Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নাটকীয়

প্রাক্তন ছাত্র কাম নাট্য নির্দেশক পলাশকে ফোনে ডেকে পাঠালেন অশোকবাবু। হেডস্যর অশোককুমার রায়। পলাশ ঘরে ঢুকতেই ভুরুটাকে তেরছা করে বললেন, ‘তুমি কিন্তু মারাত্মক একটা গলতি করে ফেলেছ পলাশ। ‘বিদ্যাসাগর’ নাটকে বিদ্যাসাগরের ভূমিকায় আর কাউকে তুমি পেলে না, শেষ পর্যন্ত কিনা রোহিত! ক্লাস ফাইভ থেকে ওই অকালপক্ক ছেলেটিকে আমি দেখে আসছি। পড়াশুনায় অমন গোবরভরা মাথা কস্মিনকালেও দেখিনি।

বিপুল মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

প্রাক্তন ছাত্র কাম নাট্য নির্দেশক পলাশকে ফোনে ডেকে পাঠালেন অশোকবাবু। হেডস্যর অশোককুমার রায়। পলাশ ঘরে ঢুকতেই ভুরুটাকে তেরছা করে বললেন, ‘তুমি কিন্তু মারাত্মক একটা গলতি করে ফেলেছ পলাশ। ‘বিদ্যাসাগর’ নাটকে বিদ্যাসাগরের ভূমিকায় আর কাউকে তুমি পেলে না, শেষ পর্যন্ত কিনা রোহিত! ক্লাস ফাইভ থেকে ওই অকালপক্ক ছেলেটিকে আমি দেখে আসছি। পড়াশুনায় অমন গোবরভরা মাথা কস্মিনকালেও দেখিনি। পাশ-ফেল না থাকার দরুন এইটের গণ্ডিটা কোনও মতে হয়তো টপকে গেছে, কিন্তু নাইনে এসেই পর পর দু’বার গাড্ডা! এ বারেও যে চিৎপটাং হবে না, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। তা এমন এক গুণধরকে কী করে যে তোমার বিদ্যাসাগর চরিত্রের জন্য মনে ধরল, সেই ভেবেই আমি তাজ্জব হচ্ছি! না হে, আমার পরামর্শ শোনো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই মর্কটটিকে তুমি বিদেয় করো। ওর পরিবর্তে স্কুলের কোনও মেধাবী ছাত্রকে বেছে নাও।’

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

একে তো হেডস্যর তার উপর স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানের সর্বময় কর্তা। এমন এক জন মানুষের কথা অগ্রাহ্য করা দুরূহ ব্যাপার। পলাশ তাই ঢোক গিলল, ‘রোহিত পড়াশোনায় যত গবেটই হোক না কেন, অভিনয়টা ও কিন্তু ভালই করে স্যর। গত বছর ওদের পাড়ায় ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকে হনুমানের পার্টটা বেশ ফাটাফাটিই করেছিল। তা ছাড়া ওর মুখের যা গড়ন, তাতে বিদ্যাসাগর ওকে খারাপ মানাবে না।’

অশোকবাবু কড়া ধাতের মানুষ। রাগলে চেঁচামেচি করে স্কুল মাথায় তোলেন। তবে আজ আর সেই পথে গেলেন না। গলায় ঈষৎ ঝাঁঝ মিশিয়ে বললেন, ‘কোথায় হনুমান আর কোথায় বিদ্যাসাগর! রোহিত যা ছেলে তাতে হনুমান, জাম্বুবান এই জাতীয় পার্টগুলোই ওর পক্ষে মানানসই। তবে তুমি হলে গিয়ে নাটকের নির্দেশক, তাই দিতেই যদি চাও তা হলে এলেবেলে কোনও পার্ট দাও। কিন্তু বিদ্যাসাগর নৈব নৈব চ। ও বিদ্যাসাগর করছে শুনলে স্কুলের বেঞ্চিগুলো পর্যন্ত হেসে গড়িয়ে পড়বে!’

পলাশের বাবা কলকাতার নামজাদা এক নাটকের দলের প্রতিষ্ঠিত এক জন অভিনেতা। বাবার সঙ্গগুণের সুবাদে অভিনয়ে পলাশেরও কিছু ব্যুৎপত্তি জন্মেছে। তাই, অনেকের চেয়ে নাটকটা সে ভালই বোঝে। কিন্তু অশোকবাবুকে অমান্য করে রোহিতকে যথাস্থানে রেখে দেওয়াটা এক রকম অসম্ভবই বটে। তবু শেষ চেষ্টা হিসাবে পলাশ মিনমিন করে বলে উঠল, ‘স্যর, নাটকে একটা চরিত্রকে ঠিকঠাক ফুটিয়ে তোলাটাই বড় কথা। মঞ্চে বহু পরিচ্ছন্ন মনের মানুষই তো ভিলেনের পার্ট করছে। দু’বেলা ঠিকমতো খাওয়া জোটে না এমন মানুষও করছে রাজার পার্ট। তা এ ক্ষেত্রে রোহিতও নয় সেই রকম।’

নো নেভার। তুমি ভেবো না শুধু পড়াশোনায় বাজে বলেই
এ সব কথা আমি বলছি। ছেলেটি এক নম্বরের ফক্কড়ও বটে। এই তো ক’দিন আগের ঘটনা, বাংলা স্যর অপূর্ববাবু ক্লাসে ‘তোমার দেখা একটি ক্রিকেট ম্যাচ’ নিয়ে একটা রচনা লিখতে দিয়েছিলেন। ও ছোকরা দু’মিনিটের মধ্যেই লেখাটা শেষ করে চলে এল। খাতায় কী লিখেছিল জানো? মাঠে গিয়ে পুরো একগাল মাছি আমার! বৃষ্টির জন্য আম্পায়ার ক্রিকেট ম্যাচটাকে বাতিল বলে ঘোষণা করলেন!

রোহিতের ফাজলামোর গপ্পো শুনে পলাশ ঠোঁট টিপে হাসছে দেখে সহসা গম্ভীর হয়ে গেলেন অশোকবাবু। মুখটাকে তিরিক্ষি করে আবার বললেন, ‘শুধু কী রোহিত, শুনলাম ওর দুই সাগরেদ শ্যামল আর নীলকেও তুমি নাকি নাটকের দলে ভিড়িয়েছ? এক রামে রক্ষে নেই সুগ্রীবও দোসর! তা ওদের জন্য কী কী পার্ট বরাদ্দ করলে শুনি?’

পলাশ প্রমাদ গুনল। সে আমতা আমতা করে বলল, ‘শ্যামল করছে মধুসূদনের পার্ট। আর নীল আছে এক সাহেবের চরিত্রে।’

শুনেই কেমন যেন আঁতকে উঠলেন অশোকবাবু। চোখ দুটোকে কপালে তুলে বললেন, ‘শ্যামল করবে মধুসূদন! ভূ-ভারতে আর কাউকে তুমি পেলে না। চার লাইনের কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে যে ছেলের দাঁত ভেঙে যায়, সে করবে কবি মধুসূদনের পার্ট! আর নীল, ওর সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভাল। গত বছর ফাইনাল পরীক্ষার সময় কী কাণ্ড ঘটিয়েছিল জানো? ইংরেজির উত্তরপত্রের মধ্যে পঞ্চাশটা টাকা পিনের সাহায্যে আটকে দিয়ে লিখেছিল— এই টাকাটা আপনার শ্রীচরণে প্রণামী হিসাবে অর্পণ করলাম স্যর। দয়া করে টেনেটুনে পাশটা করিয়ে দেবেন! বোঝো তবে কাণ্ড! এক লাইন ইংরেজি লিখতে গেলে যে ছেলের কলম ভেঙে যায়, তাকেই তুমি অবলীলায় কেমন সাহেবের পার্টে মনোনীত করলে! বলিহারি তোমাকে!’

মাথার উপর ফ্যান ঘুরলেও জামার নীচে কুলকুল করে ঘামছে পলাশ। সে ভাবল নাটকের নির্দেশনা দিতে রাজি হওয়াটাই অনুচিত হয়েছে তার। নির্দেশকের স্বাধীনতা থাকবে না, এ কেমন কথা! সে তাই পাংশু মুখে বলে উঠল, ‘শ্যামলকে দেখতে অনেকটা মধুসূদনের মতো স্যর। আর গায়ের রং ফর্সা ধবধবে বলেই নীলকে সাহেবের পার্টে মনোনীত করেছি।’

‘রাখো হে ছোকরা, এমন ভাবে বলছ, যেন মধুসূদন তোমার পাশের বাড়িতেই থাকতেন!’ অশোকবাবু হঠাৎ খেপচুরিয়াস, ‘তা ছাড়া মধুসূদনের মতো দেখতে হলেই যে কেউ মধুসূদনের পার্ট ভাল করবে, এ কেমন কথা! আর গায়ের রং ফর্সা হলেই যাকে তাকে সাহেব বানিয়ে দেওয়া যায় নাকি! ধবধবে ফর্সা না হলেও নাইনের ফার্স্ট বয় আবীর তো ইংরেজিতে রীতিমতো তুখোড়। তা ওর মুখে আচ্ছা করে ফেস-পাউডার মাখিয়ে নিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত!’

পলাশ বুঝল অশোকবাবুকে বোঝানো শিবেরও অসাধ্য। সে তাই হতাশায় কাঁধ ঝাঁকাল, ‘তা হলে আপনি কী করতে বলেন?’

লাস্ট বেঞ্চের ছেলেদের সামনে টেনে এনে হিরো বানানোর কোনও মানে হয় না। সবচেয়ে ভাল হয় যদি বাদ দিতে পারো। আর তা যদি না পারো তা হলে চাকর, ভিখিরি কিংবা আর্দালি-টার্দালি গোছের কোনও একটা পার্ট দিয়ে দাও। আমরা একটা সর্বাঙ্গসুন্দর নাটক করতে চাইছি। তিনটে ফেলুরামের জন্য তাতে কালির ছিটে পড়ুক আমি তা চাই না!

ভেতরে ভেতরে ক্রমশ ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছিল পলাশের। অশোকবাবুর অন্তিম কথাটায় তা একদম চুরচুর হয়ে গেল। সে চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘অভিনয়ের সঙ্গে মেধাবী ছাত্র হওয়ার যে কোনও সম্পর্ক নেই, সেটা জোর গলায় বলতে পারি স্যর। বহু তাবড় তাবড় অভিনেতাকেই জানি যাঁরা পড়াশোনায় একেবারেই ভাল ছিলেন না। আমার বাবার কথাই ধরুন না কেন, আপনারা তো হামেশাই বলেন বাবার জন্য স্কুল নাকি গর্বিত। কিন্তু আমি জানি বাবা পড়াশোনায় একেবারেই সাদামাটা ছিলেন। এই প্রসঙ্গে সচিন তেন্ডুলকরকেও টানা যায়। পড়াশোনায় অতি সাধারণ হওয়া সত্ত্বেও ক্রিকেটে তিনি কিন্তু জগৎবিখ্যাত! আমরা ভারতীয়রা তাঁকে নিয়ে গর্ব করি। সেই রকম স্যর রোহিত, শ্যামল, নীলেরাও যে এক দিন দিকপাল অভিনেতা হয়ে স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে না, সেটাই বা কে বলতে পারে! আমি চাই দক্ষ অভিনেতা। আপনার ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড বয়দের যে সেই গুণ নেই, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। তাই যাওয়ার আগে শেষ কথাটা আপনাকে বলে দিয়ে যাই স্যর। ওই তিন জনকে বাদ দেওয়া কিংবা অন্য কোনও পার্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার আপত্তি আছে। জোরাজুরি করলে আমাকে আর পাবেন না। নির্দেশনা ছেড়ে দেব...!’

কথাটা বলেই পলাশ যে হনহন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে হেডস্যরের তা ধারণাতেই ছিল না। তিনি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

পর দিন সকালে টুং-টাং আওয়াজ শুনে মোবাইলে চোখ রাখল পলাশ। স্ক্রিনে হেডস্যরের এম এম এস। অশোকবাবু লিখেছেন, আমি ভেবে দেখলাম, তুমিই ঠিক! রোহিত, শ্যামল, নীল এদের সবাইকে নিয়ে জোরকদমে রিহার্সাল শুরু করে দাও। নাটক দেখে সবাই ধন্য ধন্য করলেই আমি খুশি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE