Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

পুরনো স্টেশন

সূর্য অস্ত যায় শ্মশানটার ঠিক পিছনে। আমাদের এই পুরনো স্টেশন থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ বরাবর তাকালে দূরে দেখা যায় শ্মশানের বাঁ-দিকের প্রান্তটা। ওই বাঁ-প্রান্তেই পর পর দুটো চিতা সাজানোর জায়গা।

ছবি: মণীশ মৈত্র

ছবি: মণীশ মৈত্র

সৌরভ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০৩
Share: Save:

সূর্য অস্ত যায় শ্মশানটার ঠিক পিছনে।

আমাদের এই পুরনো স্টেশন থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ বরাবর তাকালে দূরে দেখা যায় শ্মশানের বাঁ-দিকের প্রান্তটা। ওই বাঁ-প্রান্তেই পর পর দুটো চিতা সাজানোর জায়গা। খুব কালেভদ্রে যে দিন বিকেলে দুটোই একসঙ্গে জ্বলে, পাশাপাশি দুটো কালচে-ধূসর কুণ্ডলী একে অন্যকে জাপটাজাপটি করতে করতে উঠে যায় আর ক্রমশ বিস্তৃত হয়ে পশ্চিমের আকাশটা ঢেকে দেয়— সে দিন আর সূর্যাস্ত দেখা যায় না।

আজ ছিল তেমনই এক অন্য রকম, বিরল দিন। কুড়ি বছর আগে এক বার এই স্টেশন থেকে এমন জোড়া-চিতার ধোঁয়ায় ডুবন্ত সূর্যকে হারাতে দেখেছিলাম। আবার আজ।

এমনিতে আমাদের আধা-শহরের একটেরে এই পুরনো স্টেশনটাকে রেল-কোম্পানির ভুলের ফসল বলা যায়। প্রথম যখন রেলের লাইন পড়ে, কে জানে কোন বিবেচনায় ধু-ধু জলার মাঝখানে, খালের পাড়ে চাট্টিখানিক মাটি ফেলে দুটো লাইনের এধারে-ওধারে প্ল্যাটফর্ম ওভারব্রিজ আর ক’হাত দূরে একখানা দায়সারা অপেক্ষাঘর-সমেত টিকিট-কাউন্টার বসিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল বাবুরা। এখানে জনবসতি নেই, বাজার নেই, অফিস-কাছারি নেই। বাসরাস্তা আছে, অনেকটা দূর— প্রায় দশ মিনিট আলের পথ। এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় ট্রেনের খদ্দের কোথা?

হ্যাঁ, খালের ও পারে গুটিকতক টালির চালা আছে। ওটা আসলে অন্য পঞ্চায়েত এলাকার শেষ প্রান্ত, খালটাই ও দিকের বর্ডার। খালের ওপর সাঁকো যদিও আছে একখানা, সেটা কাজে লাগে না বিশেষ। ওই এলাকার জীবনযাত্রা খালের ও পারেই চুকেবুকে যায় দিব্যি। আর, বেশির ভাগ গঞ্জ-মফস্‌সলেই পিছন দিকের খাল ঘেঁষে সার-দেওয়া যে-সমস্ত ঘুপচি চালাঘর থাকে, তাদের চরিত্র একই রকম হয় সচরাচর। এখানেও তাই-ই। ওই সব প্রান্তিক খুপরির যারা বাসিন্দে, তাদের এ-পারে আসার দরকার পড়ে খুব কম। কেননা, ও-পাশের হাটতলা-কুমোরপাড়া-পাটগুদাম-সুরকিকল-চোলাইঠেক পেরিয়ে অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে যারা ওই সব খুপরিতে যাতায়াত করে, তারাই লেনাদেনা মিটিয়ে দেয় মোটের ওপর। সাঁকোর ওপর সাবধানী পদশব্দ... সে খুব ক্বচিৎ-কদাচিৎ ঘটে।

ট্রেন-কোম্পানিই সাঁকোটা বানিয়ে দিয়েছিল যেচে পড়ে। যদি যাতায়াত বাড়ে। কিছুই লাভ হয়নি। উলটে একটা সম্মিলিত আওয়াজ ওঠে জনগণের মধ্যে, যাতে ঠিক বাজার ঘেঁষে কোনও একটা জায়গায় নতুন একটা স্টেশন বসায় রেল। চিঠিচাপাটি আন্দোলন হয় খুব। তার পরেই সেই দাবি মেনে ফুটবল-মাঠের পাশে জনবহুল এলাকায় তৈরি হয় নয়া হল্ট। ক্রমশ চাপ বাড়ার ফলে ক’বছরের মধ্যে সেটাই হয়ে ওঠে আসল স্টেশন। যত যাত্রী-ওঠানামা হই-হট্টগোল সব সেইখানে। জলার মধ্যে পূর্বতন এই স্টেশন, পরিত্যক্ত পাগলের মতো তার ন্যাড়া প্লাটফর্ম, জীর্ণ ওভারব্রিজ আর শূন্য কাউন্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে খালপাড় ঘেঁষে।

প্রথম যখন এই স্টেশন তৈরি হয়, আমি তখন বারো ক্লাস পাশ করেছি সদ্য। আজ বিয়াল্লিশ পেরোল। পুরনো স্টেশনে আর কেউ যায় না আজকাল।

শুধু আমি যাই।

কেন যে যাই, এক কথায় বোঝানো মুশকিল।

একদম সম্প্রতি এই অদ্ভুত ঝোঁকটা চেপেছে আমার। মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে সাইকেল চালিয়ে এখানে চলে আসি আমি। পিচরাস্তা ধরে প্রায় কুড়ি মিনিট, তার পর আল ধরে খুব সাবধানে চালিয়ে ওই ভূতুড়ে ওয়েটিংরুমের ভেতরে সাইকেলটা রাখি, তার পর আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে দু’নম্বর প্লাটফর্মে উঠে আসি। কিছু ক্ষণ চুপচাপ দাঁড়াই নির্জন প্লাটফর্মের মাঝখানটিতে। পার্থেনিয়ামের জঙ্গল গজিয়েছে কংক্রিটের ধার ঘেঁষে একটানা, বেপরোয়া থাবা বাড়িয়ে সাম্রাজ্য বিছিয়েছে ভেতরের ফাটাফুটিতেও। আমি সেই ফুটকি-ফুটকি ফুল আর সবুজ পাতার ভিড় এড়িয়ে পুরো প্ল্যাটফর্মটা হেঁটে আসি এক চক্কর। এক বার গুটি গুটি পায়ে ওভারব্রিজেও উঠতেই হয়। বুনো লতায় ঢেকে গেছে অনেকটা। লোহার ফ্রেমে আটকানো সিমেন্টের ধাপিগুলো নষ্ট হয়ে আসছে ক্রমশ, ওপরের স্ল্যাবগুলোও তাই। পা টিপে টিপে উঠি আমি। প্রাণ ভরে শ্বাস নিই, একটু হাত বুলোই দু’পাশের লোহার বেড়ায়, যেন আদর করার ভঙ্গিতে। তার পর, সন্তর্পণে নেমে, আবার হেঁটে আসি দু’নম্বর প্লাটফর্মের একদম শেষের এই বেঞ্চিটার দিকে।

এই বেঞ্চিতে বসলে অনেক দূরের দিগন্ত চোখে পড়ে। জলা, খেত পেরিয়ে গাঢ় সবুজ বনের রেখা। আর একটু কোনাচে করে তাকালেই, শ্মশান। যার পিছনে সূর্যাস্ত।

আমি আসি ঠিক সূর্যাস্তের সময়টিতে। চুপ করে বসে থাকি একা। আকাশ ছাইরঙে ছেয়ে যায়, কম-দামি কালির মতো অন্ধকার গড়িয়ে নামে আমার গা-মাথা বেয়ে। কোনও দিন এক থালা আলো নিয়ে ত্রয়োদশীর চাঁদ ওঠে ওভারব্রিজের মাথায়। আলো-অন্ধকার আমার খেয়াল থাকে না ঠিকমত, আমি বেভুল বসে থাকি কেবল। অবশেষে মশার কামড় অসহ্য হলে নেমে আসি, সাইকেলের তালা খুলি। আমার মনে পড়ে যায়, একটা টিউশনি মিস হল। পরেরটাতে যেতেই হবে।

বিকেলের শুরুতেই ক্লাস নাইনের পুবালি, পাঁচটা থেকে সাতটা, সপ্তাহে তিন দিন। হ্যাঁ, আমি টিউশন পড়িয়েই খাই। সেই সকাল থেকে রাত অবধি একটানা টিউশন পড়িয়ে চলতে হয় আমাকে, ফাইভ থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত নানা ক্লাসের ছাত্রছাত্রীর বাড়ি গিয়ে-গিয়ে। আমি যেখানে ভাড়া থাকি সেই বাড়িতে জায়গা খুব কম, তাও মাদুর কিনে ব্যাচ জমানোর চেষ্টা করেছিলাম। হয়নি। আসলে, আমি খুব ভাল পড়াতে পারি না, আমি জানি। ভাল ছাত্রও ছিলাম না। উচ্চমাধ্যমিকে সেকেন্ড ডিভিশন। পাস কোর্সে বিএসসি পাশ করেছিলাম যখন, সেই সময় নাগাদ বাবা মারা যান। তার পর থেকে কিছুতেই কিছু করতে পারিনি, অগত্যা টিউশনের লাইনে। স্পেশালাইজেশন নেই বলে খুব ভাল মানের অ্যামবিশাস স্টুডেন্ট আমার কাছে আসে না। আমি মিডিওকারদের কিংবা ফেলুয়া ছাত্রদের টিউটর। যে-সব বাড়িতে গার্জেনরা পড়াশোনা বোঝে না, শুধু মাস্টার ক’দিন আসছে আর কত ক্ষণ থাকছে সেইটুকুই গুনেগেঁথে নেয়— আর পড়ুয়া পরের ক্লাসে উঠলেই সন্তুষ্ট— সেই ধরনের বাড়িতেই আমার সুবিধে।

পুবালির মা এমনিতে চমৎকার মহিলা। চায়ের সঙ্গে শুধু বিস্কুট নয়, মাঝে মাঝে চানাচুরও দেন। দিব্যি অম্বল হয়, পরের টিউশন-বাড়িতে গিয়ে সে দিন আর পেটের মধ্যে খিদের মোচড়টা টের পাই না। পুবালিও, উপপাদ্য বোঝাতে গেলেই ভুরু কুঁচকে বলে, ‘উঁউঁউঁ, সম্পাদ্য করি না, শুভোদা?’ আমিও হাঁপ ছাড়ি। মোটের ওপর পুবালির বাড়িতে আমার সবই সুবিধে। শুধু একটাই সমস্যা। এই যে মাঝে মাঝে আমি এই মরা বিকেলে জনশূন্য স্টেশনে এসে বসে থাকি— এই দিনগুলোয় ও-বাড়ির টিউশন-স্লটটাতেই কামাই করতে হয়। আর পুবালির মা পরের দিন মুখটা পাথুরে করে শুধু ঠকাস চা বসিয়ে দিয়ে যান, বিস্কুট ছাড়া। তার পর সিক্সের সন্তুকে পড়াতে গিয়ে আমার অসহ্য খিদে পায়।

এক বার পুবালির মা একটা কেলেংকারি কাণ্ড করেছিলেন।

সেটা বোধহয় মাসের প্রথম দিক ছিল। এই সময়টাতে আমার বউ সুমিতা খুব অস্থির হয়ে ওঠে, প্রতি দিন রাতে আমি বাড়ি ফেরার পরই খোঁজ নেয় ক’জন মাইনে দিল। সংসারের সব টানাটানি ওকেই ম্যানেজ করতে হয় যে! আমার বুড়ি মা, রোগা ছেলে, বাড়তে-থাকা বাজারদর, বাড়িভাড়া, আচমকা এসে-পড়া নানান বাড়তি খরচ— পুরনো শালের মতো এ দিক সেলাই করতে গিয়ে ও দিক ফেঁসে যাওয়ার মতো সংসার। আমি সব মাইনের খাম, যখন যেটা মেলে, বিনা বাক্যব্যয়ে সুমিতার হাতে তুলে দিই। সে দিন পুবালির বাড়িতে মাইনে পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করেনি, আমাকে চুম্বকের মতো টানছিল এই পুরনো স্টেশনের ভাঙা বেঞ্চি আর সূর্যাস্তের আকাশ, আমি ভূতগ্রস্তের মতো সাইকেল ঠেলে এখানে এসে জুটেছিলাম আর সারা বিকেল-সন্ধে চুপ করে বসেছিলাম, যেমন থাকি। কিন্তু রাতে সুমিতাকে সে কথা বলিনি। বলেছিলাম, মাইনে হয়নি।

এই গুপ্তকথা দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি জানুক, আমি চাইনি। আমি, রিফু-জামা আর ময়লা প্যান্ট পরা প্রাইভেট টিউটর শুভো-মাস্টার, সাত রাজার ধনের মতো লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম আমার এইটুকু সিক্রেট।

কিন্তু পরের দিন সকালে পুবালির মা তাঁদের কাজের লোককে আমার ভাড়াবাড়িতে পাঠান, সে খামটা সুমিতার হাতে তুলে দিয়ে বলে, ‘মাস্টার কাল বিকেলে পড়াতে যায়নে যে, বৌদিমণি এই মাইনে পাট্টে দিল।’

সেই প্রথম সুমিতা জানতে পারে কথাটা। জেনে চুপ করে ছিল সারা দিন। আমি ভেবেছিলাম, কিছু ঝামেলা হল না, ভালই।

কিন্তু গত মাসে আবার। সেই কাজের লোক, সেই খাম, সেই বয়ান।

সে দিন রাতে আমার পাশে শুয়ে অন্ধকার সিলিঙের দিকে তাকিয়ে সুমিতা খুব আস্তে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘প্রায়ই যাও, না, ওখানে? পড়ানো কামাই করে? বসে থাকো, সেই বেঞ্চিটায়?’

আমি চুপ করে ছিলাম। সুমিতার অনুমানশক্তি প্রখর, গরিব ঘরের মেয়ে থেকে গরিবতর ঘরের বউ হয়েছে, চট করে ধরে-বুঝে নিতে পারে অনেক কিছু। উত্তর না পেয়ে উঠে বসেছিল, অন্ধকারে, আমি ওর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু এক বার ওর গালে হাত রেখেই যা বোঝার বুঝেছিলাম।

‘ওভারব্রিজে উঠেছিলে? সেই ওভারব্রিজটাতে?’

আরও এক বার সুমিতার নির্ভুল অনুমানক্ষমতা দেখে অবাক হচ্ছিলাম, আর ঠিক সেই মুহূর্তে সুমিতা উপুড় হয়ে ভেঙে পড়েছিল আমার খোলা বুকে। ‘কেন গেছলে, বলো? কেন যাও? লুকিয়ে লুকিয়ে, মিথ্যে বলে... কেন যাও? যে স্টেশনে কেউ যায় না সেখানে তুমি কেন যাবে, কেন, নিশি-ডাকা পাগলের মতো... কীসের আশায়? যা বিশ বছর আগে শেষ হয়ে গেছে, মরে গেছে, চুকে গেছে, তার খোঁজে কেন হাঘরের মতো...’

আমি অপরাধী-অপরাধী মুখে ওর খোঁপাতে হাত বুলিয়েছিলাম। আর মনে মনে বলেছিলাম, ‘শেষ হয়নি সুমিতা। মরে যায়নি কিচ্ছু। পুরোনো স্টেশনে সব জ্যান্ত আছে। সব।’ মনে মনে বলছিলাম, যাতে সুমিতার কানে না যায়।

‘তুমি কিন্তু আমাকে বলেছিলে, সব ক্ষত তুমি ভুলে গেছ। আমি ভেবেছিলাম, আমি ভুলিয়ে দিতে পেরেছি! তুমি সেরে উঠেছ, আমি ভেবেছিলাম!’ সুমিতাকে বিয়ের সাত বছর পর এই প্রথম আমি কাঁদতে দেখলাম। শুনলাম বলাই ভাল। মুখ তো দেখতে পাচ্ছিলাম না।

‘এমন কোরো না। শুধু তো গিয়ে বসেছি... আর তো কিছু...’ আমি দুর্বল গলায় স্তোক দিতে গিয়েছিলাম।

‘ওগো, তুমি বুঝতে পারছ না... তুমি আবার কেমনধারা হয়ে পড়ছ দিন দিন! তোমার চাউনি, তোমার কথা বলার ধরন কেমন ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে, চেহারা দড়ি হয়ে যাচ্ছে। পড়ানোয় অবহেলা করতে শুরু করেছ, দুটো টিউশনি কমে গেল এই ক’দিনের মধ্যে। কত দিন চুল কাটোনি, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ে ময়লা... কুড়ি বছর আগে যারা তোমায় পাগলা শুভো বলত তারা আবার বলছে...’

‘আচ্ছা আচ্ছা। আর যাব না। আর কামাই হবে না টিউশনে।’ প্রসঙ্গটা চাপা দিয়েছিলাম। আসলে আমার সুমিতার কাছেই জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব— আমি কেন যাই ওই স্টেশনে? কেন উঠি ওভারব্রিজে, কেন বসে থাকি বেঞ্চিতে? কারণগুলো যে ভুলে গেছি। সুমিতাকে বোধ হয় বলেছিলাম এক কালে, তাই না? ও কি আমাকে মনে করিয়ে দেবে একটু? কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয়নি, পাছে একেবারেই পাগল হয়ে গেছি এমনটা ধরে নেয় ও।

তবে সুমিতাকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি। আজ এসেছি আবার। নিজেকে সামলে রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব, বুঝেছি। সুমিতা জানতে চেয়েছিল, কীসের আশায়। আমিও কি ছাই জানি সবটুকু? সত্যি বলছি, পুরনো কথা আমার নিজের খুব নিখুঁত স্পষ্ট ভাবে মনেও পড়ে না আজকাল। স্মৃতির ওপর সর জমেছে।

শুধু এইটুকু মনে আছে, এই বেঞ্চিতে আমার অপেক্ষা করার কথা ছিল। আই প্রমিস্‌ড টু বি ওয়েটিং রাইট হিয়ার।

কে আসবে? কার জন্যে অপেক্ষা? মাঝে মাঝে মনে হয়, সব জানি আমি। মনে পড়ার শুধু এক ইঞ্চি দূরে এসে থেমে গেছি। স্রেফ একটা টোকা পড়ার অপেক্ষা। খুলে যাবে সব স্মৃতির সিংদরজা। সেই মনে-পড়াটুকুর জন্য তীব্র ছটফটানি আমার মগজের মধ্যে। এটাই কি পাগলামি? বুঝি না। শুধু বুঝি, আপাতত অপেক্ষা করাটাই কাজ আমার। পাভলভের কুকুরের মতো, নিছক অভ্যেসের দাস হয়ে আমি ওভারব্রিজে উঠি নামি, প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করি, বেঞ্চে বসে সূর্যাস্ত দেখি। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে, ঠিক আমার পাশে এসে বসবে কেউ এক দিন। যার আসার কথা ছিল। যে অপেক্ষা করতে বলেছিল। সে এলেই ফটাফট জ্বলে উঠবে সব আলো, তুরন্ত মনে পড়ে যাবে সমস্ত কিছু।

আজ গোড়া থেকেই মনে হচ্ছিল, আজকের দিনটা অন্য রকম! আজ বহু-বহু দিন পর আবার শ্মশানে দুটো চিতা জ্বলছিল একসঙ্গে। অস্তসূর্য ঢাকা পড়েছিল ধোঁয়ায়, হাওয়া থম মেরে ছিল, থিকথিকে অন্ধকারটা ঝুপ করে লাফিয়ে নেমেছিল অন্য দিনের চেয়ে দ্রুত। একটা পিউকাঁহা পাখি গলায় রক্ত তুলে একটানা চেঁচিয়ে চলেছিল, আমার পায়ের পাশ দিয়ে একটা দাঁড়াশ সাপ হেলতে দুলতে ঝোপে ঢুকে গিয়েছিল নির্বিকার।

আচমকাই একটা ক্ষয়া চাঁদ কালচে মেঘের ফাটল থেকে মুখ বের করে আমার বেঞ্চিটার ওপরেই যেন কয়েক আউন্স পানসে জ্যোৎস্না উপুড় করে দেয়।

আর আমি দেখতে পাই, কখন যেন আমার পাশে এসে বসেছে সে!

আমার পাঁজরের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা মুহূর্তের মধ্যে টেনিস বল হয়ে ওঠে। আধো-অন্ধকারে তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু তার দরকারই বা কী? আমি তো এই অবয়বের প্রতিটি রেখা চিনি। শাড়ির রং কালচে লাগছে, আলো নেই বলে, কিন্তু আমি নির্ভুল জানি, আসলে ওটা গাঢ় নীল। নীল তার প্রিয় রং ছিল, ভুলিনি। এই তো, কী আশ্চর্য, সব মনে পড়ে গেছে আমার, সব! ওহ্‌, আমি জানতাম, এই মির‌্যাক্‌ল হবেই! প্রত্যেকটি কথা মনে পড়ছে আমার, ঝড়ের বেগে, এভরি ডিটেল! আমি তবে এত দিন ভুল স্বপ্নের পিছনে দৌড়ইনি! অপেক্ষা বৃথা হয়নি আমার!

আমি খুব নিচু, গাঢ় গলায় বলি, ‘এত দেরি করলে!’

সে চুপ করে থাকে। একটু নড়ে শুধু, শাড়ির খসখস আর চুড়ির ঠিনিঠিন।

আমি আবার বলি, ‘আমি কিন্তু জানতাম, তুমি আসবেই। তোমার সব মনে আছে। ভোলোনি।’

জবাবে কেবল একটা ছোট্ট শ্বাসের শব্দ হয়। জানি, সে কম কথা বলত চির কালই। আমি কিন্তু স্বপ্নাতুরের মতো গলগল করে বলতে থাকি। আহ্‌, এত কথা জমা আছে আমার!

‘ওই ওভারব্রিজটার কথা মনে পড়ে? সেই আমাদের প্রথম বার! ওই লোহার বেড়াগুলোতে কত হাত বোলাই, জানো তুমি?’

চাঁদটা মেঘে ঢেকে যায়। অন্ধকার পুরু হয়ে ওঠে। এখনও সে নিরুত্তর। যেন অস্থির একটু। আমি খুব আলতো গলায় বলি, ‘কিছু বলবে না?’

সে বলে, ‘যাবে কি না বলো।’

আমি একটুও না ভেবে উত্তর দিই, ‘যাব। যাব।’ কোথায়, কেন, কী ভাবে— কিচ্ছু ভাবি না। সে ডেকেছে, আমি যাব। এতে আর ভাবার কী আছে? এমনটাই তো কথা ছিল! আবার গাঢ় গলায় বলি আমি, ‘চলো...’

‘টাকা আছে তো?’

টাকা!! বিদ্যুতের ঝটকা খেয়ে আমি চমকে উঠি। টাকা তো নেই! টাকার কথা তো...

শাড়ি খসখসিয়ে চুড়ি ঠিনঠিনিয়ে ঝটিতি উঠে দাঁড়ায় সে। কর্কশ গলায় বলে, ‘টাকা ছাড়া হয়? ন্যাকা!’

হিমানিপ্রবাহের মতো স্মৃতির বেগবান কয়েকটা চাঙড় আমার ওপর হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে। আমাকে পিষে দিয়ে চলে যায়। রক্তের নদীর মধ্যে জেগে উঠে আমি, মধ্য-চল্লিশের প্রাইভেট টিউটর শুভময় দাস, বিশ বছর আগেকার এক তীব্র, প্রাণঘাতী সংলাপের মুখোমুখি দাঁড়াই।

‘টাকা ছাড়া জীবন চলে? ন্যাকামি কোরো না!’

কে বলেছিল? আহ্‌, কে?

আবার চাঁদটা পিছলে বেরিয়েছে, এ বার যেন একটু বেশি তেজালো। বোধ হয় নাটকের শেষটুকু দেখার লোভ সামলাতে পারছে না। আমি সেই আলোয় তার চলে-যাওয়া দেখতে পাই। না, নীল নয়— তার পরনে লাল শাড়ি, হনহনিয়ে নেমে যাচ্ছে সে, প্ল্যাটফর্মের ঢাল বেয়ে, লাইন পেরিয়ে, ঝোপ ঠেলে। এক বারও পিছন ফিরছে না।

এমনটা যে হয় সে তো আমি জানি, চলে যাওয়ারই কথা, আমার মনে পড়ে গেছে সমস্ত। এই সংলাপের পর আর দাঁড়ায় না কেউ। মিলে যাচ্ছে সবই। কিন্তু, কোথায় যাচ্ছে ও? লাইন ক্রস করে, আরও ও দিকে... কোথায়? ও দিকে যে...

স্তব্ধ মূক হয়ে আমি দেখি, ম্লান জ্যোৎস্নায় সে মিলিয়ে যাচ্ছে খালের সাঁকো পেরিয়ে, ও-পারের অস্পষ্ট অন্ধকারের পেটের ভিতর!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Old Station
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE