Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

কে এই সিক্তবসনা

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের রোহিণী। সঙ্গে মালতী নামে এক আত্মীয়ার মুখ। আর স্ত্রী সুধারানির ফোটোগ্রাফ। এ ভাবেই তৈরি হল হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার-এর আঁকা ছবি। শমীন্দ্রনাথ মজুমদার বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের রোহিণী। সঙ্গে মালতী নামে এক আত্মীয়ার মুখ। আর স্ত্রী সুধারানির ফোটোগ্রাফ। এ ভাবেই তৈরি হল হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার-এর আঁকা ছবি। শমীন্দ্রনাথ মজুমদার

তন্ময়: এখানেই আত্মীয়ার মুখ, স্ত্রীর দেহবল্লরি

তন্ময়: এখানেই আত্মীয়ার মুখ, স্ত্রীর দেহবল্লরি

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ময়মনসিংহের গচিহাটার মজুমদারবাড়ি। সাত আট বিঘা জমি, বসতবাড়ি, ধানের গোলা ছাড়িয়ে সামান্য এগোলেই টল-টল করছে পুকুর, পাশে বাঁশঝাড়, মাঝেমধ্যেই দুলে উঠছে হাওয়ায়। আবহে ভাসছে তাদের শিরশিরে পত্রালাপ। সকাল থেকে নিঝুম দুপুর জুড়ে এমনটাই চলতে থাকে। এরই মাঝে গাছগাছালির আলোছায়ার আলপনা গায়ে মেখে বাড়ির বউ-মেয়েরা পুকুরে স্নান সেরে ভিজে কাপড় জড়িয়েই ঘরে ফিরে যায়। এ তো সে কালের গ্রাম-বাংলার রোজকার দৃশ্য। তবু এ নিয়ে কেউ তো সে ভাবে ছবি আঁকেননি। মজুমদারবাড়ির একমাত্র শিল্পী হেমেন্দ্রনাথের মাথায় ঘুরতে থাকে বিষয়টা। এক দিন সময় সুযোগ করে পুকুরধারে তাঁর সদ্য-বিবাহিতা রূপসি স্ত্রী সুধারানিকে ভিজে কাপড়ে দাঁড় করিয়ে, বসিয়ে বেশ কিছু ছবি তুলে ফেললেন নানা বিভঙ্গে। হেমেন মজুমদার তাঁর ছবি আঁকার প্রয়োজনে ফোটোগ্রাফের সহায়তা নিতেন। কিন্তু তিনি দস্তুর মতো জানতেন, ফোটোগ্রাফকে হুবহু ‘কপি’ করাটা কারিগরের কাজ। শিল্পীর নয়। ‘এই পরিদৃশ্যমান জগতে যা দেখব যদি তাই আঁকি তবে তার কি প্রয়োজন?’

বেশ কিছু দিন হল হেমেন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাস পড়া শেষ করেছেন। সেখানে ‘রোহিণী’ চরিত্রটি তাঁর মনে সবিশেষ ছাপ ফেলেছে। এই রোহিণী হেমেন্দ্রনাথের বহু ছবিতেই সচেতন এবং অবচেতন ভাবে ঢুকে পড়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রোহিণী প্রসঙ্গে লিখছেন: ‘রোহিণীর যৌবন পরিপূর্ণ’, সে বিধবা কিন্তু তার ‘অধরে পানের রাগ, হাতে বালা, ফিতে পেড়ে ধুতি পরা, আর কাঁধের উপর চারু বিনির্মিতা কালভুজঙ্গিনীতুল্য কুণ্ডলীকৃতা লোলায়মানা কবরী।’ সে ‘ঘাটে উঠিয়া আর্দ্র বস্ত্রে দেহ সুচারুরূপে সমাচ্ছাদিত করিয়া ধীরে ধীরে ঘরে প্রত্যাবর্তন করে’ ইত্যাদি।

এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করি— মজুমদারবাড়ির পারিবারিক ফোটো অ্যালবাম ঘাঁটতে গিয়ে নজর পড়ে ‘মালতী’ লেখা একটি ছবির ওপর। ছবিটি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও চিনে নিতে অসুবিধা হয় না যে এই সদ্যস্নাতা ‘তন্ময়’ ছবির মুখটি ওরই। কে এই মালতী দেবী? খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি হেমেন্দ্রনাথের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে আসে, তা হলে সুধারানি দেবী কোথায় এই ছবিতে? এখানেই কৌশল। ফোটোশপের কায়দায় শিল্পী তাঁর যুবতী স্ত্রী সুধারানির দেহবল্লরিতে মালতীর লাবণ্যময়ী মুখ জুড়ে দিয়ে গড়ে তুলছেন তাঁর মানসপ্রতিমা।

পরেও এই একই কৌশল ব্যবহার করে বহু ছবি এঁকেছেন তিনি। বস্তুত কোনও বিষয়কে চিত্রায়িত করার জন্য তিনি তাঁর ক্যামেরায় তোলা ছবি এবং মডেলকে সামনে রেখে করা ‘লাইফ ড্রয়িং’এর সাহায্য নিতেন রেফারেন্স হিসাবে। হেমেন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যপাঠ, জীবনের প্রাত্যহিকতা আর কল্পনাকে একত্রিত করে অবিসংবাদিত নৈপুণ্যে গড়ে তুললেন সদ্যস্নাতা যুবতীদের সেই ‘চিত্র’। শরীর আর মন নিয়ে এক সূক্ষ্ম খেলায় আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর ছবির দর্শকদের। সাদা শাড়ি, নবনী-লাঞ্ছিত উজ্জ্বল ত্বক সংলগ্ন হয়ে যে ভাবে যৌবনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে শুরু করে, ঠিক একই ভাবে, ক্যানভাসে চিত্রিত মহিলাটি, তাঁর সামগ্রিক শারীরিক উপস্থিতি সত্ত্বেও, দর্শকদের থেকে আড়াল রচনা করে নেয়।

কাঁখে ধরা কলসি থেকে জল পড়ে চলে, আর চার দিকের জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভ্রুক্ষেপহীন সদ্যস্নাতা তার চিন্তার গভীরে হারিয়ে যেতে শুরু করে। এ এক ‘আছি’ আর ‘নেই’-এর খেলা। যে নেই তাকে খোঁজো, যা নেই তাকে ভেবে নাও। এই ভেবে নেওয়া থেকেই তাঁর চিত্রিত কাপড়ের আর্দ্রতা যৌনতার চেতনা উদ্রেক করে, কিন্তু একই সঙ্গে সদ্যস্নাতারা দর্শকদের থেকে মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দরুন গোপন ক্যামেরায় তোলা ‘ভয়ারিস্টিক’ (voyeuristic) ছবির মতো হয়ে ওঠে। ফলত বহু ক্ষেত্রেই এ সব ছবির দর্শক এক অপরাধবোধে আক্রান্ত হন। এ সমস্ত কারণেই হেমেন মজুমদারের ভিজে কাপড়ের ছবি চির কাল বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থেকেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hemen Majumdar Painting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE