Advertisement
০৫ মে ২০২৪

বাড়ি-বাড়ি ঘুরে এখনও ‘স্যার’ পড়িয়ে চলেছেন বিনা বেতনেই

এলাকার মানুষ তাঁকে এক ডাকে চেনেন। যত না শিক্ষক হিসাবে, তার চেয়েও বেশি খেলার মাঠের মানুষ হিসাবে। কিন্তু সত্তর বছর পার করা কালিদাস মজুমদার যে বসিরহাট ঘুরে বিনা পারিশ্রমিকে ছাত্রছাত্রীদ পড়িয়ে বেড়ান, সেই খবর ক’জন রাখেন?

নিজের কাজে মগ্ন শিক্ষক। —নিজস্ব চিত্র।

নিজের কাজে মগ্ন শিক্ষক। —নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৫ ০১:৫৬
Share: Save:

এলাকার মানুষ তাঁকে এক ডাকে চেনেন। যত না শিক্ষক হিসাবে, তার চেয়েও বেশি খেলার মাঠের মানুষ হিসাবে। কিন্তু সত্তর বছর পার করা কালিদাস মজুমদার যে বসিরহাট ঘুরে বিনা পারিশ্রমিকে ছাত্রছাত্রীদ পড়িয়ে বেড়ান, সেই খবর ক’জন রাখেন?

বসিরহাটের টাউনহল এলাকায় ইটিন্ডা রাস্তার ধারে কালিদাসবাবুর বাড়ি। মহকুমাশাসকের দফতর থেকে অবসর নেওয়ার পরেও ইংরেজির এই শিক্ষক বিনা পারিশ্রমিকে বছরের পর বছর ধরে স্কুলে পড়িয়েছেন। এখনও সকলের চোখের আড়ালে তা-ই করে চলেছেন। কেন? জবাব আসে— ‘বাবার কথা রাখতে।’

১৯৫৮ সালে কলকাতার আশুতোষ কলেজে আইএ পড়ার সময়ে হাত খরচ চালানোর জন্যই শুরু করেছিলেন টিউশনি। রাজনীতি করতে গিয়ে চারটি বছর নষ্ট হয়। ১৯৬২ সালে ফের কলেজে ভর্তি হন, ১৯৬৮ সালে জেলার কালেক্টরের চাকরিতে যোগ দেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক বাবা প্রমথভুবন মজুমদার চেয়েছিলেন ছেলে শিক্ষক হোক। ১৯৬৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে বড় সংসারের দায়িত্ব সেই চেলের উপরেই বর্তায়। সেই ভার সামলাতেই তিনি ফের গৃহশিক্ষকতা শুরু করেন।

খেলা ছিল তাঁর রক্তে। ১৯৬৪ সালে বসিরহাট মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সাথে যুক্ত হন ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবলে পারদর্শী কালিদাস। ১৯৬৮ সালে সংস্থার সম্পাদক হন। বয়স বাড়ে। বাবার কথা রাখতে না পারার অনুশোচনাও বাড়তে থাকে। এক দিন মনে হয়, এ বারে প্রায়শ্চিত্ত করার সময় এসেছে। ১৯৯৬ সালে ঠিক করেন পারিশ্রমিক ছাড়াই পড়াবেন। অতিথি শিক্ষক হিসাবে সুযোগ এসে যায় ২০০৬ সালে, বড় জিরাকপুর তরুণ সঙ্ঘ হাইস্কুলে ইংরেজি আর ইতিহাস পড়াতে শুরু করেন।

ওই স্কুলের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক রামপ্রসাদ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যায় শিক্ষক কম জেনে বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষকতার ইচ্ছার কথা জানান উনি। ২০১৪ সাল পর্যন্ত এক দিনও স্কুলে আসতে দেরি করেননি। গান-গল্পের মধ্যে দিয়ে ছেলেমেয়েদের এমন সুন্দর করে পড়া বোঝাতেন যে তাঁর ক্লাসের জন্য সকলে অপেক্ষা করে থাকত। কেউ সিলেবাস শেষ করতে না পারলে ছুটির পরে তাদের পড়াতে বসতেন।’’ গরিব ছেলেমেয়েদের বই-খাতাও কিনে দিতেন কালিদাসবাবু, স্কুলের বিশেষ অনুষ্ঠানে আর্থিক সাহায্য করতেন— রামপ্রসাদবাবু জানান। তাঁর কথায়, ‘‘এ বছর যে দিন তাঁকে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হল, সকলের চোখ জলে ভরে গিয়েছিল।’’

এখন বিনি পয়সায় পড়ানোই ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছে কালিদাসবাবুর। সেই কাকভোরে ভাঙাচোরা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন কালিদাসবাবু। এখন তাঁর ৩৫ জন ছাত্রছাত্রী। কেউ তাঁকে ডাকে ‘কাকু’, কেউ ডাকে ‘দাদু’। দুপুরে বাড়ি ফিরে খাওয়া সেরে আবার বেরিয়ে পড়া। পড়ুয়াদের মাথায় পড়া গেঁথে না যাওয়া পর্যন্ত ছাড় নেই। তাই ঘণ্টা মেপে পড়ানোও সম্ভব হয় না। কখনও কখনও বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়।

বিএ দ্বিতীয় বর্ষের পাপিয়া আচার্য, কোয়েল মজুমদার থেকে নবম শ্রণির শঙ্খদীপ পালের কথায়, ‘‘স্যার কখনও আগ্রহীদের পড়াতে বিরক্ত হন না। পড়তে ভাল না লাগলে গান শোনান, গল্প করেন। তাঁর কথার জাদুতে ধীরে-ধীরে পড়ায় মন বসে। এক ঘন্টা-দু’ঘন্টা নয়, পড়া করাতে যত সময় লাগে, স্যার ততটাই দেন।’’ কালিদাসবাবু অবশ্য এত স্তুতিতে অভ্যস্ত নন। মৃদু হেসে তিনি বলেন, ‘‘বেতন দিয়ে পড়ে, এমন সাধ্য অনেকেরই নেই। ওদের কাছে আর কিছু চাই না, ওরা ভাল ফল করলেই আমার আনন্দ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE