পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া!
চলতি নোট-সংকটে ‘রানার’-এর দশা হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনায় শাসক দলের তাবড় তাবড় নেতা-মন্ত্রীর। কেউ ছেলের বিয়ের মেনুতে কাটছাট করেছেন। কেউ পরিবারের সদস্যের অসুস্থতার সময়ে ব্যাঙ্ক থেকে প্রয়োজনীয় টাকা তুলতে পারছেন না। দলের জেলা কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় দৈনন্দিন খরচ সামলাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তে কয়েক মাসের জন্য বিধায়ক, মন্ত্রী এবং সাধারণ মানুষের পকেটের মধ্যে তেমন ফারাক নেই। আগে যে নেতা প্রতিদিন সকাল-বিকেল নিজের অনুগামীদের দেদার চা, সিঙাড়া খাওয়াতেন তিনিই এখন রীতিমতো মেপে খরচ করছেন। লাগাম পড়েছে দলের তহবিলে। আগে যে নেতা নিজের গাড়ি ছাড়া এক পা বাইরে বেরোতেন না এখন তিনি দলীয় কর্মীর মোটরবাইকের পিছনে বসতে দ্বিতীয় বার ভাবছেন না। কর্মীদের আড়ালে গিয়ে অনেকেই বলছেন, ‘‘ভাগ্যিস সামনে কোনও ভোট নেই। তাহলে যে কী হতো জানি না!’’
রাজ্যের মন্ত্রী তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক পড়েছেন বেশ ফাঁপরে। তৃণমূলের জেলা সংগঠনে কান পাতলেই শোনা যায়, খাদ্যমন্ত্রী কর্মীদের খাওয়াতে ভালোবাসেন। কিন্তু সেই দাপুটে মন্ত্রীই ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বাতিলের পরে সংগঠনের দৈনন্দিন খরচ চালাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। তিনি জানান, প্রতি দিন কমবেশি ৫০-৬০ জন মানুষ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সল্টলেকে তাঁর নিজের কার্যালয়ে কয়েকজন দলীয় কর্মী তিন বেলা পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়া করেন। এছাড়া মধ্যমগ্রামে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও কয়েকজন দলীয় কর্মীর খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া মধ্যমগ্রামে কার্যালয়টির মাসিক ভাড়া রয়েছে। জ্যোতিপ্রিয়বাবুর আক্ষেপ, ‘‘দলীয় অ্যাকাউন্টে টাকা থাকা সত্বেও দলের কার্যালয়ের ভাড়া ও সর্বক্ষণের কর্মীদের বেতন দিতে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া দলীয় কর্মী এবং অতিথিদের মন খুলে খাওয়াতে পারছি না। সন্ধ্যায় কর্মীদের সঙ্গে চা, মুড়ি, তেলেভাজার আড্ডা প্রায় বন্ধ।’’
এতো গেল শাসক দলের সংগঠনের কথা। জনপ্রতিনিধিদের অন্দরমহলেও এখন হাড়ির হাল!
গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ধ্যানেশ নারায়ণ গুহের একমাত্র ছেলে শুদ্ধব্রতের বিয়ে ছিল শুক্রবার। বৌভাত কাল, রবিবার। একমাত্র ছেলের বিয়ের জন্য দু’মাস আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন তিনি। এলাহি আয়োজনের ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিলের পরে সব যেন ঘেঁটে গিয়েছে। হাতে নগদ টাকা না থাকার কমাতে হয়েছে বাজেট। ধ্যানেশবাবুরর কথায়, ‘‘সব্জি, ডেকরেটার্স, মাছ, মাংস সব নগদ টাকায় কিনতে হয়। কিন্তু টাকাই তো হাতে পাচ্ছি না।’’ তাঁর অভিযোগ, বিয়ের কার্ড দেখালে তো আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত তোলা যাবে বলা হলেও তাঁর অভিযোগ, একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে শুক্রবার বিয়ের প্রমাণপত্র দিয়ে আড়াই লক্ষ টাকা চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু ব্যাঙ্ক বলছে টাকা নেই। হাবরা পুরসভার পুরপ্রধান নীলিমেশ দাস বলেন, ‘‘পুরসভার কাজ ফেলে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এ দিকে হাতে নগদ কমে আসছে। কী করবো বুঝতে পারছি না।’’
বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাস জানান, নোট বাতিলের ঘোষণার সময়ে তাঁর কাছে প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট ছিল। সেগুলি তিনি ব্যাঙ্কে জমা করে দিয়েছেন। কিন্তু এখন হাতে নগদ নেই বললেই চলে। তাঁর দাবি, ‘‘টাকার অভাবে গাড়ির তেল কিনতে পারছি না। আমি নিজে বাজার করি। খুচরো না থাকায় বাজারে গিয়েও সমস্যায় পড়ছি। এটিএমেও টাকা আসার সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে যাচ্ছে।’’ অশোকনগরের বিধায়ক ধীমান রায় জানান, এক আত্মীয় গুরুতর অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ব্যাঙ্ক থেকে ২৪ হাজার টাকা তুলতে গিয়েছিলেন। কিন্তু পেয়েছেন মাত্র ১৪ হাজার টাকা। তাঁর ক্ষোভ, ‘‘প্রয়োজন মতো টাকা না পাওয়ায় আত্মীয়ের চিকিৎসা নিয়ে সমস্যায় পড়ে গিয়েছি।’’
৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল ভারতীয় অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে তার জবাব মিলবে ভবিষ্যতে। কিন্তু একটি আচমকা সিদ্ধান্তের পরে দাপুটে নেতা এবং আমজনতার সমস্যা এক্কেবারে মিলে গিয়েছে।
পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি থেকে রাজ্যের মন্ত্রী—সবাই এখন আক্ষরিক অর্থেই জনগণের প্রতিনিধি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy