এখন এ পথেই পারাপার করেন বহু মানুষ।
এক পারে পুরসভার ১২টি ওয়ার্ড, অন্য পারে ৫টি। মাঝে গা এলিয়ে বয়ে যাচ্ছে ইছামতী। বছরের পর বছর ধরে মানুষের দাবি, একটা সেতু তৈরি হোক নদীর উপরে। পুরসভায় আসার ঝক্কি তা হলে অনেকটাই কমে। ব্যবসায়ীদের সুবিধা হয়। আইন-শৃঙ্খলারও উন্নত হয়। এখন তো নদীর এক পারে চুরি-ডাকাতি ঘটলে খবর পেয়ে অন্য পার থেকে পুলিশ আসতে আসতে দুষ্কৃতীরা যে যার মতো ধাঁ হয়ে যায়। ঘটা করে জমি মাপা হয়েছে টেন্ডার হয়েছে, শিলান্যাস তা-ও সারা হয়েছে কয়েক দফায়। ১৪৫ বছরের পুরনো এই বাদুড়িয়া পুরসভার বাসিন্দাদের দাবি মেনে সেতু তৈরি হয়নি আজও। উন্নয়ন নিয়েও দু’পাড়ের মধ্যে চাপানউতোর আছে। আছে মান-অভিমানও। যেন সুয়োরানি-দুয়োরানির গল্প।
ডাঙা পথে পুরসভায় আসতে গেলে নদীর এক পারের মানুষকে কম করে ২০ কিলোমিটার উজিয়ে আসতে হয়। তা না করলে অবলম্বন নৌকো। বৃষ্টির দিনে জল পথে পারাপারে স্বচ্ছন্দ নন অনেকে। পড়ুয়াই হোক বা অসুস্থ মানুষ, মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে অনেককে অবশ্য জলপথের উপরেই নির্ভর করতে হয়। না হলে উপায়ই বা কী! কথা হচ্ছিল পুঁড়োর বাসিন্দা আব্দুল সেলিম মণ্ডল, শুভাশিস ভট্টাচার্যদের সঙ্গে। বললেন, “নদীর অন্য পারে বাড়ি হওয়ায় আমরা যেন একটি দ্বীপভূমির বাসিন্দা হয়ে রয়েছি। কোনও প্রকল্প নেই। কোনও উন্নয়ন নেই। নদী পারাপারের অসুবিধার জন্য আমাদের ছেলেমেয়েরা বাদুড়িয়া শহরের ভাল স্কুলে পড়তেও যেতে পারে না। এমনকী, পুঁড়ো থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে পুরসভা হলেও সেখানে কাজ মেটাতে গেলে নদীপথই ভরসা। সড়ক পথে যেতে হলে ২০ কিলোমিটার পেরোতে হয়।” এই বাসিন্দাদের বক্তব্য, সেতু হলে নদীর দু’পারেই অফিস-কাছারি, স্কুল হবে। দু’পারেই ব্যবসা বাড়বে। এক কথায় এখানকার জীবনযাত্রা বদলে যাবে।”
২০১০ সালে লক্ষ্মীনাথপুর গ্রামে তত্কালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত, পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামী এবং জনস্বাস্থ্য ও কারিগরী দফতরের মন্ত্রী গৌতম দেবের উপস্থিতিতে প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ইছামতীর উপরে সেতুর শিলান্যাস হয়। নদীর দু’পারে অ্যাপ্রোচ রোড ছাড়া সেতুর টেন্ডার হতে হতে আরও কয়েক মাস কেটে যায়। পূর্ত ও সড়ক দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সালে টেন্ডার হওয়ার পরে জমি পেয়ে সেতুর কাজ শুরু করতে করতে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাস গড়িয়ে যায়। তিন বছরের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নানা রকম জটিলতায় ২০১৬ সাল নাগাদ তা শেষ হওয়ার কথা। ৪১০ মিটার লম্বা এবং ফুটপাথ-সহ ১১ মিটার চওড়া হবে সেতুটি। বর্তমানে নদীর দু’পারে দু’টি পিলারের বেশ কিছুটা অংশ-সহ রাস্তার কাজ অনেকটাই হয়ে গিয়েছে পুঁড়োর দিকে। নদীর উল্টো দিকে অবশ্য এখনও জমির জটিলতায় রাস্তার কাজ বিশেষ এগোয়নি। এলাকাবাসীর বক্তব্য, কাজের গতি অনেকটাই স্লথ। কবে জমির বিবাদ মিটে রাধা নাচবে, কবেই বা পুড়বে সাত মণ তেল সে সবের জন্য ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারেন সাধারণ মানুষ! বাদুড়িয়া শহরের এক দিকে উত্তর দিয়াড়া, আরশুলা, মাগুরুতি, তারাগুনিয়া, চরপাড়া, লক্ষ্মীনাথপুর, শ্রীরামপুর। অন্য পারে লক্ষ্মীনাথপুর, পুঁড়ো, খোড়গাছি, ফতুল্যাপুর, ভোজপাড়া, ফরিদকাটি, কাটিয়াহাট। একদা নদী পথে সীমান্তবর্তী গ্রাম-সহ সুন্দরবন এলাকা থেকে পাট আসত বাদুড়িয়ায়। সে সময়ে বাদুড়িয়া ছিল পাট শিল্পে এ রাজ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। বাদুড়িয়ার পাট দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তো বটেই, পাড়ি দিত বিদেশের বাজারেও। স্থানীয় মানুষের আক্ষেপ, সে সময়ে বাদুড়িয়াতে পাটের জোগান থাকলেও কোনও পাটজাত দ্রব্যের কারখানা ছিল না। আজ বাদুড়িয়াতে একাধিক পাটজাত দ্রব্যের কারখানা হলেও কেবল মাত্র পরিবহণের সমস্যায় বাজার ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়েছে। চাষিরা অনেক টাকা খরচ করে বসিরহাট কিংবা তেঁতুলিয়া সেতু পার করে তবেই পাট বাজারে পাঠাতে পারেন। সেতু হলে সেই ঝক্কি কমত।
এই সেতুই হবে মুশকিল আসান, মনে করেন বাদুড়িয়াবাসী।
আরশুলা গ্রামের শৈলেন কাবাসি এবং উত্তর দিয়াড়ার নুরুল ইসলামরা জানালেন, ইছামতীর পারে তারাগুনিয়া গ্রামে প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের ঐতিহ্যবাহী পুরনো বারো মন্দির এবং পীরের দরগায় (রওসন বিবি) সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানে দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন। পূণ্যার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকাতেই আসতে হয়। এক সময়ে বাদুড়িয়ায় বিচালি, গোলপাতা এবং গুড়ের হাট বসত। ওই গুড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল চিনির কল। সেই চিনির নাম ছিল ‘খান্দেসি’। যা দেশের অন্যত্রও নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের সেই সুদিন আর নেই। বাদুড়িয়ায় সুপারির ব্যবসা বেশ রমরমা হলেও সেতু তৈরি হলে তা আরও বাড়বে বলে মনে করেন অনেকেই।
সেতু না হওয়ায় অন্য অসুবিধার পাশাপাশি যাতায়াত খরচও যে বাড়ে, সে কথা মনে করিয়ে দিলেন অনেকে। নদী পেরোতে মাথা-পিছু ২ টাকা লাগে। সাইকেলের জন্য লাগে আরও ২ টাকা। মোটর বাইক হলে এক পিঠে নদী পেরোতে খরচ পড়ে ১২ টাকা। এক ঝুড়ি সব্জির জন্য গুণতে হয় ৫ টাকা। দিনে দু’তিন বার পারাপার করতে গেলে খরচ যা দাঁড়ায়, তাতে গরিব-গুর্বো মানুষের সমস্যা তো হবেই। ফেরিঘাটের কাজে যুক্ত এক ব্যক্তি বললেন, “কী করব? বছরে ১০ লক্ষ টাকারও বেশি দিয়ে ঘাট লিজে নেওয়া হয়েছে। মাঝি-মাল্লাদের খরচ আছে। তাই ভাড়া এর থেকে কম নেওয়ার উপায় থাকে না। বরং কিছুটা বাড়ালে আমাদের সুবিধা হয়।”
সেতু হলে আরও কিছু মুশকিল আসান হতে পারে। প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সীমান্ত বাণিজ্যের ট্রাক এখন কলকাতা-বারাসাত হয়ে সোজা আসে বসিরহাটে। সেখান থেকে ওল্ড সাথক্ষীরা রোড হয়ে চলে যায় ঘোজাডাঙা সীমান্তে। বাদুড়িয়ায় সেতু হলে বসিরহাটের পরিবর্তে বেড়াচাঁপা দিয়ে বাদুড়িয়া এবং কাটিয়াহাট হয়ে সোজাসুজি ট্রাক চলে যেতে পারবে ঘোজাডাঙা সীমান্তে। তাতে এক দিকে যেমন বসিরহাট শহরের যানজট কমবে, তেমনি ঘোজাডাঙায় যেতে অনেকটা পথ কম পেরোতে হবে। পরিবহণ খরচ কমবে। পাশাপাশি বাদুড়িয়া দিয়ে সীমান্ত বাণিজ্য শুরু হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের চেহারাটাই পাল্টে যাবে বলে মনে করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তারাগুনিয়ার সুব্রত বিশ্বাস, খালেক মণ্ডল বলেন, “সেতু হলে নদীর অন্য পাড়ে পুঁড়ো, কাটিয়াহাট এলাকার মানুষকে আর তেঁতুলিয়া এবং বসিরহাট হয়ে ঘুরপথে বাদুড়িয়ায় পৌঁছতে হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্য ভাল হবে। আখেরে গোটা বাদুড়িয়ারই উন্নয়ন হবে।”
(চলবে)
• ২০১০ সালে প্রায় ২২ কোটি টাকায় সেতুর শিলান্যাস হয়।
• ইছামতীর দু’পারে অ্যাপ্রোচ রোড ছাড়া সেতুর টেন্ডার হতে আরও কয়েক মাস কেটে যায়।
• ২০১১-এ টেন্ডার হলেও কাজ শুরু ২০১২-র জানুয়ারিতে।
• তিন বছরে শেষের কথা থাকলেও নানা জটিলতায় ২০১৬ সাল নাগাদ কাজ শেষ হওয়ার কথা।
কাটিয়াহাটে ফাঁড়ি আছে। কিন্তু নদীর ও পাড়ে চারটি পঞ্চায়েত ও পাঁচটি ওয়ার্ড। প্রয়োজনে পুলিশের বড় দলকে বাদুড়িয়া থানা থেকে ও দিকে যেতে হলে অনেকটা ঘুরপথ ধরতে হয়। সেতু তৈরি হলে সেই সমস্যা আর থাকবে না।
কল্লোল ঘোষ বাদুড়িয়া থানার ওসি
চৌমাথা থেকে লরি স্ট্যান্ড হয়ে লক্ষ্মীনাথপুর গ্রামকে ডান দিকে রেখে সরকারি জমির উপর দিয়ে সেতুর অ্যাপ্রোচ রোড তৈরি হওয়ার কথা ছিল। সে ক্ষেত্রে ক্ষতি কম হত। পরিবর্তিত পরিকল্পনায় ইটভাটা, চাষ জমির উপর দিয়ে রাস্তা হওয়ার কথা। কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জট কাটানো যাবে আশা করছি।
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, বাদুড়িয়ার পুরপ্রধান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy