ঠিক পাঁচ বছর আগের কথা। সে বার পুরভোটে মাত্র ৩টি আসন নিয়েই থেমে গিয়েছিল তৃণমূলের দৌড়। বাদুড়িয়া পুরসভা ১৭টি আসনের মধ্যে ৭টি আসন পেয়ে তৃণমূলের সমর্থনেই বোর্ড গড়েছিল কংগ্রেস। সিপিএম সে বার পেয়েছিল বাকি ৭টি আসন।
এ বার অবশ্য ছবিটা আমূল বদলে গিয়েছে। কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি বাদুড়িয়ায় বোর্ড গড়তে চলেছে তৃণমূল। বসিরহাট মহকুমার তিনটি পুরসভা নির্বাচনে বাদুড়িয়ায় একক ভাবে ৯টি আসন দখল করে সব থেকে ভাল ফল করেছে তারা।
গত বার বোর্ড গঠনের তিন বছরের মধ্যেই কংগ্রেস কাউন্সিলরেরা তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় অবশ্য বোর্ড ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল। কিন্তু এ বার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সুবাদে সে সবের তোয়াক্কা করতে হবে না তাদের। কিন্তু কোন জাদুতে এমন ফল এখানে করে দেখাল শাসক দল? কেনই বা উত্তর ২৪ পরগনা জেলার একমাত্র শক্তঘাঁটি বাদুড়িয়ায় ভরাডুবি হল কংগ্রেসের? অনুন্নয়ন নিয়ে এখানে অভিযোগ ভুরি ভুরি। এলাকার বিস্তীর্ণ অংশ এখনও পঞ্চায়েতের চেহারায় থেকে গিয়েছে। রাস্তাঘাট, পানীয় জল, নিকাশি, যোগাযোগ ব্যবস্থা— সব কিছু নিয়েই ক্ষোভ আছে প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো এই পুর এলাকার মানুষের। শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে ইছামতী নদী। তা সত্ত্বেও নিকাশি বেহাল। বর্ষার দিনে প্লাবিত হয় এলাকা। এখনও কয়েকটি ওয়ার্ডে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। ভেঙে পড়েছে পার্ক। কোনও কলেজ নেই। কাছেপিঠে রেললাইনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি।
গত বিধানসভা ভোটে গোটা জেলায় কংগ্রেসের একমাত্র বিধায়ক কাজি আবদুল গফ্ফর জিতেছিলেন বাদুড়িয়া থেকেই। দীর্ঘ দিন ধরে পুরসভায় ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুন্নয়নের যে দীর্ঘ তালিকা, তা এ বার কংগ্রেসের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুলনায় মাত্র দু’বছর ক্ষমতায় এলেও তৃণমূল কাউন্সিলর তথা ব্লক তৃণমূল সভাপতি তুষার সিংহের জনপ্রিয়তা মানুষ সদর্থক ভাবে নিয়েছেন বলে মনে করেন স্থানীয় অনেক মানুষই। যদিও তুষারবাবুর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত নানা সমালোচনা শোনা যায় বিরোধী শিবিরে। তাঁর অর্থের উৎস সম্পর্কে নানা কথা ভাসে বাদুড়িয়ার বাতাসে। যদিও সে সব সমালোচনার তোয়াক্কা করেন না তুষারবাবু।
অন্য দিকে, কংগ্রেসের সাত জন কাউন্সিলর ২০১০ সালের টিকিটে জয়ী হয়েও যে ভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই তৃণমূলে ভিড়েছিলেন, তা-ও ভোলেননি মানুষ। সাংগঠনিক দুর্বলতা যে ছিল, তা মানছেন কংগ্রেস নেতা সুশান্ত ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সঠিক পরিকল্পনা এবং অর্থের জোরের কাছে হার মানতে হল।’’ ইঙ্গিতটা তৃণমূলের দিকে বলাইবাহুল্য। যদিও সে কথা মানতে চাননি তৃণমূল নেতৃত্ব। এ বার তুষারবাবুর নামই একমাত্র উঠে আসছে পুরপ্রধানের চেয়ারের দাবিদার হিসাবে। তিনি বলেন, ‘‘সারা বছর মানুষের পাশে থেকে তাদের আপদে-বিপদে সাহায্য করাই হল আমাদের সাফল্যের মূল মন্ত্র। তা ছাড়া, এলাকার উন্নয়নের চেষ্টা সাধ্যমতো করা হয়।’’ বাদুড়িয়ার উন্নয়নের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া প্রতিশ্রুতিও মানুষের মনে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন তিনি।
বসিরহাট-টাকিতে সন্ত্রাস, ছাপ্পা ভোট, ইভিএম ভাঙার অভিযোগে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। দু’টি পুরসভার ৯টি বুথে ফের ভোট নিতে হয়েছে। কিন্তু বাদুড়িয়ায় দুষ্কৃতীদের দাপাদাপি ছাড়াই ভোট মিটেছে শান্তিতে। গত লোকসভা ভোটের নিরিখে বাদুড়িয়া পুর এলাকায় ১৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ৯,১৫৯টি ভোট। তৃণমূল পেয়েছিল ৭,৯৬০টি ভোট। সিপিএম ৭,৩৫৭টি এবং কংগ্রেস সব থেকে কম ৭,০০৯টি ভোট পেয়েছিল। লোকসভা ভোটের নিরিখে ৮টি ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল বিজেপি। এ বার পুরভোটে বিজেপিকে ৩টি ওয়ার্ড পেয়ে বাদুড়িয়ায় এই প্রথম খাতা খুলেছে তারা। রাজ্য জুড়ে বামপন্থীদের আন্দোলন-বিমুখতার কথা বাদুড়িয়াতেও অন্য রকম কিছু নয়। স্থানীয় বাম মনোভাবাপন্ন বহু মানুষের বক্তব্য, সারা বছর পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলনে দেখাই যায়নি। এত যেখানে অনুন্নয়ন নিয়ে ক্ষোভ, সেখানে পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ তুলে নূন্যতম স্মারকলিপি দেওয়ার ব্যাপারেও অনীহা দেখা গিয়েছে দলের সামনের সারির স্থানীয় নেতাদের। এ বার দু’টি মাত্র আসন পেয়েই সস্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাদের। অথচ, বাদুড়িয়া পুর এলাকার আশপাশের অধিকাংশ পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদে ক্ষমতায় আছে বামেরা। তা সত্ত্বেও পুর এলাকার নাগরিক সমস্যাগুলি নিয়ে তেমন জোরদার আন্দোলন দেখা যায়নি গত পাঁচ বছরে। পুরভোটের প্রচারে দলের কোনও হেভিওয়েট নেতাও আসেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy