Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Cyclone ampan

আমপানের ঋণ এখনও টানছেন বিজন, দেবরাজেরা

ঘূর্ণিঝড় কী ভাবে অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে, তা বোঝাতে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। তা থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২০ সালের ২০ মে, আমপানের পরে বেড়ে গিয়েছিল জেলার বাসিন্দাদের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ। সঞ্চয় ভেঙে বা ধার করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছিল হাজার হাজার মানুষকে। সরকারি ক্ষতিপূরণের টাকা কেউ পেয়েছেন, কেউ পাননি। তারপরেও বাজারে ধারদেনা হয়েছিল বিস্তর। কেউ কেউ সেই ঋণ শোধ করছেন এখনও। আমপানের তিন বছর পরে পরিস্থিতি ফিরে দেখল আনন্দবাজার।

Aftermath of Ampan

আমপানের পরে এই অবস্থা হয়েছিল বহু বাড়ি-ঘরের। ফাইল চিত্র Sourced by the ABP

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৩ ০৯:১৪
Share: Save:

আমপানের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল দুই ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা। হাজার হাজার বাড়িঘর খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। ধ্বংসস্তূপ পরিণত হয়েছিল বহু এলাকা। সেই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করেছিলেন মানুষজন। তিন বছর কেটে গেলেও ঘা এখনও পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি।ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও অনেকে ক্ষতিপূরণের সরকারি টাকা পাননি বলে অভিযোগ। কারও বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে গেলেও তিনি আংশিক বাড়ি ভাঙার টাকা পেয়েছিলেন। ক্ষতিপূরণের টাকা বিলি নিয়ে দুর্নীতির ভুরি ভুরি অভিযোগ ওঠে। বাড়িঘর তৈরি করে মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু দাঁড় করাতে অনেককে ঋণ নিতে হয়েছিল চড়া সুদে। সেই বোঝা এখনও সকলে ঘাড় থেকে নামাতে পারেননি। ধারদেনার টাকা আজও পরিশোধ করে যেতে হচ্ছে।

এঁদেরই এক জন বাগদার বাসিন্দা বিজন হালদার। আমপানে ঘর ভেঙে গিয়েছিল। টিনের বাড়ি পুরোপুরি উড়ে যায়। পঞ্চায়েত থেকে ত্রিপল পেয়ে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু আমপানের কয়েক দিনের মধ্যে ভয়াবহ কালবৈশাখী ঝড়ে সেই ত্রিপলও উড়িয়ে যায়। প্রাণে বাঁচতে ঝড়ের দিন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল বিজনকে।চায়ের দোকান চালান বিজন। ঘর ভাঙার আর্থিক ক্ষতিপূরণ হিসাবে ২০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। কিন্তু নতুন করে ঘর করতে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। ২০ হাজার টাকা সুদে ধার নিয়েছিলেন।

বিজনের কথায়, ‘‘১০ হাজার টাকা শোধ করা এখনও বাকি। চা বিক্রি করে সংসার চলছে কোনও ভাবে। কবে যে ধারদেনা থেকে মুক্তি পাব, জানি না।’’আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন গোসাবার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ। সাড়ে তিন হাজারের বেশি বাড়িঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আংশিক ক্ষতি হয়েছিল হাজার দশেক মানুষের। কিন্তু সরকারি ক্ষতিপূরণের টাকা অনেকেই পাননি বলে অভিযোগ। কেউ কেউ আবার সরকারি ক্ষতিপূরণের টাকা পেলেও তা দিয়ে বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে আরও টাকা ধার করতে হয়েছিল।

গোসাবার রাঙাবেলিয়ার বাসিন্দা দেবরাজ সর্দারের বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়েছিল। তিনি বলেন, “সরকারি ভাবে তদন্ত হওয়ার পরে ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছি। কিন্তু পাকা বাড়ি করতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। বাইরে থেকে লক্ষাধিক টাকা ঋণ করতে হয়েছে। সেই টাকা এখনও সব শোধ করতে পারিনি।”কালিদাসপুরের বাসিন্দা সুনন্দা মণ্ডল বলেন, “আমার বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে গেলেও এখনও ক্ষতিপূরণ পাইনি। আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা ধার করেছিলাম। কোনওমতে টিনের ঘর করে বাস করছি। এখনও সকলের টাকা শোধ করতে পারিনি।”

হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের রূপমারি পঞ্চায়েতের কাছারিপাড়ার বাসিন্দা সুদর্শন সর্দারের বাড়ি ডাঁসা নদীর বাঁধ ভেঙে ডুবে গিয়েছিল। এক বছর ঘর ছাড়া ছিলেন। সরকারের করে দেওয়া পাকা বাড়ি যেখানে ছিল, সেখানে দীর্ঘ দিন নদীর জোয়ার-ভাটা খেলত। বছরখানেক পরে যখন বাড়িতে ফিরলেন, সুদর্শনেরা দেখেন, নদীর পলি জমে গিয়েছে ঘরের মধ্যে। বসবাসের অযোগ্য হয়ে গিয়েছে। দেওয়ালে ফাটল। জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

সরকারি ক্ষতিপূরণের ২০ হাজার টাকা পেলেও তাতে বাড়ি করে সংসারের জিনিসপত্র কেনা সম্ভব ছিল না। এক বছর ধরে কার্যত কোনও আয় ছিল না সুদর্শনের। প্রায় ৪০ হাজার টাকা সুদে ধার নিতে হয়েছিল। এখন মাসে ১০০ টাকায় ৭ টাকা সুদ গুনতে হচ্ছে। এখনও ঋণ শোধ করা হয়ে ওঠেনি।সুদর্শন বলেন, “এখানে তেমন কাজ নেই। ছেলে ভিন্‌ রাজ্যে গিয়েছে। সেখান থেকে যা পাঠায়, তা দিয়ে সুদ গুনছি। আমি তেমন কাজ করতে পারি না। জানি না, কবে ঋণ পরিশোধ করতে পারব।”

ঘোড়ামারা দ্বীপের বাসিন্দা উত্তম পড়ুয়া পেশায় দিনমজুর। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছ’জন। আমপানের আগে উত্তমের মাটির দেওয়াল, টালির ছাউনির বাড়ি ছিল। ঝড়ে টালির ছাউনির একাংশ উড়িয়ে নিয়ে যায়। ঘরের উপরে তিনটি বড় গাছ পড়েছিল। বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তিনি কোনও সরকারি আর্থিক সাহায্য পাননি বলে জানালেন। গ্রামের মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী থেকে ঋণ নিয়ে ঘরবাড়ি মেরামত করেছিলেন। উত্তমের কথায়, ‘‘সেই ধারদেনা পরিশোধ করার আগেই আবার ইয়াসের কবলে পড়েছিলাম। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম। সে বারও আর্থিক সাহায্য পাইনি।’’

সাগরের ধবলাট অঞ্চলের শিবপুর এলাকার বাসিন্দা পরিমল জানা পরিযায়ী শ্রমিক। স্বামী-স্ত্রী, দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার। আমপানে ঘরবাড়ি ও পানের বরজ ভেঙে গিয়েছিল। বহু বার পঞ্চায়েতে ছোটাছুটি করে শেষ পর্যায়ে কোনও রকম ৫ হাজার টাকা সরকারি সাহায্য মিলেছিল। গ্রামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে ঘরবাড়ি মেরামতি করেন। টাকা শোধ করার আগে ইয়াসে ফের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তিনি বলেন, ‘‘ইয়াসের পর ফের ঋণ নেওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করতে হয়েছিল। লোকজন বলে, কিছু জিনিস বন্ধক রাখলে তবে ঋণ দেবে। কিন্তু আমার তো কোনও সম্পত্তি নেই। কী আর বন্ধক দেব! বার বার অনুরোধ করায় দ্বিতীয় বার ঋণ পেয়েছিলাম। ঋণের টাকা পরিশোধ করতে কেরলে কাজ করতে গিয়েছিলাম। কয়েক মাস কাজ করে কিছুটা ধারদেনা শোধ করতে পেরেছি। এখনও কিছু বাকি। আপাতত বাড়ির কাছে মজুরের কাজ করি।’’

ঘরভাঙা মানুষেরা কবে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবেন জানেন না। আকাশে ঘন মেঘ দেখলে তাঁরা প্রমাদ গোনেন। এক বৃদ্ধের কথায়, ‘‘এমনিতেই তো মরে আছি। প্রকৃতি আর কত যে মারবে!’’

তথ্য: সীমান্ত মৈত্র, নবেন্দু ঘোষ, প্রসেনজিৎ সাহা ও সমরেশ মণ্ডল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone ampan compensation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE