Advertisement
০৯ মে ২০২৪

কলকাতার পাগল

মানিকতলার এক পাগলের ব্যাগে থাকে দু-দুটো এটিএম কার্ড, হোটেলে খেয়ে সে পাইপয়সা মিটিয়ে দেয়। কালীঘাটের এক পাগল মন্দির চত্বর ঝাঁট দিয়ে, বিবেকানন্দ বিষয়ে বক্তৃতা শুরু করে। মানিকতলা স্ট্রিটের দুর্গা মন্দিরের সামনে তাকে দেখা যায় মাঝে মধ্যেই। লম্বা দোহারা চেহারা। গালভর্তি ঘন দাড়ি। মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। গায়ের জামাকাপড় মোটামুটি পরিষ্কার। সঙ্গে এক ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র। কথা হচ্ছিল দুর্গা মন্দিরের দারোয়ান বিশুর সঙ্গে, ‘ওকে লোকে লম্বু বলেই ডাকে।

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

অময় দেব রায়
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

মানিকতলা স্ট্রিটের দুর্গা মন্দিরের সামনে তাকে দেখা যায় মাঝে মধ্যেই। লম্বা দোহারা চেহারা। গালভর্তি ঘন দাড়ি। মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। গায়ের জামাকাপড় মোটামুটি পরিষ্কার। সঙ্গে এক ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র। কথা হচ্ছিল দুর্গা মন্দিরের দারোয়ান বিশুর সঙ্গে, ‘ওকে লোকে লম্বু বলেই ডাকে। দুপুরের দিকে মাঝেমধ্যে মন্দিরের আশপাশে এসে বসে। একটা খাতা বের করে কী সব লিখে যায়। শুনেছি বড় ঘরের ছেলে। বেশি পড়ালেখা করতে গিয়েই এখন এই দশা!’ লম্বুকে হাতের কাছে পেয়ে বিনীত কণ্ঠে কথা বলার আর্জি জানিয়েছিলাম। যা উত্তর এল, বিস্ময়কর! কিছু ক্ষণ চুপচাপ থাকার পর রীতিমত গর্জে উঠল, ইংরেজিতে নয়, হিন্দিতে, ‘বহুত সারে লোগ পড় পড় কে মার খা রহে হ্যায়। হম কোই ব্লাড-সাকার সে বাত নেহি করতে... গন্দে নালি কে কীট!’ তার পর খানিক বিরতি দিয়ে আচমকা গলার স্বর চড়িয়ে রীতিমত ধমকের সুরে, ‘পানিস্ট... ইউ পানিস্ট!’ পিলে চমকানো চিৎকার! বুঝলাম, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। নির্ঘাত আমাকে পানিশ করতেই চাইছে!

হেদুয়া থেকে কলেজ স্ট্রিট যাতায়াতের পথে আরও বেশ কয়েক বার দেখা হল লম্বুর সঙ্গে। মাথা নিচু করে হাঁটছে আর অনর্গল বকে যাচ্ছে নিজের মনে। বিড়বিড়িয়ে বকতে বকতে হঠাৎ তারস্বরে চিৎকার। সে চিৎকারে পথচলতি মানুষের হৃদ্‌যন্ত্রে কাঁপুনি ধরে যেতে বাধ্য। ওতেই নাকি মজা পায় লম্বু। তবে পাগল হলে কী হবে, সে যথেষ্ট ডিসিপ্লিন্‌ড। প্রতি দিন স্নান, জামা বদলানো, পেট পুরে খাওয়া তার দৈনিক রুটিনের মধ্যে পড়ে। আর সবচেয়ে আশ্চর্য, দয়া-দাক্ষিণ্য লম্বুর একেবারে না-পসন্দ। সে পাইস হোটেলে খাবার খায় রীতিমত দাম দিয়ে! তার ঝোলায় বেশ কয়েকটি জামাকাপড়, গামছা, চিরুনি, দু-তিনটে লাইন-টানা খাতা, একটা ডায়েরি এবং, না— মুচ্ছো যাবেন না— দু-দুটি এটিএম কার্ড! তাতে নাকি ব্যাংক ব্যালান্সও যথেষ্ট ভাল। বিশুর কথায়, ‘পাগল হলে হও লম্বুর মতো, নিজের পয়সায় খাওদাও, ফুটানি মারো, আর যত খুশি পাগলামি করো।’

আর একটু এগিয়ে কাছেই হেদুয়ায় দেখা মিলবে পঞ্চি পাগলির। তার আবার উলটো ধরন। মাথায় জটা, হলদে ময়লা শাড়ি, চোখের কোণে পিচুটি, হাতে অজস্র সুতো বাঁধা। সঙ্গে এক ব্যাগ ভর্তি ইটের টুকরো। হেদুয়া পার্কের কাছাকাছি কোনও রাস্তার ধারে পঞ্চিকে ঠায় বসে থাকতে দেখা যায়। আর সারা ক্ষণ একটা ইটের টুকরোয় চলে তার আঁকিবুকি। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে একটাই উত্তর, ‘চল আগা, যা এখান থেকে! মেয়ে বাজিয়ে খুব দেমাক, না?’ শোনা যায় পঞ্চি নাকি বংশানুক্রমিক পাগল। পঞ্চির মা ফুলি ছিল সম্ভ্রান্ত ঘরের বউ, আবার পাড়ার বিখ্যাত পাগলি। টুকটুকে ফরসা, কপাল জুড়ে লেপটানো সিঁদুর। গলায় একটা লেবু-লংকার মালা ঝুলিয়ে রাস্তার এ-ধার থেকে ও-ধার ছুটে বেড়াত। পাড়ায় বেশ নামডাক ছিল ফুলির। যে কোনও বারোয়ারি অনুষ্ঠান বা পুজো, সবেতেই ডাক পড়ত। হঠাৎই এক বার রটে যায়, ফুলির অলৌকিক ক্ষমতা প্রাপ্তি ঘটেছে। অমনি দলে দলে পাড়ার মেয়ে-বউ ছেলে-ছোকরা জুটতে শুরু করে। মুহূর্তে ফুলি পাগলি থেকে সরাসরি ‘ফুলি মা’। মা মাথা ঝাঁকিয়ে, চুল এলিয়ে, গলায় ঝোলানো লেবু-লংকার মালা থেকে একখানি লেবু নিয়ে, যার দিকে ছুড়ে মারতেন, তারই নাকি কপাল যেত খুলে! রসিয়ে গল্প শোনাচ্ছিল হেদুয়া পার্ক সংলগ্ন চায়ের দোকানি লাঠিদা। ‘সে এক সময় ছিল বটে! ফুলির কী ডিমান্ড! ছুটির দিনগুলোতে রীতিমত ভিড় জমে যেত। আমাদের কাজ ছিল সবাইকে লাইন করে দাঁড় করানো, যাতে কোনও ঝামেলা না হয়। ফুলি যখন মরল, আমরা পাড়ার সবাই মিলে দল বেঁধে প্রসেশন করে শ্মশানে গিয়েছিলাম। শ্রাদ্ধ-শান্তিও হয়েছিল বিরাট ধুমধাম করে। খরচ করেছিলেন বড়বাজারের লালচাঁদ বাবু। ফুলির কৃপায় তাঁর নাকি ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছিল। আর তার মেয়ে পঞ্চিকে দেখুন! হল সেই পাগলি, কিন্তু না আছে সেই রূপ, না আছে দেমাক। আসলে সবই হল টাইমিং। টাইমিং ঠিক না হলে আপনার কিস্সু হবে না।’

গল্ফগ্রিন দূরদর্শন ভবনের আশেপাশেই থাকে পাগলা শ্যামল। মাথায় তামাটে রঙের ঝাঁকড়া চুল, ঢুলুঢুলু চোখ, সারা গায়ে দগদগে ঘা। ঠোঁটের কোণ বেয়ে অনবরত গড়িয়ে পড়ছে লালা। তাকে মাঝে মাঝে উদয়শঙ্কর সরণির এক কোণে দাঁড়িয়ে নিলাম হাঁকতে দেখা যায়। শতচ্ছিন্ন প্যান্টের পকেট থেকে ততোধিক দুর্দশাগ্রস্ত একটি পাঁচ টাকার নোট বের করে, হাত উঁচিয়ে ‘পাঁচ লাখ এক, পাঁচ লাখ দুই, পাঁচ লাখ তিন...’— এ ভাবে চলতে থাকে। খানিক বাদে দশ টাকার আর একটি নোট বের করে সেই এক ভঙ্গি। কিছু ক্ষণ এই চলার পর, মনগড়া কাউকে উদ্দেশ্য করে— ‘শ্যামলকে টাকার গরম! হ্যাঁ! শ্যামলকে! হাটে কিনে বাজারে বেচে দেব, পালিয়ে কূল পাবে না। এই বলে দিলাম।’ পাশেই চায়ের দোকানি হাবুদা জানাচ্ছিল, ‘ওই যে দেখছেন, ওই হল পাঁচ টাকা দশ টাকার পাগল।’ তার কাছ থেকেই জানা গেল, মাঝেমধ্যে পথ চলতি দু’-এক জনকে আটকে পাঁচ টাকা, দশ টাকা চায়। কেউই প্রায় দেয় না। কিন্তু কোনও সহৃদয় ব্যক্তি যদি হঠাৎ দয়া দেখিয়ে একটি পঞ্চাশ কিংবা একশো টাকার নোট বের করেন, তখনই ঘটে বিপত্তি। নির্ঘাত তার কপালে জুটবে পাগলা শ্যামলের ধমক— ‘টাকা কি গাছে ফলে? আমাকে নোট বের করে টাকা দেখাচ্ছে! শ্যামলকে টাকার গরম! হাটে কিনে বাজারে বেচে দেব, পালিয়ে কূল পাবে না!’ শোনা যায়, শ্যামল ছিল দক্ষিণ কলকাতার বড় ব্যবসায়ী। গাড়ি, বাড়ি সমস্তই ছিল। কোনও কারণে ব্যবসায় লস খেয়ে সর্বস্বান্ত হয়। ধীরে ধীরে এই অবস্থা! টাকা-পয়সা গাড়ি-বাড়ি সব গেছে, কিন্তু সেই ধমক এখনও যায়নি!

স্টার সিনেমা থেকে একটু এগিয়ে কাছেই রেলওয়ে টিকিট কাউন্টার, উলটো দিকে ন্যাপাদার ফুলের দোকান। পাশেই সোনাইয়ের লেডিজ বিউটি পার্লার। ওই চত্বরেই থাকে সুন্দরী। ওটা ডাকনাম। ভাল নাম বুলু। তবে শুধু বুলু বললে সুন্দরী বেজায় চটে যায়। শুধরে দেয়, ‘বুলু না, বুলু কুন্ডু।’ মাথায় প্রায় চুল নেই বললেই চলে, গায়ে হাতা-কাটা নাইটি। উচ্চতা খুব বেশি হলে চার ফুট। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। দন্তবিহীন চাপা-ভাঙা মুখ, কোঁচকানো চামড়া। বুলুর সাজগোজের খুব শখ। ঠোঁটে তার সব সময় লাল লিপস্টিকের পোঁচ। দু’কানে দু’ধরনের লম্বা ঝোলানো দুল নিয়ে রোজ বিকেল পাঁচটার মধ্যে ন্যাপাদার দোকানে বুলু হাজির। এক বালতি জল এনে দিয়ে তার আবদার, ‘দাও না গো একটা ফুলের মালা।’ ফুলের মালা নিয়ে কী করবে, জিজ্ঞাসা করলে লাজুক মুখ করে বুলু উত্তর দেয়, ‘কেন! খোঁপায় বাঁধব!’ আশপাশের দু-এক জন আওয়াজ দেয়— ‘ওরে সুন্দরী যে ন্যাড়া হতে চললি, সে হুঁশ আছে!’ বুলু ও-সব কথায় কান দেয় না। ন্যাপাদার থেকে একগাছি মালা নিয়ে সোজা চলে যায় সোনাইয়ের বিউটি পার্লারে। সেখানে গিয়ে শুরু হয় তার দাবি। ফেসপাউডার চাই, লিপস্টিক চাই, আই-লাইনার চাই। সোনাইয়ের কথায়, ‘হাত দু’খানা ধরে বলবে, ‘আমায় বউ সাজিয়ে দিবি রে?’ এক-এক দিন বলে ‘ওই দেখ না, ও পাড়ার চম্পাটারও বিয়ে হয়ে গেল। আমার কবে হবে?’ মাঝেমধ্যে খুব গুম হয়ে বসে থাকে। বোধহয় বিয়ে না হওয়ার জন্যে বড্ড কষ্ট হয়। শোনা যায়, বুলুর নাকি এক বার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের রাতেই বরের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের কবলে পড়ে। সেই শক বুলু নিতে পারেনি, তার পর থেকেই আস্তে আস্তে এই দশা।

কালীঘাট মন্দিরের পিছন দিকে মাদার টেরিজা মিশনারি। এখানেই দেখা পাওয়া যায় রতনের। গালে টোল, কোঁচকানো চামড়া, মাথায় চুলের লেশমাত্র নেই, বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। এক হাতে একটা ঝাঁটা, অন্য হাতে আগুনবিহীন বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে ভোরবেলায় হাজির। প্রথমে বেশ কিছু ক্ষণ মন্দির চত্বর ঝাঁট দিয়ে শুরু হয় মন্দির প্রদক্ষিণ। কোনও কোনও দিন তা সকাল সাতটায় শুরু হয়ে চলে বারোটা পর্যন্ত, কোনও দিন আবার এক পাকেই সাঙ্গ। যে দিন যেমন মুড। তার পর মন্দির চত্বরের সমস্ত ভিখিরিকে জড়ো করে গোল হয়ে বসে শুরু হয় উপদেশ বিতরণ। বেশির ভাগ দিনই তার আলোচনার বিষয় হয় বিবেকানন্দ অথবা মা কালী। মন্দিরের এক পুরোহিত কমল বসাকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, ‘ও কিন্তু অনেক কিছু জানে, কথা শুনলেই বোঝা যায় খুব বুদ্ধি ধরে। এমনিতে শান্ত। নিজের জগতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ-মটাৎ মন্দিরে পুজো দিতে আসা দু’-এক জন মহিলাকে নিজের বউ ঠাউরে বসে, তখনই ঘটে বিপদ! এক বার তো এক মহিলাকে ধরে রীতিমত টানাটানি। আর কিছুতেই ছাড়ে না! অনেক কষ্টে সে যাত্রায় তাকে থামানো হয়েছিল। অবশেষে জানা গেল, সত্যি-সত্যিই নাকি সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পাগলের! বোঝো ঠেলা! বউ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই নাকি সে পাগল। অনেকে আবার বলে, বউ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণও নাকি পাগলামি। সত্যি-মিথ্যে বোঝার উপায় আছে?’ মন্দিরে পুজো দিতে আসা দর্শনার্থী ধরতে ছুটলেন কমল বসাক।
রতন তখন সমস্ত ভিখিরিদের নিয়ে গোল হয়ে বসেছে— ‘বিবেকানন্দ তো অনেক হল, আজ শোনাব নিবেদিতার কথা...’

কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় বুড়ি বেশ বিখ্যাত পাগলি। বুক থেকে হাঁটু অবধি একখানা শাড়ি লুঙ্গির মতো করে জড়ানো। গলায় ওই শাড়িরই একটা অংশ উত্তরীয়ের মতো করে চাপানো। মাথায় কাঁচা-পাকা, উসকোখুসকো চুল। ভারী চেহারা। সারা গায়ে নোংরার পুরু স্তর। খালি পায়ে গোটা কলেজ স্ট্রিট চষে বেড়াচ্ছে। এক দিন বুড়ির দেখা মিলল ফেভারিট কেবিনের সামনে। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, দুটো রাধাবল্লভি আর একটি জামপাতা বিশেষ মুদ্রায় উঁচু করে ধরে, কোমর ঝাঁকিয়ে বুড়ির নাচ! আর এক দিন সাতসকালে পুঁটিরাম মিষ্টির দোকানে হাজির। টেবিল বাজিয়ে উচ্চ স্বরে শুরু হল গান। অনেক কষ্টে সে গানের কথা উদ্ধার করে যা পাওয়া গেল, অনেকটা এই রকম— ‘মাটিং মাটিং বুন বুন বুন/ ধিনতা নানা চাম উকুন।’ বেশ কিছু ক্ষণ এই দু’লাইনের রিপিটিশন চলল। তার পর এল অন্তরা— ‘ঘুম ঘুম ইষ্টি কুটুম/ চল তা না না দিল কুসুম।’ বুড়ি এক সময় সিটি কলেজ থেকে পাশ করে ওকালতি শুরু করে। হাইকোর্টে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করত নিয়মিত। জ্যোতিষচর্চাও করত মাঝেমধ্যে। শখ ছিল গান-বাজনা। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি। বুড়িকে ঠকিয়ে পৈতৃক সম্পত্তির প্রায় সবটাই হাতিয়ে নেয় দিদি-জামাইবাবুরা, সেই সূত্রপাত। ক্রমশ মানসিক ভারসাম্য হারায় বুড়ি। কথা হচ্ছিল কলেজ স্ট্রিট পাড়ার মিষ্টির দোকান ‘মৌচাক’-এর অনিতা মজুমদারের সঙ্গে। সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে বুড়ির বাড়ির খুব কাছেই থাকতেন অনিতা— ‘একটা সময় দেখতাম, দামি কোট-প্যান্ট, টাই ঝুলিয়ে গটগট করে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটা। আর এখন! দেখলে কষ্ট হয়। গানের গলাটাও খারাপ ছিল না। অনেক গুণ ছিল। তবে কী অদ্ভুত জানেন, পাড়ার লোকেরা ওকে পর করে দেয়নি। কাপড় ময়লা হয়ে গেছে দেখলে নিজে থেকেই কেউ হয়তো এসে একটা শাড়ি দিয়ে যায়। দোকানে গিয়ে শিঙাড়া, মিষ্টি, এটা-ওটা চাইলে কেউ বারণ করে না। এখন মাঝেমধ্যে শুনি বুড়ি নাকি রোজ সকালে কলেজ স্কোয়্যারে এসে বসে আর একা একা চিৎকার করে কাঁদে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনিতা। বুড়ির কান্না থামে না।

ওখানে আর এক পাগলকে দেখা যায় মাঝেমধ্যেই। সে ভোম্বল নামেই পরিচিত। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। খালি গায়ে একখানা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট কোনও মতে জড়ানো। সারা গায়ে বালি মাখা। কখনও হামাগুড়ি দিয়ে, কখনও পায়ে হেঁটে, ভোম্বল দু’ভাবেই পথ চলতে অভ্যস্ত। তবে, এক বার হনহনিয়ে হাঁটা দিলে আর রক্ষে নেই। সোজা হাওড়া ব্রিজ। তার পর বেশ কিছু ক্ষণ গঙ্গার হাওয়া খেয়ে, ফের উলটো পথে রওনা। এক বার রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট থেকে হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত ভোম্বলের পিছু নিলাম। গল্প বলবে বলে শুরু করল, কিন্তু কোনও বিরতি না দিয়ে গোটা রাস্তা ধরে শুধু একটা কথাই বলে গেল— ‘বেল পাকলে কাকলির কী!’ অবশেষে এক রকম বাধ্য হয়েই বলে ফেললাম, ‘এর পরের লাইনটা কী জানতে পারি?’ তৎক্ষণাৎ রাস্তা থেকে এক মুঠো বালি কুড়িয়ে আমার দিকে ছুড়ে দিল। আর ফিসফিসিয়ে বলল, ‘সে গুড়ে বালি।’

amaydebroy@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE