Advertisement
১৯ মে ২০২৪

ফাল্গুনীর হাত ধরে স্বনির্ভর হচ্ছেন গ্রামের গরিব মহিলারা

মাসে ১০টা মাত্র টাকা। একটু একটু করে গাঁয়ের কয়েকজন মহিলা সেই টাকাই জমাতে শুরু করেছিলেন। শুরু করেন ব্যবসা। পরে ব্যাঙ্কঋণ মেলে।

সসম্মানে: কাজে ব্যস্ত ফাল্গুনী। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

সসম্মানে: কাজে ব্যস্ত ফাল্গুনী। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৭ ০২:১১
Share: Save:

মাসে ১০টা মাত্র টাকা।

একটু একটু করে গাঁয়ের কয়েকজন মহিলা সেই টাকাই জমাতে শুরু করেছিলেন। শুরু করেন ব্যবসা। পরে ব্যাঙ্কঋণ মেলে। ধীরে ধীরে নিজের পায়ে দাঁড়াতে থাকে মহিলা পরিচালিত স্বনির্ভর গোষ্ঠী। এখন সেই গোষ্ঠীর কেউ স্বামীকে ভ্যান কিনে দিয়েছেন। কারও বাঁশের চালের বাড়ি পাকা হয়েছে।

মূল উদ্যোগটা যাঁর, সেই ফাল্গুনী বিশ্বাস তখন সবে মাধ্যমিক পাস তরুণী। কিন্তু তখন থেকেই স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ার চিন্তা তাঁর মাথায়। পরে নিজে স্নাতক হয়েছেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে আর্থিক ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। আশপাশের গাঁয়ের বহু মহিলাকে সসম্মানে বাঁচতে শিখিয়েছেন।

বনগাঁ মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা ২০০০ সালে দুর্গাপুজোর আগে বন্যার কবলে পড়েছিল। বাগদা ব্লকের অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। বহু মানুষ গাছে রাত কাটিয়েছিলেন। অনাহারে থেকেছেন দিনের পর দিন। ফাল্গুনীর চোখ খুলে দেয় সেই পরিস্থিতিটাই।

সিন্দ্রাণীর কালীতলা এলাকার বাসিন্দা সদ্য মাধ্যমিক পাশ মেয়েটি বুঝে নেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামলাতে গেলে টাকার জোগান দরকার মানুষের হাতে। বাড়ির মহিলাদের জন্য কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করেন তখনই। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে দশজন মহিলাকে নিয়ে তিনি করে ফেলেন ‘মোনালিসা’ স্বনির্ভর গোষ্ঠী।

আজ থেকে এত বছর আগে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ধারণাটা তখনও খুব জনপ্রিয় নয়। তবু চ্যালেঞ্জটা নিয়েই ফেলেন ফাল্গুনী। তিনি জানালেন, গোষ্ঠীর সদস্যেরা প্রতি মাসে ১০ টাকা দিয়ে একটি তহবিল তৈরি করেন। ছ’মাস ওই ভাবে টাকা জমিয়ে মুরগির ছানা কেনা হয়। পরে ব্যাঙ্ক থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ মেলে। ওই ঋণের টাকায় কেউ ফুল চাষ, কলা চাষ, ছাগল-মুরগি চাষ, মাছ চাষ শুরু করেন। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বছর চৌত্রিশের ফাল্গুনীদেবী এ ক’বছরে এলাকায় প্রায় দেড়়শো স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করেছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় এখন মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিতে পাঠানো হয়। কী ভাবে জীবন-জীবিকা পাল্টে স্বনির্ভর হওয়া যায়, তা নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা মেয়েদের শোনান ফাল্গুনী।

বাগদা ব্লক শিল্পোন্নয়ন আধিকারিক তপোজ্যোতি ঘোষ বলেন, ‘ফাল্গুনীদেবী গ্রামের গরিব মহিলাদের বাড়ি থেকে হাত ধরে টেনে এনে আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর করছেন। মহিলাদের সমাজে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে শেখাচ্ছেন।’ বিডিও মহম্মদ জসিমুদ্দিন মণ্ডলও ফাল্গুনীদেবীর কাজের তারিফ করেন।

ফাল্গুনী জানালেন, শুরুর দিকে মহিলাদের বোঝাতে রীতিমতো প্রাণপাত করতে হয়েছে। বাড়ির পুরুষদের থেকে, পাড়া-প্রতিবেশীদের থেকে নানা আপত্তি এসেছে। কিন্তু দমে যাননি ফাল্গুনী।

প্রথমে কলাচাষ দিয়ে শুরু করে পরে সব্জি চাষ করেন ফাল্গুনী আর তাঁর স্বামী বিকাশবাবু। ওষুধের দোকানও করেছেন। রাঘবপুরের বাসিন্দা শম্পা রায়ের স্বামী দিনমজুরি করতেন। পরে ফাল্গুনীদেবীর স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে সামিল হন শম্পা। সেখান থেকে ঋণ নিয়ে স্বামীকে ভ্যান কিনে দেন শম্পা। এখন পারিবারিক কাঠের ব্যবসা আছে। দুই মেয়ের লেখাপড়া এগোচ্ছে তরতরিয়ে। শ্যামলী বিশ্বাস, আলো রায়ের মতো বহু মহিলাও আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হয়েছেন ফাল্গুনীদেবীর সঙ্গে কাজ করে।

কিন্তু কোথা থেকে পেলেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরির ভাবনা? ফাল্গুনী জানান, শুরুতে এক মৎস্য দফতরের এক আধিকারিক তাঁকে স্বনির্ভর গোষ্ঠী সম্পর্কে বলেন। তৎকালীন মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দের সঙ্গে পরিচিতির সূত্রে তিনিই উৎসাহ দেন। পরে স্থানীয় এক ব্যক্তিও পাশে দাঁড়ান সদ্য তরুণীর।

এখন ফাল্গুনীর স্বপ্নের শরিক আশপাশের গাঁয়ের বধূরাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

self dependent Women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE