Advertisement
E-Paper

নীলাভ সুন্দরী হয়ে প্রতীক্ষায় বড়ন্তি

লালমাটির রোমান্টিক রাস্তা ধরে পাহাড়ি নিসর্গকে দু’চোখে রেখে দিকশূন্যপুরের দিকে যেতে যেতেই হঠাত্‌ থমকাতে হয় এক অপূর্ব লেক দেখে! গাঢ় নীল রঙা সে লেক দেখে মন যেমন বিমোহিত হয়, সৌন্দর্যসুধা আকণ্ঠ পান করে তৃপ্তির আধারও ভরে কানায় কানায়!

বড়ন্তি লেক

বড়ন্তি লেক

সন্দীপন মজুমদার

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৭ ১৭:২৪
Share
Save

লালমাটির রোমান্টিক রাস্তা ধরে পাহাড়ি নিসর্গকে দু’চোখে রেখে দিকশূন্যপুরের দিকে যেতে যেতেই হঠাত্‌ থমকাতে হয় এক অপূর্ব লেক দেখে! গাঢ় নীল রঙা সে লেক দেখে মন যেমন বিমোহিত হয়, সৌন্দর্যসুধা আকণ্ঠ পান করে তৃপ্তির আধারও ভরে কানায় কানায়!

এটাই বড়ন্তি লেক। রামচন্দ্রপুর সেচ প্রকল্পের অন্তর্গত এই লেকটির পোশাকি নাম রামচন্দ্রপুর জলাধার হলেও, লোকে একে বড়ন্তি লেক নামেই বেশি চেনে। বড়ন্তি নদীতে বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে সুন্দর এই জলাধারটি।

আসানসোল কিংবা মুরাডি স্টেশন থেকে আসা পাকা সড়ক ছেড়ে যেই ঢুকে পড়লেন লাল মাটির কাঁচা সড়কে, টিলায় ঘেরা ছোট ছোট আদিবাসী গ্রামের শান্ত স্নিগ্ধ রূপের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে মন তার ভাললাগার উপকরণ পেতে শুরু করবে। পথের শেষ, লেক পেরিয়ে বড়ন্তি গ্রামের কাছে গিয়ে। এখানেই রয়েছে রাত্রিবাসের সুন্দর জায়গা। মুরাডি পাহাড়ের কোলঘেঁষা পথ ধরে লেককে ডান দিকে রেখে পৌঁছনো যায় বড়ন্তি পাহাড়ের ঠিক নীচে। সেখানেই বড়ন্তি গ্রাম।

বড়ন্তি খুব একটা উঁচু পাহাড়ের পর্যায়ে পড়ে না। হেঁটে উঠতে সময় লাগবে খুব বেশি হলে মিনিট পঁয়তাল্লিশ। তবে গাছপালার ঘন জঙ্গলে হাঁটাটার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এক অন্য রোমাঞ্চ।

কোনও শ্বাপদের মুখোমুখি হওয়াও বিচিত্র নয়। তবে, পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে বড়ন্তি লেক-সহ চার পাশের যে অনবদ্য প্রাকৃতিক শোভা দেখা যায় সেটা অবশ্যই হেঁটে ওঠার কষ্টকে ভুলিয়ে দেয়।

সবুজ গাছপালা ঘেরা অসম্ভব সুন্দর বড়ন্তিতে এলে মনে হয়, ভরপুর অক্সিজেন প্রতি মুহূর্তে জীবনীশক্তিকে দ্বিগুণ করছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়া যায় নির্মল আবহাওয়ায়। শরীর মন দুই-ই চাঙ্গা হয়। আর এই চাঙ্গা ভাবটাকে পাথেয় করেই বেরিয়ে পড়া জীবনপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে।

থাকার জায়গা থেকে খুব একটা দূরে নয়। কাজেই হেঁটে যাওয়া যায়। দু’কিলোমিটারের মতো রাস্তা হেঁটে যেতে লাগবে বড় জোর আধ ঘণ্টা। শাল, পিয়াল, পলাশ, আকাশমণি, মহুয়া গাছের ঘন জঙ্গলে ঘেরা লালমাটির পথ দিয়ে হেঁটে যেতে কিন্তু মন্দ লাগে না। গ্রামটির আসল নাম অবশ্য রামজীবনপুর। তবে লোকমুখে রাম ‘বনবাসে’ গিয়ে জীবনপুরটাই থেকে গিয়েছে। ৬০-৬৫ ঘর সাঁওতালদের বাস। প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে একটি। চাষবাস বলতে ধান আর কিছু সব্জি। সেও খুব একটা পর্যাপ্ত নয়। তাই, রুটিরুজির টানে গ্রামের অনেক ছেলেই বাইরে রাজমিস্ত্রি, ডেকরেটর, টাটার কারখানা বা খনিতে মজুরের কাজ করেন। টুসু, ভাদু, বাঁধনা এই সব পরবে এখানে ভাল উত্‌সব হয়। শুধু এই গ্রামই নয়, আশপাশের সাঁওতালদের গ্রামজুড়েও মাদলের দ্রিম দ্রিম ধ্বনিতে, নাচের ছন্দে, মেলার জৌলুসে জমে ওঠে বর্ণময় সব আচার-অনুষ্ঠান। এ সব সময় গেলে এক দারুণ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হওয়া যায়।


বিকেলের পড়ন্ত আলোয় বড়ন্তি

গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই আলাপ হয়ে যায় সহজ-সরল, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত গ্রামবাসীদের সঙ্গে। ওরাই কথায় কথায় জানিয়ে দেয়, কার্তিক মাসে বাঁধনা উত্‌সবের সময় মারাং-বুরু (আদিবাসী দেবতা) পুজোর কথা, কিংবা মাঘ মাসের পরবে ধানসিং-মানসিং (আর এক দেবতা) পুজোর কথা। ওরাই পৌঁছে দেয় গ্রামের প্রান্তে বড়ন্তি নদীর ধারে। ভারী সুন্দর সে নদী এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে। এই নদীর ওপরই বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে বড়ন্তি লেক। জীবনপুর গ্রামে বেশ কিছু ক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরে আসা যায় রিসর্টে।

বড়ন্তি থেকে আধবেলার জন্য গাড়ি ভাড়া করে জীবনপুর দেখে চলে যাওয়া যায় আর এক সুন্দর গ্রাম মানজুড়িতে। বেশ বড় গ্রাম। সাঁওতালদেরই। মাটির দেওয়ালে সুন্দর আলপনার কারুকার্য। দারুণ ভাবে নিকোনো দাওয়া। এ সবই শহুরে অতিথিদের ভাল রকম আকৃষ্ট করে। লাল মাটির মনোরম পথ চলে গিয়েছে তালবেড়িয়া হয়ে পোরেলি গ্রামে। অজস্র পুকুর। হাঁসের দল আর স্নানরত মানুষের পাশাপাশি সেখানে শালুক-শাপলা ভাসে। এই গ্রামের পাশেই পোরোলি পাহাড়। পোরোলি পেরিয়ে মুরাডি হয়ে গোল করে ঘুরে আসা যায় বড়ন্তি লেকের চার পাশটা (যদিও সব জায়গা থেকে লেক দৃশ্যমান নয়)।

অথবা পোরোলি থেকে সোজা চলে যাওয়া যায় অপরূপ পাহাড়ি নিসর্গকে সঙ্গী করে বেড়ো পাহাড়ে। এখানকার পাহাড়ে রক ক্লাইম্বিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বছরের বিভিন্ন সময়ে। ছবির মতো জায়গাটিতে আছে একটি চমত্‌কার মন্দির। খেলাই-চণ্ডী মন্দির। মন্দিরের দেবী মূর্তি বেশ অভিনব।

ইচ্ছে করলে আর পায়ে জোর থাকলে বড়ন্তি থেকে দণ্ডহিতে গ্রামটি থেকেও ঘুরে আসা যায়। এ গ্রামটি অবশ্য সাঁওতালদের নয়। বিভিন্ন গাছের চারা এখানে পাওয়া যায়। অনেক পর্যটক এখান থেকে সে চারা কিনে নিয়ে যান কলকাতাতে। কেউ কেউ আবার সেগুলি রোপণ করেন এই বড়ন্তির মাটিতে।

হাতে আরও দিন দুয়েক সময় থাকলে বড়ন্তি থেকে গাড়ি ভাড়া করে একে একে ঘুরে নেওয়া যায় পাঞ্চেত, মাইথন, গড় পঞ্চকোট, জয়চণ্ডী পাহাড় (‘হীরকরাজার দেশে’ ছবির কিছু দৃশ্যের শ্যুটিং হয়েছিল এখানেই), বিহারীনাথ ইত্যাদি দারুণ দারুণ সব জায়গা। যেগুলোর কোনওটাই বড়ন্তি থেকে খুব একটা দূরে নয় (মাইথন ৩৮ কিলোমিটার, গড় পঞ্চকোট ১২ কিলোমিটার, পাঞ্চেত ২২ কিলোমিটার, জয়চণ্ডী পাহাড় ২১ কিলোমিটার, বিহারীনাথ ১৮ কিলোমিটার)।


বেড়ো পাহাড়

নিতান্তই যদি বেশি ঘোরাঘুরি করতে ভাল না লাগে? তবে? পায়ে হেঁটে এ দিক ও দিকের গ্রামগুলিতে কিছু সময় ঘুরে বেড়ানো যেতে পারে মন্দাক্রান্তা ছন্দে। আর সকালে-বিকালে ঢুঁ মারা যায় লেকের ধারে। বিভিন্ন সময়ে লেকের জলে রঙের নানাবিধ পরিবর্তন হয়। সকালে জলের গাঢ় নীল রং দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তেমনই বিকেলে সূর্য বড়ন্তির উল্টোদিকের পোরেলি পাহাড়ের পিছনে মুখ লুকোয়। সেই মায়াবি ছ’টায় লেকের জল যখন রক্তিম হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই নিঃস্তব্ধ চরাচরে পর্যটকের উদ্বেল মনে উদ্ভাসিত হয় খুশির রামধনু রং। জাগতিক নিয়মেই এক সময় আলো নিভে যাবে। লেকের জলের উপরিতলে লাফানো-ঝাঁপানো বাঁশপাতা মাছের দলকে আর আলোর অভাবে সে ভাবে দেখা যাবে না। তবু, এক আকাশ অনাবিল সৌন্দর্যের বড়ন্তি যে আলো জ্বেলে দেয় মনে, তার দ্যুতি কোনও দিনই হয়তো ম্লান হবে না।

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে দূরত্ব ২৬৩ কিলোমিটার। হাওড়া, শিয়ালদহ কিংবা কলকাতা স্টেশন থেকে ছাড়া যে কোনও ট্রেনে আসানসোল। সেখান থেকে আদ্রা লাইনে তিনটি স্টেশন পরেই মুরাডি। স্টেশনে নেমে গাড়ি কিংবা রিকশাতে করে ছ’কিলোমিটার দূরের বড়ন্তি পৌঁছনে যায়। আসানসোল স্টেশনে নেমেও গাড়ি করেও যাওয়া যায় ৩৮ কিলোমিটার দূরের বড়ন্তিতে। আসার পথে রাস্তায় দিশেরগড় সেতুর আগে ছিন্নমস্তা মন্দির। দিশেরগড় সেতু থেকে দামোদর ও বরাকর— এই দুই নদীর মিলনদৃশ্য অসম্ভব ভাল লাগে। বড়ন্তি থেকে গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরির খরচ ১০ টাকা প্রতি কিলোমিটার। গাড়ি বুকিং-এর ব্যাপারে ৮৬৭০১০২৫৯৫ এই নম্বরে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

কোথায় থাকবেন
১) বড়ন্তি ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড নেচার স্টাডি হাট:
দ্বিশয্যার ঘরের ভাড়া ৬৫০-৯০০ প্রতি দিন।
চার শয্যার ঘরের ভাড়া ৮০০ টাকা প্রতি দিন।
সুইটের ভাড়া ১০০০ টাকা প্রতি দিন।
যোগাযোগ:
৯৮৭৪৮৮৭০৪৬, ৯৪৩৩০৭৭৯৫১

২) বড়ন্তি লেক হিল রিসর্ট:
দ্বিশয্যার ভাড়া ৮০০ টাকা (প্রতি দিন)
চার শয্যার ভাড়া ১০০০ টাকা (প্রতি দিন)
যোগাযোগ: ৯৪৩২২৯৬১৭৮, ৯৫৬৪৯২৫৮৭২

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy