ছেন। একে তাঁর নামেই আইসক্রিম। তার ওপর পুরো ব্যাপারটাই তাঁর কাছে রীতিমতো ‘ওয়াক-তোলা’। চাপে পড়ে সে আইসক্রিম তখন বন্ধ হল ঠিকই, কিন্তু হিলে দমলেন না। অনেক মেয়ের অকুণ্ঠ সমর্থন তাঁর পিছনে। গুটিকয়েক নাক-উঁচু, খুঁতখুঁতে রাজনীতিকের তোয়াক্কা করলে তাঁর চলে না কি? বরং ফলাও করে এ বার জানানো হল যে, ‘দ্য লিক্‌টেটরস ডট কম’ সাইটে ঢুকে দিব্যি অনলাইনে অর্ডার করা যাবে এটি।

অনলাইনে শুধু আইসক্রিমই নয়, সরাসরি বুকের দুধও কেনাবেচা করা যায়। আরও ভাল করে বলতে গেলে, অনলাইনে বহু রকম পণ্যের মধ্যে, মানুষ-মায়ের বুকের দুধ একটি রীতিমত পণ্য। যে সব মায়ের বুকের দুধ উদ্বৃত্ত, খুদের ছোট্ট পেটটুকু ভরার পরও প্রচুর দুধ জমা করা যায় স্টেরিলাইজ্ড কন্টেনার বা জিপ-লক ব্যাগে, তাঁরা চাইলেই সেই দুধ বেচে রোজগার করতে পারেন।

বাড়তি দুধের ঝামেলা পুরোটাই পোয়াতে হয় মায়েদের। সময়মত পাম্প করে বের করে না ফেললে মায়ের শরীরে ভয়ানক সংক্রমণ থাবা বসাতে পারে। তার পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাড়তি দুধের ঠাঁই হয় নর্দমায় অথবা ঠেসেগেদে ঢোকানো হয় প্রবল অনিচ্ছুক কচিটার পেটে। বিদেশে অনেক মা তাই নিজেদের মতো করে একখানা ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। জাস্ট বেচে দাও। কিছু পয়সাও হাতে আসবে, আবার মায়ের দুধ না-পাওয়া আরও কিছু এক-দুই-তিন মাসের প্রয়োজন মিটবে।

‘ওনলি দ্য ব্রেস্ট’ এমনই এক জনপ্রিয় সাইট। এই সাইট-এ, কোথাও পাবেন মা এবং তাঁর গাবলাগোবলা ছানার ছবি, সঙ্গে কতখানি দুধ বেচার জন্য মিলবে, তার পরিমাণ। কেউ আবার যত্ন করে ছবি তুলে পোস্ট করেছেন: ফ্রিজারে রাখা, পাম্প করে বের করে নেওয়া দুধের সারি সারি বোতলের। কেউ
তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন নিজের দুধের খাঁটিত্বর সার্টিফিকেট (কোন কোন রোগের নামগন্ধ নেই মোটেই), কেউ আবার দিয়েছেন নিজের খাওয়াদাওয়ার ফিরিস্তি, কী প্রবল স্বাস্থ্যকর বা অরগ্যানিক খাবার খেয়ে থাকেন তিনি সপ্তাহের সাত দিনই, আবার নিয়মিত কোনও ওষুধপত্তর খেলে উল্লেখ রয়েছে তারও। সঙ্গে কখনও দুর্দান্ত ক্যাচলাইন— ‘রিচ, ক্রিমি ব্রেস্টমিল্ক!’, ‘ফ্রেশ অ্যান্ড ফ্যাটি!’ এ বার ফেলো কড়ি মাখো তেল। জমানো চাইছেন, না তাজা— প্রয়োজন অনুযায়ী বেছেবুছে যোগাযোগ করে নিলেই হল। কেউ ছ’শো, কেউ হাজার, কেউ বা পুরো আড়াই হাজার আউন্স দুধ বেচার জন্য মজুত করেছেন। ‘ওনলি দ্য ব্রেস্ট’-এ প্রতি আউন্স-এর দাম ঘোরাঘুরি করে এক থেকে আড়াই ডলারের মধ্যে। লাভের অংকটা এ বার হিসেব করে নিন।

আবার ‘হিউম্যান মিল্ক ফর হিউম্যান বেবিজ’-এর মতো কিছু সাইট, বলা যায় ‘আদর্শবাদী’— টাকার বিনিময়ে মানুষের দুধ বেচার এই প্রবণতার ভয়ানক বিরোধী। সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে তারা হাজার হাজার মায়েদের মধ্যে এমন একটা যোগসূত্র বুনে দিয়েছে, যাতে নতুন মায়েরা তাদের প্রয়োজনে অন্য মায়ের দুধ সহজেই হাতে পান। এবং অবশ্যই বিনামূল্যে।

এ ছাড়াও রয়েছে মিল্ক ব্যাংক। এরা সাধারণত হাসপাতালে দুধের জোগান দেয়। কখনও আবার অসুস্থ বা প্রিম্যাচিয়োর শিশুদের বাবা-মায়ের হাতেও আউন্স প্রতি চার ডলারে দুধ তুলে দেয়। মিল্ক ব্যাংকগুলো যখন প্রথম তৈরি হয়েছিল, তখন তারাও দুধের বিনিময়ে টাকা দিত। কিন্তু পরের দিকে দেখা গেল, টাকার লোভে, মায়েরা দিব্যি তাঁদের দুধের সঙ্গে গরুর দুধ মিলিয়ে দিচ্ছেন। ফলে বিশ শতকের গোড়ার দিকেই এই রেওয়াজ বন্ধ হয়ে এখন শুধুমাত্র দান-করা দুধেই ব্যাংকগুলো চলে।

তবে মূল্যের বিনিময়েই হোক বা বিনামূল্যে— বুকের দুধের চাহিদা বিশাল এব‌ং দিনে দিনে তা বেড়েই চলেছে। কিছু বছর আগে অবধিও একটা ধারণা ভালমত চেপে বসেছিল মায়েদের মধ্যে— অনেক দিন ধরে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের সুঠাম চেহারা রাতারাতি কুচ্ছিত হয়ে পড়ে। কিন্তু তুমুল সরকারি প্রচার আর মায়েদের ব্রেস্ট ক্যানসারের জমজমে ভয় সে সব ধারণাকে হুশ করে তাড়িয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, সন্তানের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে সমঝোতা করা চলে না মোটেই। আর মায়ের দুধই যে ইমিউনিটির শেষ কথা, এ তো একরত্তি খুদেটাও অ্যাদ্দিনে জেনে গিয়েছে। এখন বেসরকারি অফিসেও তাই কুড়িয়েবাড়িয়ে ছুটি জমিয়ে মায়েরা ছ’মাস সন্তানকে ‘এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং’-এর আশ্বাস দিতে ব্যস্ত। বাইরে বেরোতে বাধ্য হওয়া মায়েরাও এখন জানেন, হ্যান্ড পাম্প মেশিনের সাহায্যে দুধ বের করে প্রায় ২৪ ঘণ্টা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু যে শিশুরা জন্মের পরই নিজের মায়ের দুধ খেতে পায় না? ‘ফরমুলা মিল্ক’, মানে শিশুদের জন্য তৈরি কৃত্রিম দুধ তো চটজলদি সমাধান। কিন্তু মানুষের দুধের জোগানই যদি বিকল্প হিসেবে হাতের কাছে পাওয়া যায়? ওই যে, সবার উপরে ইমিউনিটি সত্য। ফলে মার্কেট-ও এগোল তরতরিয়ে।

ডেসিরি এসপিনোজা-র কথাই ধরা যাক। এই বাজারে যখন তিনি পা রাখেন, তখন তাঁর পাম্প করা দুধের পরিমাণ ট্রিপলেট-এর চাহিদার সমান। অথচ, সন্তান মোটে একটি। অন্য দিকে, টেবিল-জুড়ে না-মেটানো বিল থইথই। গোড়ার দিকে তিনি মোটেই জানতেন না যে বুকের দুধও বিক্রি করা যেতে পারে! এও জানতেন না, এ জিনিসে আইনের কোনও নিষেধ-টিষেধ আছে কি না। কিন্তু ইন্টারনেট খুঁড়তেই তিনি সন্ধান পেলেন এক সাইটের। এরই মাধ্যমে আশপাশের অঞ্চলে আউন্স-প্রতি দু’ডলার দরে দুধ বেচতে আরম্ভ করেন ডেসিরি। লাভের টাকায় তিনি একখানি ল্যাপটপ কিনেছেন, আর ধারদেনাও মিটিয়ে দিয়েছেন অনেকটাই। তাঁর তুষ্ট ক্লায়েন্ট তালিকায় এক জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষও ছিলেন। তিনি দাবি করেছেন, তাঁর রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতার কিছু জটিল সমস্যা হচ্ছিল, যা বুকের দুধই সারিয়ে দিয়েছে।

তবে বাজারে যে জিনিসের চাহিদা যত বাড়ে, তাকে ঘিরে ঝুটঝামেলাও লকলকিয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হয়েছে। ‘পেডিয়াট্রিক্স’ নামে এক জার্নাল জানাচ্ছে যে, ইন্টারনেটে খরিদ করা ব্রেস্টমিল্ক-এর প্রায় দশ শতাংশই হয় গরুর দুধ, নয়তো পাতি ‘ফরমুলা মিল্ক’। অনেক বিশেষজ্ঞই শিশুর এক বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত গরুর দুধকে মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। তাঁদের মতে, একে তো এতে আয়রন তেমন থাকে না, তার ওপর প্রোটিন আর মিনারেল এত বেশি থাকে যে, শিশুর পক্ষে হজম করা বেজায় সমস্যার।

তা ছাড়া আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স গরুর দুধ থেকে শিশুর অ্যালার্জির সম্ভাবনাও মনে করিয়ে দিয়েছে। এরা ভীষণ ভাবে ব্রেস্টফিডিংয়ের পক্ষে। তাই তারা বার বার সাবধান করছে— ইন্টারনেটে অর্ডার করা জিনিসটাকে দুধের মতো দেখতে মানে এই নয় যে, ওটাই সত্যিকারের বুকের দুধ। ব্রিটিশ মেডিকাল জার্নাল-এর সম্পাদকীয়তেও এই সতর্কবাণী লেখা হয়: অনলাইনে বিক্রি হওয়া ব্রেস্টমিল্ক-কে খুব ভাল ভাবে পরীক্ষা করা উচিত, যাতে এতে হেপাটাইটিস, এইচআইভি বা সিফিলিস-এর মতো রোগজীবাণু না থাকে।

তার ওপর রয়েছে উপযুক্ত সংরক্ষণের প্রশ্ন। ফ্রিজে রাখা দুধকে ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার সময়টুকুতে সাবধান না হলে তাপমাত্রার এ দিক-ও দিক হওয়ার প্রচণ্ড সম্ভাবনা। আক্ষরিক অর্থে জন্মানোর জন্য ব্যাকটিরিয়াকে খোলা ময়দান ছেড়ে দেওয়া। গবেষণা বলছে, এর জমাট বাঁধা (ফ্রোজেন) সংস্করণটির প্রায় বাহাত্তর শতাংশের মধ্যেই মিলেছে এমন ব্যাকটিরিয়া, যারা সংক্রমণ ঘটাতে পারে। আর একুশ শতাংশের মধ্যে সন্ধান মিলেছে এমন ভাইরাসের, যারা রীতিমত ক্ষতিকর।

কিন্তু এ হেন সাবধানবাণীতেও চিঁড়ে ভিজছে কই! মিল্ক ব্যাংকগুলোয় পাস্তুরাইজ্ড দুধ পাওয়া যায়। কিন্তু তার দাম বিস্তর। ফলে অপেক্ষাকৃত সস্তায় এই অনিয়ন্ত্রিত সাইটগুলো থেকে কেনার হিড়িক এত সহজে বন্ধ হওয়ার নয়। তার ওপর আবার যে-মায়েরা নিজের দুধ কোনও টাকাপয়সার লেনদেন ছাড়াই দান করতে প্রস্তুত, তাঁরা মিল্ক ব্যাংকগুলোতে দেওয়ার বদলে সরাসরি গ্রহীতার হাতেই সেটা তুলে দিতে বেশি আগ্রহী। কারণ তাঁদের ডোনেট করা দুধই যে ব্যাংকগুলো প্রচুর দামে ওই মায়েদের হাতেই তুলে দেবে। ফলে, দাতার অভাবে মিল্ক ব্যাংকগুলো ধুঁকছে। হুড়মুড়িয়ে বাড়তে থাকা চাহিদার মুখে পড়ে প্রয়োজন মতো দুধের জোগান দিয়ে উঠতে পারছে না তারা।

অন্য দিকে, অনলাইনে হইহই করে বাড়ছে ক্রেতার সংখ্যা। ঠিকঠাক পরীক্ষা, সংরক্ষণ কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই দেদার বিকোচ্ছে বুকের দুধ। আর বিশেষজ্ঞরা আঁতকে উঠছেন ওই ছোট্ট শরীরগুলোর কথা ভেবে, যাদের কোনও প্রতিরোধ-ক্ষমতাই ঠিকঠাক গড়ে ওঠেনি। অনেকেরই বক্তব্য, এ বাজারকে এক্ষুনি না নিয়ন্ত্রণ করলে অনেক শিশুর অসুস্থতা বা মৃত্যু কেউ আটকাতে পারবে না। বিক্রেতা মা’দের মধ্যে নাকি অনেকেই আছেন, যাঁরা নিয়মিত শিরায় ড্রাগ ইঞ্জেকশন নেন।

আর এই গোটা ব্যাপারটার জন্যই দায়ী মাতৃদুগ্ধকে ঘিরে ঘুরপাক খেয়ে চলা কিছু আজব ধারণা। যেমন, অনেকেই মনে করেন যে, স্তনদুগ্ধ অন্য মায়ের সন্তানকে খাওয়ানো হলেও এতে কোনও বিপদ থাকতে পারে না। এ ধারণা আমাদের চেনা। ধনী পরিবারে একটা সময় এর প্রচলন ভাল মতোই ছিল। এই দুধ-মা’দের কথা মহাশ্বেতা দেবীর ‘স্তনদায়িনী’তেও পাওয়া যায়। কিন্তু অস্টিন-এর মিল্ক ব্যাংক-এর ডিরেক্টর জানাচ্ছেন যে, এর ঝুঁকি সাংঘাতিক। আসলে তো স্তনদুগ্ধ এক রকম শরীর নিঃসৃত তরল (বডি ফ্লুইড)। আমরা কি কখনও নিজের শিরা কেটেই সেই রক্ত সরাসরি অন্যকে দিতে পারি? নিজের সন্তানের পুষ্টির জন্য যতটুকু প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল-সমেত যা যা লাগে, সেই পরিমাণটুকু যেন দাঁড়িপাল্লায় মেপে নিয়েই দুধ তৈরি হয় মায়ের শরীরে। সেই প্রয়োজন অন্য খুদেটির প্রয়োজনের সঙ্গে তালমিল ঘটাবে কী করে? যে ইমিউনিটির জন্য এত প্রচার, এত তোড়জোড়, অন্য মায়ের দুধেও একই ইমিউনিটি খুঁজে পাওয়া যাবে তো? স্পষ্ট উত্তর জানা নেই।

তা ছাড়া মায়ের দুধে বৈজ্ঞানিক উপাদান ছাড়াও শিশুর সঙ্গে তার মায়ের যে মানসিক যোগাযোগের সুতোটা লুকিয়ে থাকে, সেটা অন্য মায়ের দুধে মিলবে কী করে? সেই সম্পর্ক তো এতটাই গভীর যে, সন্তানের কান্নায় মায়ের দুধ ঝরে টুপটাপ। বুকের দুধ তো নেহাতই প্রয়োজনের নয়, এটা ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’। বোতলবন্দি দুধে কিন্তু সে বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয় না।

ব্রেস্টমিল্কের খদ্দেরদের লিস্টে শুধু শিশুর বাবা-মায়েরাই নেই। ক্যানসার-রোগীরাও আছেন। তাঁদের বিশ্বাস, এ জিনিস স্বাস্থ্যগুণে ভরপুর। শরীরচর্চা নিয়ে অতি-উৎসাহীদের একাংশ আবার ইতিমধ্যেই বুকের দুধকে ‘সুপার ফুড’ বলে দাগিয়ে বসে আছেন। যে কোনও খাবার বা পানীয়ের থেকেও এই জিনিসটি শরীরকে অনেক বেশি এনার্জি দেয়, সম্প্রতি ‘নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিন’-এ জানিয়েছেন এমনই এক জন। এর ভেতরেও যে ব্যাকটিরিয়া দিব্যি বাসা বানাতে পারে, সে ধারণা থেকে এই সব মানুষরা বহু দূরে। মায়ের দুধ প্রথম ছ’মাস শিশুদের বাড়বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন, বেড়ে-ওঠাদের জন্য নয় মোটেই।

বরং এক লেখক, সারা স্টিলে, এই তৃতীয় শ্রেণিটিকে স্রেফ ‘কামতাড়িত’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, এঁরা আসলে চান, শিশুদের মতোই এঁদের খাওয়ানো হোক। সে বোতল থেকেই হোক বা সরাসরি উৎস থেকে। সোজা কথা, এঁদের কাছে স্তন্য আসছে স্তনের অনুষঙ্গ নিয়ে, তাই এঁদের এত উত্তেজনা ও উৎসাহ।

আসলে ব্রেস্টফিডিংয়ের পুরো বিষয়টি নিয়েই যুক্তির চেয়ে উন্মাদনার বহরটা অনেক বেশি। মায়ের দুধ শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে সবচেয়ে সেরা অবশ্যই, কিন্তু তার অভাবে যাবতীয় বিকল্পকে ঝটকায় সরিয়ে ব্যাকটিরিয়া-গজগজে দুধ কেনার জন্য অনলাইনে হত্যে দিয়ে বসে থাকাটা এক ধরনের উদ্ভট মানসিকতা। অনেক ডাক্তারই যেমন ‘এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং’-এর ধারণাকে মিথ বলে মনে করেন। মায়ের দুধ বাচ্চার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে সে ক্ষেত্রে ফরমুলা শুরু করা ছাড়া উপায় থাকে না। মার্কিন অ্যাকাডেমিক জোয়ান বি উল‌্ফ যেমন বুকের দুধ খাওয়ার পুরো ব্যাপারটিকেই অতিরঞ্জন বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, বেশির ভাগ গবেষণাই বলে যে, স্তনদুগ্ধ আর সুস্বাস্থ্যের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু এ সম্পর্কটাই কার্যকারণের সম্পর্ক কি না, সেটা এখনও প্রতিষ্ঠিত নয়। তা ছাড়াও উল্‌ফ বলছেন, এই যে দাবি করা হয়, মায়ের দুধ খেলে কানের সংক্রমণ, শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত অসুখ বা ডায়াবিটিস-এর সম্ভাবনা কমে যায়, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। বুকের দুধ খাওয়ালে মায়েদের ক্যানসারের সম্ভাবনা কমে, এই ধারণার সঙ্গেও তিনি একমত নন।

আবার, নারীবাদীদের একাংশ দুধ খাওয়ানোর মধ্যে ফেমিনিজ্ম-এর জয় দেখলেও (কারণ এ দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে, বাবার সাহায্য ছাড়াও দিব্যি সন্তানপালন করা যায়), কেউ কেউ বুকের দুধ খাওয়ানোর পুরো পদ্ধতিটার বিষয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। তাঁদের মতে, এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং-এর অজুহাতে মেয়েদের ছ’মাস বাড়িতে বন্ধ রাখাটা একেবারেই পুরুষতান্ত্রিক ভাবনাচিন্তার ফসল।

আবার ফরাসি নারীবাদী এলিজাবেথ বাদাঁতে একটা সম্পূর্ণ অন্য দিকে আঙুল তুলেছেন। তাঁর মতে, শিশুর জন্মের পর কিছু সপ্তাহ বা কিছু মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানো ঠিক আছে। কিন্তু ছ’মাস বা এক বছর ধরে অন্য কিচ্ছু না দিয়ে শুধুই বুকের দুধ খাইয়ে গেলে স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কে প্রভাব পড়তে বাধ্য। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, চব্বিশ ঘণ্টা যদি এক জন মা’কে তাঁর সন্তান লালনপালনের ভার নিতে হয়, তার ওপর রাতেও স্বামী-স্ত্রী’র মাঝে সন্তানকে রেখে শুতে হয়, তা হলে বাবাটি তো একেবারেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। সুতরাং, স্বামী-স্ত্রীর ছাড়াছাড়ির একটা প্রধান কারণই হয়ে দাঁড়াবে শিশুটি।

বুকের দুধের প্রয়োজনের পক্ষে দিন কে দিন আরও আরও যুক্তি জমা পড়বে। প্রতিযুক্তিও পাশাপাশি থাকবেই। কেউ কেউ নৈতিক প্রশ্নও তুলবেন। অনেকে ব্যাপারটা শুনেই নাক কুঁচকোবেন, কারণ যে কোনও ‘ব্যক্তিগত’ ব্যঞ্জনা থাকা জিনিস কোনও ভাবে বাণিজ্য-সম্ভাবনা পেলেই তাঁরা আঁতকে ওঠেন। আবার, বাচ্চার স্বাস্থ্য নিয়ে মায়েদের রক্তচাপের বাড়বাড়ন্তও বহাল তবিয়তে থাকবে। একই সঙ্গে, বাজারের ধর্মে, নানা নতুন পণ্যও আসবে এই ‘কাঁচামাল’ ব্যবহার করে। এঁরা সবাই বরং ঠিকঠাক সাইটে খানিক খোঁজাখুঁজি করতে পারেন। বাড়ি বসে বুকের দুধের আইসক্রিমের খাসা সব রেসিপির সুলুকসন্ধান পাওয়া যাবে যেখানে। স্ট্রেস-বাস্টার হিসেবে মন্দ কী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE