Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja

শহুরে জাঁকজমক থেকে দূরে ঘরোয়া ভাবে এখনও হয় দুর্গাপুজো! কোথায় দেখতে যেতে পারেন?

যাঁরা পুজো পরিক্রমায় কিছুটা স্বাদ বদল করতে চান, তাঁরা পুজোর মধ্যেই ঘুরে আসতে পারেন কোনও গ্রামের বাড়িতে। প্রথম পর্বে এমনই তিনটি পুজোর হদিস দিচ্ছে আনন্দবাজার অনলাইন।

গ্রামের বাড়ির পুজো দেখতে চান?

গ্রামের বাড়ির পুজো দেখতে চান? নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৬:২৬
Share: Save:

বারোয়ারি পুজোর রমরমার মধ্যেও বাংলার আনাচকানাচে লুকিয়ে রয়েছে এমন কিছু পুজো, যা মনে করিয়ে দেয় কয়েকশো বছরের ঐতিহ্যের কথা। কালের নিয়মে জৌলুস কমলেও গ্রামবাংলার বেশ কিছু বাড়িতে এখনও পুজো হয় শতাব্দীপ্রাচীন সব রীতিনীতি মেনে। যাঁরা পুজো পরিক্রমায় কিছুটা স্বাদ বদল করতে চান, তাঁরা পুজোর মধ্যেই ঘুরে আসতে পারেন এই বাড়িগুলিতে। প্রথম পর্বে এমনই তিনটি পুজোর হদিস দিচ্ছে আনন্দবাজার অনলাইন।

মহিষাদল, পূর্ব মেদিনীপুর:

পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর বয়স প্রায় আড়াইশো বছর। বারোয়ারি পুজোর ছড়াছড়ির মাঝেও মহিষাদলের এই দুর্গাপুজো ঘিরে মানুষের উন্মাদনায় ভাটা পড়েনি এতটুকুও। একচালা প্রতিমা, ডাকের সাজের গয়না আর রাজবাড়ি দেখতে আজও দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন পর্যটকরা। প্রতিমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এখানে সিংহের রং হয় শ্বেতশুভ্র।

মহিষাদল রাজবাড়ির পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। মুগল আমলে আকবরের সেনাবাহিনীর উচ্চপদে থাকা উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ ব্যবসায়ী জনার্দন উপাধ্যায়ের হাত ধরেই মহিষাদল রাজবাড়ির পত্তন হয়। তিনি মহিষাদলে তিনটি প্রাসাদ তৈরি করেন। রঙ্গীবসনা, লালকুঠি ও ফুলবাগ প্যালেস। পরবর্তী কালে রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর রানি জানকী দেবী ১৭৭৮ সাল নাগাদ দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। সেই সময়ে তৈরি উপাচার মেনেই পুজো শুরু হয় পঞ্চমী থেকে। এখনও রাজপরিবারের সদস্যরা পুজোয় কলকাতা থেকে হাজির হন ফুলবাগ প্যালেসে।

পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর বয়স প্রায় আড়াইশো বছর।

পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর বয়স প্রায় আড়াইশো বছর। নিজস্ব চিত্র

শোনা যায়, আগে দুর্গামণ্ডপের সামনে বিশাল আটচালা ছিল। সেই আটচালাতেই আয়োজিত হত যাত্রাপালা-সহ হরেক অনুষ্ঠান। আড়ালে বসে সেই অনুষ্ঠান দেখতেন রাজপরিবারের মহিলারা। ছিল সন্ধিপুজোর সময়ে কামান দাগার চলও। আটচালা এখন আর নেই। তবে কামান রয়েছে। যদিও সরকারি বিধিনিষেধের কারণে সেই কামান আর দাগা হয় না।

প্রসাদ পাবেন কী ভাবে?

পুজো সবার জন্যই উন্মুক্ত। তবে পুজোর ভোগপ্রসাদ পেতে হলে আগে থেকে যোগাযোগ করতে হয়। রাজবাড়িতে থাকতে চাইলে ওয়েবসাইট থেকে ঘর বুক করতে হয়।

মহিষাদল রাজবাড়ির পুজো হয় বৈষ্ণব মতে।

মহিষাদল রাজবাড়ির পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। নিজস্ব চিত্র

আর কী দেখবেন?

রাজবাড়িতে রয়েছে একটি মিউজিয়াম। সেখানে রাজপরিবারের নানা ঐতিহ্যপূর্ণ জিনিস তুলে ধরা হয়েছে পর্যটকদের জন্য। রয়েছে রাজবাড়িতে রাত কাটানোর সুযোগও। সামনের জলাশয়ে নৌকাবিহার করতে পারেন। প্রশাসনের সহযোগিতায় রাজবাড়িতে তৈরি হয়েছে মিয়াওয়াকি অরণ্য। দেখতে পারেন শতাব্দীপ্রাচীন গোপালজীউ মন্দিরও।

সুরুল জমিদারবাড়ির পুজো, বীরভূম

বীরভূমের সুরুলের জমিদারবাড়ির দুর্গা মন্দিরের পুজো এ বছর ২৮৮ বছরে পড়ছে। পাঁচ খিলানের ঠাকুরদালান, বিরাট থামের নাটমন্দির, নানা রঙের কাচের ফানুস আর বেলজিয়ান কাচের ঝাড়বাতি মনে করিয়ে দেয় সাবেকি ঐতিহ্য আর রাজকীয় জৌলুসের কথা। সারা বছরই পর্যটক আসেন এই জমিদারবাড়ি দেখতে। তবে পুজোর সময়ে বাড়ে দর্শনার্থীর সংখ্যা। জমিদারবাড়ির বাইরে বসে মেলা।

জমিদারবাড়ি সদস্য শিবুপ্রসাদ সরকারের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে বর্ধমান জেলার ছোট নীলপুর অঞ্চল থেকে বাড়ির প্রাণপুরুষরা প্রথম সুরুলে এসেছিলেন। তাঁদের পুত্র কৃষ্ণহরি সরকারের হাত ধরেই এই পরিবারের সমৃদ্ধির সূচনা।

বীরভূমের সুরুলের জমিদারবাড়ির দুর্গা মন্দিরের পুজো এ বছর ২৮৮ বছরে পড়ছে।

বীরভূমের সুরুলের জমিদারবাড়ির দুর্গা মন্দিরের পুজো এ বছর ২৮৮ বছরে পড়ছে। নিজস্ব চিত্র

জমিদারবাড়ির বিশেষ কিছু রীতি রয়েছে পুজোকে ঘিরে। যেমন দিঘিতে স্নান করিয়ে সাবেকি পালকি করে নবপত্রিকা আনা হয়। বলি নিয়েও রয়েছে বিশেষ রীতি। প্রথা অনুযায়ী, এখানে তিন দিন বলি হয়। অষ্টমীর দিন ছাগল, নবমীতে আখ ও সপ্তমীতে চাল কুমড়ো বলি হয়। দশমীর দিন শাঁখ বাজিয়ে শঙ্খচিলের আহ্বান করা হয়।

প্রসাদ পাবেন কী ভাবে?

সকলেই পুজো দেখতে পারেন। পুজোর প্রসাদও পান। তবে তার জন্য আগে থেকে জানাতে হয়। তা ছাড়া, গ্রামের মানুষদের ভোগ খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। কাছারি বাড়িতে রন্ধনশালায় বসে ভেনঘর, মিষ্টান্ন ভোগ হয়। দশ জন কারিগর থাকেন। মিষ্টান্ন ছাড়াও থাকে গাওয়া ঘিয়ের লুচি, সুজি ও ছানা।

জমিদারবাড়ির বিশেষ কিছু রীতি রয়েছে পুজোকে ঘিরে।

জমিদারবাড়ির বিশেষ কিছু রীতি রয়েছে পুজোকে ঘিরে। নিজস্ব চিত্র

কাছাকাছি আর কী দেখবেন?

রাজবাড়ির অনতিদূরেই শান্তিনিকেতন। এক বারে ঘুরে দেখে নিতে পারেন সোনাঝুরি হাট, কোপাই নদী, খোয়াই।

জমিদারবাড়ির বাইরে বসে মেলা।

জমিদারবাড়ির বাইরে বসে মেলা। নিজস্ব চিত্র

গোস্বামীখণ্ড গ্রামের ব্যানার্জি বাড়ির পুজো, পূর্ব বর্ধমান

আউশগ্রামের এই বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন বংশের আদি পুরুষ গোপীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নির্মিত দুর্গামন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় পুরনো মন্দিরের পাশেই ১২৭১ বঙ্গাব্দে একটি নতুন দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন গোপীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রপৌত্র সারদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও গোপালপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই মন্দিরেই এখনও দুর্গাপুজো হয়।

রথের দিন সকালে হয় কাঠামো পুজো। ওই দিনই কাঠামোতে গঙ্গামাটি দেন কুল-পুরোহিত। ষষ্ঠীর দিন সকালে দুর্গা প্রতিমা বেদির উপরে তুলে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় পিছনের দেয়ালের থাকা তিনটি কড়ার সঙ্গে। স্থানীয়দের বিশ্বাস সন্ধিপুজোর সময়ে প্রতিমা দুলে ওঠে, তার জন্যই দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার চল। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত দু’টি বড় প্রদীপ জ্বালানো থাকে। একটি তেলের ও একটি ঘিয়ের। দশমীর দিন কুমারী পুজো হয়।

আউশগ্রামের এই বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন বংশের আদি পুরুষ গোপীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

আউশগ্রামের এই বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন বংশের আদি পুরুষ গোপীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

পুজোর প্রসাদ

সপ্তমী থেকে নবমী, প্রত্যেক দিন মায়ের ভোগের প্রধান পদটি হল কচুর শাক। সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী তিন দিনই বারোটি বিশাল থালায় নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। এ ছাড়া, এই তিন দিন যথাক্রমে সাত, আট ও ন’টি থালায় সাত, আট ও নয় সের গোবিন্দভোগ চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এক সের মানে ৯৩৩.১ গ্রাম। দশমীতে দেওয়া হয় চিড়ে, মুড়কি, দই, বিভিন্ন রকনের নাড়ু ও ফলের ভোগ। সাধারণ মানুষ প্রসাদ পান।

সপ্তমী থেকে নবমী, প্রত্যেক দিন মায়ের ভোগের প্রধান পদটি হল কচুর শাক।

সপ্তমী থেকে নবমী, প্রত্যেক দিন মায়ের ভোগের প্রধান পদটি হল কচুর শাক। নিজস্ব চিত্র

কাছাকাছি আর কী দেখবেন?

রাজবাড়ি দেখতে এসে ঘুরে নিতে পারেন ভাল্কিমাচানের জঙ্গল। দেখতে পারেন আউশগ্রামের কাছে থাকা জলটুঙিও। এটি আসলে জলাশয়ের মধ্যে তৈরি একটি মহল। বর্ধমানের মহারাজ তৈরি করেছিলেন। বছর দুয়েক আগে তা সংস্কার করা হয়। স্থানীয়রা একে বলেন চাঁদনি।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE