Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও পথ চলছে ব্রেমেন

শহরের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে বীর যোদ্ধা রোলান্ডের মূর্তি, গ্রিম ভাইদের রূপকথার প্রাণীরা। এক কালের খানদানি বাণিজ্যনগরী, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে এখানেই গড়ে উঠেছিল বিপ্লবী প্রজাতন্ত্র। শিবাজীপ্রতিম বসু শহরের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে বীর যোদ্ধা রোলান্ডের মূর্তি, গ্রিম ভাইদের রূপকথার প্রাণীরা। এক কালের খানদানি বাণিজ্যনগরী, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে এখানেই গড়ে উঠেছিল বিপ্লবী প্রজাতন্ত্র। শিবাজীপ্রতিম বসু

ঐতিহাসিক:  মার্কেট স্কোয়্যার-এ শতাব্দী প্রাচীন ঘরবাড়ি

ঐতিহাসিক: মার্কেট স্কোয়্যার-এ শতাব্দী প্রাচীন ঘরবাড়ি

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৭ ১২:৪০
Share: Save:

ভাইকিং হ্যাট-পরা মেয়েটা এক চোখ টিপে আমার দিকে সোনালি পিস্তল তাক করল! একটু দূরে কাঠের জাহাজের ডেক-এ কামানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন হ্যাডক-এর কোনও পূর্বপুরুষ। মাস্তুলের জালে ঝুলছে নাবিক। হঠাৎ দেখলে ‘আসল’ ভ্রম হয়। তার পাশে চৌকোনো কাঠের তাল কুড়ুল দিয়ে খণ্ড খণ্ড করে লোহার উনুনের তলায় জ্বালিয়ে নরম গোল রুটি বেক করা হচ্ছে। ব্রেমেন-এর উইসার নদীর চওড়া বাঁধানো পাড়টা যেন হঠাৎ ফিরে গিয়েছে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের হ্যান্সিয়াটিক যুগে!

জার্মানির উত্তর-পশ্চিমে নর্থ সি অভিমুখী মধ্যযুগীয় ‘আধুনিক’ শহর ব্রেমেন। তার পরতে পরতে মিশে আছে ইতিহাস আর আধুনিক জীবন। ডিসেম্বরের এক সকালে ওল্ডেনবার্গ থেকে ট্রেনে ব্রেমেন পৌঁছেছিলাম। শরণার্থী বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষে ওল্ডেনবার্গে আসা। এই মুহূর্তে ইউরোপ, এশিয়া আর আফ্রিকার দেশে সিরীয় শরণার্থী থিকথিক করছে। কেবল জার্মানিতেই এমন শরণার্থী পাঁচ লাখ। সম্মেলনে হপ্তাভর সিরিয়াস আলোচনার মাঝে এক দিন একটু ফুরসত মেলায় সম্মেলনের কর্ণধার লিডিয়া পটস্ বললেন, ব্রেমেন ঘুরে আসুন। এক গবেষককে সঙ্গে দিলেন ‘গাইড’ হিসেবে। হাসিখুশি মেয়েটির নাম ইউনিস। ক্যামেরুনের মানুষ, বহু বছর হল ইউরোপে আছে।

ব্রেমেন স্টেশনটির নির্মাণশৈলীতে মধ্যযুগীয় ক্যাথিড্রালের বিপুল বিস্তারের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন। বাইরে ক্রিসমাস মেলা বসেছে কার্নিভালের ঢঙে। খাদ্য-পানীয়, পণ্যের বিপুল সম্ভার। দোকানের মাথায় বিরাট কাঠের গাধা মুখ-মাথা নেড়ে গান শোনাচ্ছে, জোকার বিচিত্র বাঁশি বাজিয়ে খদ্দের ডাকছে। বিশাল সাইকেল স্ট্যান্ড পেরিয়ে বাস ও ট্রাম স্টেশন, চার নম্বর রুটের টুকটুকে লাল ট্রামে চড়ে শহরের দর্শনীয় স্থানগুলির প্রাণকেন্দ্র মার্কেট স্কোয়ার-এ। দূর থেকে চোখে পড়ল ব্রেমেনের প্রাচীন ‘সিটি ওয়াল’-এর অবশেষ। খ্রিস্টীয় ১০৩২ সালে ব্রেমেনকে রক্ষা করতে এই পাঁচিল তোলা হয়েছিল। এই সময়েই নরওয়ে, ইংল্যান্ড ও উত্তর নেদারল্যান্ডস-এর সঙ্গে ব্রেমেনের বাণিজ্য বাড়তে থাকে। তখন উত্তরের সাগর ও নদীগুলোতে ভাইকিং জলযোদ্ধাদের দারুণ দাপট। জার্মানির লুবেক নগর সেই দাপট ঠেকাতে জেগে উঠছে। ১১৮৬ সাল থেকে ব্রেমেনেরও এক পৃথক রাজনৈতিক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

এরও প্রায় তিনশো বছর পর (১৪০০ সালে) এখনকার জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস, সেই সঙ্গে সুইডেন, পোল্যান্ড, রাশিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও ইস্টোনিয়ার (তখন অবশ্য আজকের চেহারায় এই সব জাতি-রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি) প্রায় ১৬০টি ছোট-বড় নগরে, বাণিজ্য প্রসার ও রক্ষার স্বার্থে একটা জোট বা ‘গিল্ড’ গড়ে ওঠে। ‘হ্যান্সা’ বা ‘হ্যান্সিয়াটিক লিগ’। এই ‘লিগ’ নিজে একটি রাষ্ট্র না হলেও, এর আওতায় থাকা অধিকাংশ নগরই তদানীন্তন শাসনব্যবস্থার মধ্যেই একটা পৃথক, স্বতন্ত্র অস্তিত্বের মর্যাদা পেত। বাণিজ্যিক সাফল্যই ছিল তার সামাজিক মান-মর্যাদার মাপকাঠি। লুবেক-কে বলা হয় ‘হ্যান্সা’-র রানি। ব্রেমেনও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগর, রোমান আমলের মতোই যা ‘ফ্রি ইম্পিরিয়াল সিটি’-র মর্যাদা ভোগ করত।

মার্কেট স্কোয়ার জুড়ে পসরা। খাদ্য-পানীয়, কেক-চকোলেট, হ্যাট, খেলনা, আসবাব, প্রসাধনী, রুপোর গয়না, কী নেই! চত্বরের এক প্রান্তে সেন্ট পিটার ক্যাথিড্রাল-এর রাজকীয় চূড়া, তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ১৪০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রেমেনের বীর রোলান্ড-এর মর্মর মূর্তি। আগে কাঠের মূর্তি ছিল, ১৩৬৬ সালে তা পুড়ে গেলে নগরপিতারা চুনাপাথরের এই মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন। রোমান আমলের কিংবদন্তি বীর যোদ্ধা রোলান্ড। ব্রেমেনবাসীর বিশ্বাস, যত দিন এই মূর্তি অটুট থাকবে, তত দিন ব্রেমেনের স্বাধীনতাও অক্ষুণ্ণ থাকবে। যদি বর্তমান মূর্তিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিস্থাপনের জন্য মূর্তির হুবহু প্রতিরূপ নাকি টাউন হল-এর নীচে গোপন ভল্টে রাখা আছে! এই মূর্তি ও সেন্ট পিটার ক্যাথিড্রাল— দুটিই ইউনেস্কোর হেরিটেজ স্মারক।

ঐতিহাসিক: ব্রেমেন শহরের বিখ্যাত চারমূর্তি ‘টাউন মিউজিশিয়ানস অব ব্রেমেন’।

সেন্ট পিটার ক্যাথিড্রালও এক অনন্য কীর্তি। ৭৮৯ সালে এই গির্জা স্থাপিত, পরে বহু পরিবর্তন ঘটেছে। রেনেসাঁসের পর জার্মানিতে মার্টিন লুথার পরিচালিত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের জেরে প্রটেস্টান্ট ধর্মের প্রচলন হলে, ব্রেমেনের ক্যাথিড্রালটিও তা বরণ করে। গির্জার সুউচ্চ চূড়া দুটি তৈরি হয়েছিল দশম ও একাদশ শতকে। কারুকাজ করা উঁচু আর্চ, জানলায় রঙিন কাচের নকশা, সুউচ্চ ‘অলটার’, কোথাও সোনার জলে খোদাই আদি জার্মান লিপিতে ধর্মকথা। বেশ কিছু মানুষ প্রার্থনার ডেস্কে বসে আছেন। দোতলার গ্যালারিতে অর্গান বাজিয়ে একটি আঠারো-উনিশের মেয়ে ক্রিসমাস ক্যারলের মহড়া দিচ্ছে। একটা খালি বেঞ্চে বসলাম। ইউনিস বলল, আমিও প্রার্থনা সেরে নিই। অবাক হলাম, আমার ধারণা ছিল ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী!

প্রার্থনা সেরে বেরনোর সময় ও-ই বলল, ‘ইউনিস’ আদতে ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর চরিত্র। ক্যামেরুনের যে অঞ্চলে ওর বাড়ি, সেটা ব্রিটিশদের অধীনে ছিল, তাই স্কুলে ইংরেজি চলে। বাকি বেশির ভাগটাই ছিল ফরাসিদের দখলে, সেখানে চলে ফরাসি। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ইউনিসকে ভাল করে ফরাসি শিখতে হল। বিয়ের পর দীর্ঘ দিন রোমে থাকায় সে ইতালীয়তেও দক্ষ। এখন বিবাহবিচ্ছিন্ন, তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে ওল্ডেনবার্গে থাকে। তবে বহু ভাষায় পারদর্শী, দীর্ঘ দিন গবেষণায় যুক্ত ইউনিস জানে না, কোনও দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকা চাকরি পাবে কি না। বলল, ‘ইন ইউরোপ ইট ইজ টাফ, ভেরি টাফ।’

ব্রেমেনের টাউন হল-ও ইউনেস্কোর হেরিটেজ স্মারক। ব্রিক-গথিক স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট নমুনা। হ্যান্সিয়াটিক যুগে এখানেই বসতেন ব্রেমেনের সেনেটের প্রেসিডেন্ট আর শহরের মেয়র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯১৯-এর গোড়ায় সোভিয়েত রাশিয়ার অনুপ্রেরণায় ব্রেমেনে এক মাসের ‘রেভলিউশনারি রিপাবলিক অব ব্রেমেন’ স্থাপিত হয়েছিল, যা পরবর্তী সরকার হটিয়ে দেয়। সেই প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে, টাউন হল-এর সামনে জড়ো হওয়া কয়েক হাজার লোকের ছবি এখনও সেই স্মৃতি বহন করছে।

টাউন হলের নীচেই ছিল সে কালের বণিকদের আড্ডা-পানভোজনের ঠেক। এখনও আছে, বেসমেন্টে। এক-একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি ঘর, দেওয়াল জোড়া প্রাচীন ফ্রেস্কো-র কাজ। বেসমেন্টের পথে পা বাড়াতেই ইউনিসের সাবধানবাণী, ‘স্যর, ভেরি কস্টলি!’ তা হোক, ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিয়ে কিছু কড়কড়ে ইউরো পকেটে ঢুকেছে! ১৯ ইউরো খরচ করে দু’প্লেট অসামান্য ফিশ অ্যান্ড চিপস আর কফি খেলাম।

কাছেই চারটি প্রাণীর ব্রোঞ্জ মূর্তিকে ঘিরে ভিড়। একটা গাধা, তার পিঠে কুকুর, কুকুরের পিঠে একটা বেড়াল, বেড়ালের পিঠে একটা মুরগি! এরাই ব্রেমেনের বিখ্যাত ‘বাজনদারের দল’। আসলে এরা গ্রিম ভাইদের রূপকথা ‘টাউন মিউজিশিয়ানস অব ব্রেমেন’-এর চরিত্র। গল্পে আছে, এই প্রাণীরা এক খামারে ছিল। বয়স হয়ে যাওয়ায় মালিক তাদের খামার থেকে দূর করে দিলে তারা ব্রেমেনের উদ্দেশে রওনা হয়, কারণ ব্রেমেন পরিচিত ছিল স্বাধীনতাপ্রিয়তার জন্য। তারা ব্রেমেনের বাজনদার বনে গেল। সেই গল্পের অনুসরণেই ১৯৫৩ সালে এই মূর্তি বানানো হয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি, গাধার সামনের খুর দুটো চকচকে, সবাই হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস, ওতে ভাগ্য ফিরবে!

মনে হল, এই যে ‘বাইরে’ থেকে চারটি প্রাণীর স্বাধীনতার খোঁজে অন্যত্র চলে যাওয়া, এও তো আদতে ‘মাইগ্রেশন’-এরই গল্প। যুগ যুগ ধরে মানুষের দেশ পালটানোর গল্প। সীমান্তে জাতিরাষ্ট্রের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে কি এই চলাচল পুরোপুরি রোখা যায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE