Advertisement
১১ মে ২০২৪

লাইন লাগাও

তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, ১৯৯৪-’৯৫ হবে। খিদিরপুরের একটা স্কুলে। হঠাৎ কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন, ছেলেদের স্কুল অনেক হল, এ বার মেয়েদের করে দেওয়া হোক স্কুল। আমরা ভাবলাম, স্কুল আমাদের কো-এড হয়ে যাবে, মেয়েদের পাশে বসব!

অনুপম রায়
শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০৬
Share: Save:

তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, ১৯৯৪-’৯৫ হবে। খিদিরপুরের একটা স্কুলে। হঠাৎ কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন, ছেলেদের স্কুল অনেক হল, এ বার মেয়েদের করে দেওয়া হোক স্কুল। আমরা ভাবলাম, স্কুল আমাদের কো-এড হয়ে যাবে, মেয়েদের পাশে বসব! ও হরি, সে গুড়ে বালি। ছেলেদের ভর্তি বন্ধ করে, জুনিয়র ক্লাসে শুধু মেয়েদের ভর্তি নেওয়া শুরু হল। মানে, ধীরে ধীরে ছেলেরা ক্লাস টেন পাশ করে বেরোতে থাকবে, আর মেয়েদের জলরাশি এক ক্লাস এক ক্লাস করে ওপরে উঠতে থাকবে। এখন, বাথরুমও তো লাগবে কেজি, ওয়ান, টু-তে পড়া পুটকে পুটকে মেয়েগুলোর। সমাধান এল, ছেলেদের বাথরুম ভেঙে তৈরি হবে নতুন ঝাঁ-চকচকে মেয়েদের টয়লেট। আমাদের টয়লেটটা এমনিতেই প্রচণ্ড ময়লা, টিমটিম করে জ্বলছিল, এ বার সেটাও গেল। টেম্পোরারি এক পিস টয়লেট নির্মাণ করা হল, বিল্ডিং থেকে অনেক দূরে। ক্লাস থেকে হেঁটে যেতেই সাত মিনিট লাগে। বর্ষাকালে ছাতা নিয়ে যেতে হত বিশাল মাঠ পেরিয়ে। গোটা স্কুল বারান্দা থেকে চেয়ে চেয়ে দেখত, ছাত্ররা টয়লেট করতে যাচ্ছে। দুটো মাত্র ইউরিনাল আর একটা ইন্ডিয়ান স্টাইল, এ দিকে ছাত্রসংখ্যা ৭০০-র ওপর! এ বার নিয়ম এল, ক্লাস চলাকালীন কেউ টয়লেট যেতে পারবে না। অর্থাৎ আমাদের কাছে দুটো স্লট, ব্রেক টাইম (১০ মিনিট) আর টিফিন টাইম (২০ মিনিট)। প্রত্যেক দিন দেখা যেত, এই সময় দুটোয় বিশাল লাইন সাপের মতো বেঁকতে বেঁকতে চলেছে মাঠের এই গোলপোস্ট থেকে অন্য গোলপোস্ট। মাঝেমাঝে ঘণ্টি বেজে যেত, কিন্তু লাইন খুব একটা এগোতে পারেনি। চেপেচুপে আবার গজগজ করতে করতে ক্লাসে গিয়ে বসতে হত। সিক্স থেকে টেন ওই থার্ডক্লাস টয়লেটে না গিয়েই, ৮-১০ ঘণ্টা প্রায় রোজ কাটিয়ে দিলাম। এই লাইনে দাঁড়িয়ে কত মারপিট, কত গালাগাল খেয়ে যে দিন কেটেছে! আমরা ক্লাস সিক্স, ভীষণ রোগা, ল্যাগব্যাগ করছি। সিনিয়র ক্লাস, মানে ক্লাস নাইন, টেন এসে এক চাঁটি মেরে লাইন কেড়ে নিত। আমরা ঘণ্টি বাজা মাত্র ছুটতে ছুটতে হয়তো লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম, বড়রা হেলতে দুলতে এল, চড়-থাপ্পড় মেরে আমাদের পেছনে পাঠিয়ে দিল! আর একটা ভয় ভীষণ ভাবে কাজ করত, সেটা হল সিনিয়রদের ধাক্কা। অনেক কষ্টে হয়তো লাইন এগোতে এগোতে এ বার আমার পালা। গন্ধে পাগল করা, থুতু-হিসি মাখা সিমেন্ট বোলানো দুটো ইটের ওপর দাঁড়িয়ে, ময়লা নালির দিকে মুখ করে, যেই কাজ শুরু করেছি, অমনি পেছন থেকে জোরসে এক ধাক্কা। এসে গেছে কোন সিনিয়র! তাকে তখনই আধখানা-হিসি-করা অবস্থায় ছেড়ে দিতে হবে স্থান!

২০০০ সাল। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের রেজাল্টের লাইন। তখন অনলাইন রেজাল্ট দেখার সিস্টেম বেরিয়ে গেছে। এক সপ্তাহ আগেই, সেই অনলাইনে আইআইটি-র রেজাল্ট দেখে হতাশ হয়েছি। ভেবেছিলাম কিছু একটা র‌্যাংক আসবে। কিছুই আসেনি। তাই জয়েন্ট নিয়ে কোনও চান্স নিইনি। বাবার বাইকে চেপে, সোজা যাদবপুর। গিয়ে দেখি, বিশাল লাইন। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির গেটটার বাইরে ফুটপাত অবধি লাইন চলে গেছে। রেজাল্ট ঝুলছে ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। আমার হাত পা ঠান্ডা। লাইনের সব লোকজন কাকু লেভেলের। কিছু কাকিমাও আছে। এরা কেউই পরীক্ষা দেয়নি, বাবুসোনাদের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল আলোচনা চলছে, অমুকের ছেলে ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং দুটোতেই নাকি ঘ্যামা র‌্যাংক করেছে কিন্তু পড়তে যাবে আমেরিকা। এ দিকে আমার টেনশন বেড়েই চলেছে। ওই ১৮ বছর বয়সে আমি ঠুলি-আঁটা ঘোড়ার মতো ছিলাম। একটাই লক্ষ্য। জয়েন্ট। না পেলে, সুইসাইডও করতে পারি। পেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠছে থেকে থেকে। বাবা দেখি নিশ্চিন্ত মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে, একে ওকে ধরে গল্প করছে। প্রায় এক ঘণ্টা লাইন ধরে এগোতে এগোতে যখন শেষমেশ পৌঁছলাম, তখন টেনশনেই আমি অর্ধেক। আমার হিসেব ছিল, ১০০-র মধ্যে থাকব। কাঁপা কাঁপা আঙুলে আমি লিস্ট দেখছি আর বাবা কোথাও একটা রিল্যাক্স করছে। যেই দেখেছি ৮১, লাফিয়ে উঠেছি! মার দিয়া কেল্লা! বাবা তখনও চিল করছে। ৮১ দিয়ে আর কী হয় টাইপের হাবভাব। আমি তো দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে ঝিলমিল করছে যাদবপুর। আমার এই গোটা জীবনের সব চেয়ে আনন্দের দিন হল এই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার দিন। ফার্স্ট ইয়ারে প্রথম প্রেম, সেকেন্ড ইয়ারে ব্রেক-আপ, বেশ কিছু লেঙ্গি খাওয়ার গান, থার্ড ইয়ারে আবার... উফ জাস্ট ভাবা যাচ্ছে না। বাড়ি ফিরে তিন-চার দিন প্রবল পেট খারাপ ছিল, মনে আছে। টেনশন ডায়রিয়া, লাইনে দাঁড়িয়ে।

এর পর ২০০২-’০৩, বিশাল ডানা গজিয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি। সারা দিন বিভিন্ন রকমের ফুর্তি মেরে, যোধপুর পার্কে বিশাল লাইন দিয়ে প্রতিমা দর্শন করে বেরিয়েছি। খুব জোর হিসি পেয়েছে, আমার আর আমার বন্ধু সূর্য-র। এর ঠিক আগেই আমরা ঠাকুর দেখার লাইনে গোলমাল পাকিয়েছিলাম। আমার হাত লেগে, একটি বাচ্চার বেলুন ফেটে যাওয়ায় সে ফাটিয়ে কেঁদেছে। সবাই ঘুরে ঘুরে তাকিয়েছে। তার পর সূর্য তার ক্যাপ-বন্দুক’টা দেখতে চাওয়ায় সে আরও জোরে কেঁদেছে। এতে চার পাশের লোকেরা আমাদের উপর একটু চটেই ছিল। আমরা কাঁচুমাচু মুখ করে এক জন ভলান্টিয়ারকে টয়লেট কোন দিকে জিজ্ঞেস করেছি। সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। তার কথামত আমরা ওই দিকে গিয়ে ঢুকতে গিয়ে আবার খ্যাঁকানি খেলাম: ‘দেখতে পাচ্ছেন না, লাইন আছে!’ আমরা আবার গুটগুট করে একটা লাইন দেখে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। লাইন টুকটুক করে এগোচ্ছে, আমাদেরও চাপ বাড়ছে। ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে সন্দেহ হওয়ায়, আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, এটা হিসি করার লাইন তো? ব্যস! কেলেঙ্কারি কাণ্ড! ‘লজ্জা করে না! আজকালকার অসভ্য ছেলে সব! মনে ভক্তি নেই, ঠাকুর দেখার লাইনে দাঁড়িয়ে অশ্লীল ভাষা! ছি ছি!’

ভুল লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার গল্প আর একটা আছে। আমার বউদির এক বান্ধবী, অটোর লাইন ভেবে চুল্লুর লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কিছু দূর এগিয়ে লজ্জায় মুখ লাল করে বেরিয়ে এসেছিল। এ দিকে কলেজে কত সুন্দরীদের লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে, জেনারেশনের পর জেনারেশন শেষ হয়ে গেল। এক সিনিয়র তো কলেজ পাশ করে কলেজ ছাড়তে পারল না, রোজ বিকেলে তার কলেজ আসা চাই। তখন সে বিদিশার লাইনে দাঁড়িয়ে। এই সব লাইন থেকে গাড়ি এক দিন বিচ্যুত হবে, এই আশায়। আসলে, নিম খাওয়ালে চিনি বলে, কথায় করে ছল! তেতো মুখে বছরের পর বছর কেটে যায়, লাইন আর এগোয় না।

কলেজের আর কয়েকটা লাইনের কথা খুব মনে পড়ে, সেটা হল সিমেস্টার পরীক্ষার ফর্ম তোলার লাইন, মাইনে দেওয়ার লাইন, আর লাইব্রেরি ফাইন জমা দেওয়ার লাইন। এক মাস ধরে বই তুলে রেখে দিলেও, ফাইন দাঁড়াত গিয়ে ৭-৮ টাকা। তবে সেই লাইনে দাঁড়ালে কমসে কম ৩-৪ ঘণ্টার ধাক্কা। একটাই মানুষ কাউন্টারে, ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাজ করেন। দেড়টা-দুটো বাজলে মুখের ওপর শাটার ফেলে দেন, টিফিন টাইম। আবার দাঁড়িয়ে থাকো। তবে বিল্ডিং একটাই, অর্থাৎ আর্টসের দুরন্ত সব মেয়েরাও আসে, আর দীর্ঘ দিনের তৃষ্ণার্ত ইঞ্জিনিয়ারিং-এর হাঁদাগুলোও থাকে। এই লাইনে দাঁড়িয়ে প্রোপোজ করা, চিঠি দেওয়া, সব আমরা দেখেছি।

ফর্ম তোলার লাইনে এক বার বিশাল গোলযোগ বাধে। আমরা সকাল ১০টা থেকে লাইন দিয়েছিলাম, প্রায় ৫০ জনের পরে দাঁড়িয়ে, তখন কাউন্টারই খোলেনি। আমাদের সে দিন ১১টা নাগাদ ইলেক্ট্রিকাল ল্যাবের ভাইভা। আমাদের এক বন্ধুকে লাইনে দাঁড় করিয়ে, আমরা ক’জন ভাইভা দিতে গিয়েছি। ১২টা নাগাদ ফিরে দেখি লাইন বেশ এগিয়েছে, একদম খাঁচার মুখে আমরা। যেই ঢুকেছি লাইনে, পেছন থেকে উত্তাল গালিগালাজ। যে ছেলেটি সব চেয়ে ঝামেলা করছে, সে ব্যাটা ৪-৫টা মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। ওর তম্বিতম্বা শুধুমাত্র মেয়েগুলোকে ইম্প্রেস করার জন্যই। আমরা যদি চিল্লামিল্লি করি, তা হলে মেয়েগুলোর কাছে আমাদের পয়েন্টস কমবে। কমুকগে! লাইন ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে। আমরাও উলটে এমন ধুনে দিলাম, সব একদম চুপ। বীরদর্পে ফর্ম তুলে আমরা আর একটা সিমেস্টার উতরে গেলাম।

আমার সব চেয়ে অসহ্য লাগে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের লাইন। মনে করুন আপনি ১৬ ঘণ্টা উড়ে গিয়ে আমেরিকায় নামলেন। নেমেই সবার আগে শুরু হবে ইমিগ্রেশন। ১ থেকে ২ ঘণ্টার ব্যাপার। বিশাল লাইন। আমেরিকার বাছাই করা কিছু গবেটকে ওখানে কাউন্টারে বসানো হয়। তারা পাসপোর্ট দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। এক মিনিটের জিনিসকে পাঁচ মিনিট ধরে করে। ভুল ভিসা এন্ট্রি করে, তার পর আবার ডেকে পাঠায়। আমাকে কাউন্টারে এক বার এক জন গান গেয়ে প্রমাণ করতেও বলেছিল যে আমি গায়ক। তার পর অট্টহাসি হেসে বলে, জাস্ট জোকিং, লম্বা চুল নেই বলে ও সন্দেহ করছিল। দুবাইয়েও এক অবস্থা, রোমেও তাই, দোহা-তেও বিশাল লাইন, তবু এরা কাউন্টার বাড়াবে না। মেট্রো রেলে যখন ‘একটা মাত্র কাউন্টার খোলা কেন’ বলে বিশাল লাইনের ল্যাজে দাঁড়ানো ভদ্রলোকটি গলা চড়ান, তখন তিনি শান্তি পেতে পারেন এই ভেবে, সাহেবসুবোর দেশেও কাউন্টার কম, রেলা বেশি।

আমার এই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে একটা গানও আছে, ‘আমি যেভাবে বড় হয়েছি’— এখনও মুক্তি পায়নি। এখন এই মোদীর গুঁতোয় এটিএম-এ যে-লেভেলে লাইন দিতে হচ্ছে, মনে হয় গানটা বাজারে ছেড়ে দেওয়া ভাল। সব লাইন-লাগানোরই একটা অদ্ভুত চরিত্র রয়েছে। আপনি যে লাইনে দাঁড়াবেন, দেখবেন সেটি সবচেয়ে স্লো। নড়েই না। পাশের লোক টুকটুক করে এগিয়ে যাচ্ছে। যেই আপনি লাফিয়ে পাশেরটায় যাবেন, দেখবেন ওটা আর এগোয় না। যেটায় ছিলেন সেটা টকাটক এগিয়ে যাচ্ছে। ট্রাফিক লাইনেও তাই। গাড়ির লাইন বলতেই আমার গোদার-এর ‘উইকএন্ড’ ছবিটার কথা মনে পড়ে। একটা বিশাল লম্বা শট, সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আছে তো আছেই। আমাদের এই বেঁচে থাকার মতোই। ওখানে ঘন ঘন নীল, সাদা আর লাল গাড়ি দেখা যাচ্ছিল, আমাদের এখানে নাহয় সবুজ, গেরুয়া আর সাদা। সবাই লাইনে পড়ে গেছি। সব কিছু থেমে গেছে। নিজেদের গাড়িগুলো থেকে নেমে পড়তে পারলে, এই লাইনে আর থাকতে হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anupam Roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE