Advertisement
১১ মে ২০২৪

কেশরীনাথের ঘর বদল

রাজভবনের তিনটি ঘরের নাম বদলে দিলেন রাজ্যপাল। প্রিন্স অব ওয়েলস, লর্ড ওয়েলেসলির বদলে কোনও ঘরের নাম রবীন্দ্রনাথ, কোনওটা বা স্বামী বিবেকানন্দের নামে। কিন্তু তাতে কি ইতিহাস মোছে? বাড়িটাই তো লর্ড কার্জনের ডার্বিশায়ারের বাড়ির আদলে! আবীর মুখোপাধ্যায়রাজভবনের তিনটি ঘরের নাম বদলে দিলেন রাজ্যপাল। প্রিন্স অব ওয়েলস, লর্ড ওয়েলেসলির বদলে কোনও ঘরের নাম রবীন্দ্রনাথ, কোনওটা বা স্বামী বিবেকানন্দের নামে। কিন্তু তাতে কি ইতিহাস মোছে? বাড়িটাই তো লর্ড কার্জনের ডার্বিশায়ারের বাড়ির আদলে! আবীর মুখোপাধ্যায়

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

এক বছর পরেই পলাশির যুদ্ধ। বুড়ো আলিবর্দির মৃত্যুর পরে বাংলার মসনদে তখন তাঁর আদরের নাতি সিরাজ। হঠাৎ খবর পেলেন, কোম্পানি নাকি নতুন গড় বানাচ্ছে কলকাতায়। অমনি তেড়েফুঁড়ে যুদ্ধে চললেন। পঞ্চাশ হাজার সৈন্যসামন্ত, হাতি-ঘোড়া, কামান-গোলাবারুদ। সঙ্গে মীরজাফর, রায়দুর্লভ। দু’দিনে ইংরেজদের সাজানো বাগান তছনছ করে দিলেন। রাতের অন্ধকারে জলপথে চম্পট দিল সাহেবরা। খোশমেজাজে দাদুর স্মৃতিতে কলকাতার নতুন নাম ‘আলিনগর’ দিয়ে মুর্শিদাবাদ ফিরলেন সিরাজ। তার আগে তোপ দেগে ভেঙে দিয়ে গেলেন কোম্পানির প্রথম লাটভবন!

স্বাধীনতার সত্তর বছর পর, ব্রিটিশ শাসকদের স্মৃতি মুছে ফেলতে চেয়ে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী যে রাজভবনের ঘরগুলির নাম বদলে দিচ্ছেন একে একে, এ কিন্তু সে লাটভবন নয়! এই রাজভবন তারও ঢের আগের। কোম্পানির গোড়ার দিকে তখন তিন জন লাটসাহেব! বোম্বাই, মাদ্রাজ ও কলকাতা— তিন প্রেসিডেন্সির তিন গভর্নরই তখন চালচলনে, মেজাজমর্জিতে পুরোদস্তুর লাটসাহেব! পরে তাঁদের মাথা হলেন হেস্টিংস। তিনিই তিন লাটসাহেবের প্রধান, বড়লাট তথা গভর্নর জেনারেল।

এ হেন প্রথম বড়লাটও তাঁর কাজকারবার চালিয়েছিলেন একটি সাধারণ বাড়ি থেকে। সেই বা়ড়ির আইনকানুন ছিল বেজায় কড়া। মিথ্যে বললে, প্রতি মিথ্যে ১ শিলিং! রাত-বিরেতে মাতলামি করলে ৪ শিলিং! কর্মচারীদের কেউ রাত ন’টার মধ্যে না ফিরলে ১০ টাকা জরিমানা! ঠিক হয়েছিল, এই জরিমানার টাকাতেই শহরের খালবিল বুজিয়ে তৈরি হবে নর্দমা।

আরও পড়ুন:প্রাণ বাঁচাল হুইস্কি

১৭৯৮ সালে জাহাজ থেকে নেমে, সেই বাড়ি দেখে ছ্যা-ছ্যা করে উঠলেন কোম্পানির নতুন গভর্নর জেনারেল রিচার্ড ওয়েলেসলি। সাহেব কোম্পানির ডেরাতেই উঠলেন, কিন্তু ঘর-দুয়ার দেখে মেজাজ গেল বিগড়ে। ঠিক হল, নতুন করে গড়ে তোলা হবে লাটভবন। লাটের পছন্দ-অপছন্দ খেয়াল রেখে ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ারের কেডলস্টন হল-এর অনুকরণে নকশা আঁকলেন স্থপতি
চার্লস ওয়েট।

ডার্বিশায়ারের এই ভবনটা নতুন, তৈরি হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে। এটা নরমান্ডির কার্জন পরিবারের এস্টেট। তারই আদলে কলকাতায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হল ১৭৯৯ এর ৫ ফেব্রুয়ারি। এই শহর তখনও জানে না, কেডলস্টন হলের এক উত্তরাধিকারী জর্জ ন্যাথানিয়েল কার্জন ভবিষ্যতে বড়লাট হয়ে এই বাড়িতেই এসে উঠবেন!

চার বছর ধরে কাজ চলল। ১৮০৩ সালে দরজা খুলল আজকের রাজভবনের। জমির দাম তখনকার দিনে ৭১,০০০ পাউন্ড, আসবাবপত্র ১৮০০০ পাউন্ড।

লাটভবনে যখন কাজ চলছে, শ্রীরঙ্গপত্তমে টিপুর সঙ্গে যুদ্ধও চলছে। ১৭৯৯-এর ৪ মে টিপুকে হারিয়ে তাঁর হাতির দাঁতের সিংহাসন নিয়ে এলেন ওয়েলেসলি, তাঁর ঘর সাজাতে। ১৮০২ সালে ৪ মে, লাটবাহাদুর বেছে বেছে সেই টিপুর হত্যার তারিখটাকেই ঠিক করলেন দরবার গৃহপ্রবেশের জন্য। সে দিন সারা কলকাতায় উৎসব। পূর্ণেন্দু পত্রী লিখছেন, ‘ঘরে ঘরে আলোকসজ্জা, আকাশে আতসবাজীর ফোয়ারা, ফোর্টে তোপ, দরবারের দ্বারদেশে রণবাদ্য, ভিতরে অঢেল খানাপিনা, রাত্রি চারটে পর্যন্ত না-থামা নাচ...।’

টিপুর বিপুল ঐশ্বর্যের সঙ্গে বহুমূল্য কার্পেট এনে লাটবাহাদুর পাতলেন রাজভবনের নাচঘরে। একে একে সিঁড়ির নীচে স্ফিংক্সের মূর্তি, দ্বাদশ সিজারের মূর্তি এল।

ঘরগুলি এক-এক জায়গায় এক এক রকম। দোতলায় সকালের জলখাবারের ঘর। তার পূর্ব দিকে লাটসাহেবের মন্ত্রণাসভা। তার পূর্ব দিকে থ্রোন-রুম। সেখানেই টিপুর সিংহাসনটি রেখেছিলেন ওয়েলেসলি। দোতলাতেই মহাভোজের ডাইনিং হলও। আর তিন তলায় কাচ আর কাঠের সাজানো নাচঘর।

রাজভবনের ‘দ্য থ্রোন রুম’

সবই হল, বাড়ি সইল না বড়লাট ওয়েলেসলির! বাড়ি বানানোর বিল দেখে তাঁর ওপর রেগে আগুন কোম্পানি। বার দুয়েক পদত্যাগের ভয় দেখিয়েও ঠেকাতে পারলেন না। দেশে ফিরে গেলেন। কিন্তু লাটভবনের বিলাস-বৈভবের রূপকথার সুতো বুঝি সেই খুলতে শুরু করল। কেউ বর্মার রাজা থিবো-র প্রাসাদের আরশি লাগালেন, তো কেউ লখনউ-এর মার্টিন সাহেবের বাড়ির ঝাড়বাতিদান নিয়ে এলেন। শ্রীপান্থ তাঁর ‘লাটসাহেবি’ লেখায় লিখছেন, ‘লর্ড এলেনবরো বসালেন চিনা কামান.... লর্ড কার্জন বাহারি গ্রিক পাত্র বসালেন।’

এ-ও বাহ্য। লর্ড এলগিন রাজভবনে নিয়ে এলেন প্রথম গ্যাস-সংযোগ। ঠান্ডা-গরম জলের কল বসালেন লর্ড নর্থবুক। লর্ড কার্জনের আমলে এল বিদ্যুৎ, তিন তলা বাড়িতে বসল লিফ্‌ট। এখানেই শেষ নয়, শেষ বিকেলে জলখেলার জন্য সুইমিং পুল করালেন লেডি লিটন, টেনিস কোর্ট বানিয়ে র‌্যাকেট হাতে নামলেন লেডি ডাফরিন।

লাটভবনে লাটবিবিদের বাগান-বিলাসিতাও কিছু কম ছিল না। লেডি আমহার্স্ট প্রথম বাগান করেন কোম্পানির সরকারি হাউসে। প্রাণে সয়নি, তাই সে বাগান তছনছ করে দেন লেডি উইলিয়াম বেন্টিংক! বাগান বেশি দিন শুখা রইল না। এমিলি ইডেন— লর্ড অকল্যান্ডের বোন— ফের নতুন করে লাটভবনের বাগান করলেন। এমিলি আর তাঁর বোন ফ্যানি লাটভবনের ভিতর একটি নকল হ্রদও তৈরি করিয়েছিলেন। কেয়ারি বাগানে মন ছিল আর এক লাটবিবি, লেডি ক্যানিংয়ের। আর বাড়ি ঘিরে সারা বাগানময় বড় বড় গাছ— লর্ড মেয়োর আমলে।

ওয়েলেসলির আমলে সপ্তাহে এক দিন ‘পাবলিক ব্রেকফাস্ট’-এর বন্দোবস্ত ছিল। ছিল ডিনার, গ্র্যান্ড-বল। এক বার নাকি সেই ডি‌নারে ডাক পেয়েছিলেন আটশো সাহেব-বিবি। ভৃত্যসংখ্যার বাড়বাড়ন্তের কথাও লিখে গিয়েছেন অনেকে। লেডি ডাফরিন জানাচ্ছেন, রোজ সকালে নেংটি পরা এক কেলে মালি তাঁকে ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে যায়। কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না!

বাড়িটায় ঐতিহ্যবাহী চারটি স্যুইট ছিল ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলদের নামে। সেগুলিরই নাম বদলে দিয়েছেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। দোতলার উত্তর-পশ্চিমে সবচেয়ে বিলাসবহুল স্যুইটটির নাম ছিল ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা অন্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা কলকাতায় এলে এখানেই উঠতেন। সেই নাম বদলে হয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কক্ষ’। জন অ্যান্ডারসনের নামের স্যুইটটি হয়েছে ‘স্বামী বিবেকানন্দ কক্ষ’। যে রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যার প্রতিবাদে বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডকে চিঠি পাঠিয়ে নাইট উপাধি ত্যাগ করলেন, তাঁর নামে ঘর! আর বিবেকানন্দ তো ওই বাড়িতে পা-ই রাখেননি। স্রষ্টা লর্ড ওয়েলেসলির নামাঙ্কিত স্যুইট আজ ‘সাগর কক্ষ’। ‘ডাফরিন স্যুইট’ হয়েছে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা কক্ষ’।

এই রাজভবনের বিলাসবহুল সোফা, চেয়ার ধূলিমলিন হয়েছিল এক দিন। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট তার দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল সকলের জন্য, সদ্য-পাওয়া স্বাধীনতার আনন্দে লোকে সোফায় উঠে, বাগানে দৌড়ে এন্তার নাচানাচি করেছিল। মার্বেল পাথরের মূর্তিগুলিতে হাত বুলিয়ে খুঁজতে চেয়েছিল সাহেবি বৈভবের রহস্য।

শুধুই বৈভব? এই রাজভবনেই প্রথামাফিক মন্ত্রীদের শপথ পাঠ করান রাজ্যপাল। প্রধানমন্ত্রী এসে রাজনীতিক ও বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে পরিচিত হন। ইন্দিরা গাঁধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এক বার এই রাজভবনেই বাংলার লেখক, শিল্পীদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, সে দিন অনুষ্ঠানে গিয়েও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি তাঁর। দিন কয়েক আগেই জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা, লেখকের নীরবতা তারই প্রতিবাদ।

শুধু লাটসাহেবি নয়, গণতান্ত্রিক দেশের নীরব প্রতিবাদের সাক্ষীও তাই কলকাতার এই রাজভবন। নাম বদলালেই ইতিহাস ধূলিসাৎ হয় না, জনপরিসরের স্মৃতিতে সে অম্লান রয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

The throne room Raj Bhavan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE