একটি রাজনৈতিক দলের সভায় ইভিএম মেশিন ব্যবহার শেখানো হচ্ছে। স্বরূপনগরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
ভোট আসে ভোট যায়। নানা মাপের নেতারা এসে উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে যান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। তবে এখন আর নেতামন্ত্রীদের আশ্বাসে ভুলতে নারাজ স্বরূপনগরের বাসিন্দারা। একটি রাজনৈতিক দলের নেতার বক্তৃতা চলাকালীনই এক বৃদ্ধা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলে ফেললেন, “কত নেতাই তো এলেন গেলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। আমাদের সুখ, দুঃখের খোঁজ-খবর কেউ নেয় না। এই পক্ষ ওই পক্ষের নামে শুধু নোংরা রাজনীতির গুটি কয়েক কথা বলে চলে যান।” সভাচলাকালীনই ওই বৃদ্ধা বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময়ে একবার তাচ্ছিলের চোখে ওই নেতার দিকে তাকিয়েও গেলেন। ছবি তোলার কথা বলতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, “এখনও যদি বা খেয়ে-পরে বেঁচে আছি, ছবি বা নাম বেরোলে দু’পারের দুষ্কৃতীরা এসে পিষে মারবে।” বলতে বলতেই আতঙ্ক ফুটে ওঠে চোখে-মুখে।
বনগাঁ লোকসভার মধ্যে পড়ে স্বরূপনগরের ১০টি এবং বাদুড়িয়ার ২টি পঞ্চায়েত। গত নির্বাচনে বনগাঁ লোকসভার এই এলাকায় ভোটার ছিল ১ লক্ষ ৮১ হাজারের কিছু বেশি। তার মধ্যে সিপিএম ৭০,১০২ তৃণমূল ৬৬,৪৫২ বিজেপি ২৬,১২০ এবং কংগ্রেস পেয়েছিল ১৩,৩৭১টি ভোট। এ বার সেখানে ভোটার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২ লক্ষ ১৮ হাজারের কিছু বেশি। ফলে এখানকার মানুষের ভোট জরুরি বলেই প্রার্থীদের হয়ে রোজ প্রচারে আসছেন হেভিওয়েট নেতা-মন্ত্রীরা।
উপনির্বাচনের দিন ঘোষণা হতেই নেতা-মন্ত্রী থেকে শুরু করে অভিনেতা-অভিনেত্রীতে বেশ জমজমাট স্বরূপনগর, বাদুড়িয়ার সাহেস্থানগর, কৈজুড়ি, গোবরা, চিতুরি, আমুদিয়া, দহরখান্দা, আরশিকারি, গোবিন্দপুর, তরণীপুর-সহ বেশ কয়েকটি সীমান্ত-লাগোয়া গ্রাম। এই সব গ্রামের মূল সমস্যা হল, ফসল নষ্ট করে গরু-মহিষ পাচার। আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের অভাব আছে, কাঁটাতারবিহীন উন্মুক্ত সীমান্ত এলাকা। নদী সংস্কার হয় না। তার মধ্যে দুষ্কৃতী উপদ্রব যে ভাবে এলাকায় বাড়ছে, তাতে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। এমনকী অসুস্থ হলেও চিকিৎসার জন্য রাতের বেলায় এখানকার মানুষ বাইরে বেরোতে পারেন না বলে অভিযোগ।
কিন্তু মনে যতই বিরক্তিবোধ করেন না কেন, নিয়ম করে বিভিন্ন দলের সভায় কিন্তু হাজিরা দিতেই হয় বাসিন্দাদের। যদিও তাঁদের বক্তব্য, নেতামন্ত্রীরা এত কথা বলেন, কিন্তু স্থানীয় সমস্যাগুলি নিয়ে কাউকেই আলোচনা করতে শোনা যায় না। সভা ফেরত এক বৃদ্ধ বলেন, “ভোট দিতে হয় বলেই দিই। মন থেকে দিতে পারি না। আবার এটাও বলতে পারেন, ভোট না দিলে সীমান্তে বাস করা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে রয়েছে। যে ডাকে তার সভাতেই আসতে হয়। তা ছাড়া তো সীমান্ত দুষ্কৃতীদের ভয় আছেই।”
কেন ওদের ভয় পান?
আঁতকে উঠে বৃদ্ধ বলেন, “কী বলছেন, ভয় পাব না? সীমান্তে বাস করে কি ওদের চটানো সম্ভব? তা হলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কি আর ঘরে থাকা যাবে!” ওই বৃদ্ধের মতো অনেকেরই অভিজ্ঞতা, বেশি বেগড়বাই করলেই বিপদ। এ পারের দুষ্কৃতীদের ভয় আছে। বাংলাদেশের দুষ্কৃতীরাও এলাকায় ঢুকে তাণ্ডব চালাতে পারে। অনেকে বললেন, “সব দলই গ্রামে এসে চমকায়। সভায় যেতে বলে। সভায় গিয়ে দেখি জায়গা এক। মঞ্চ এক। কেবল কাপড়ের রংটাই যা আলাদা।”
এলাকার আরও কয়েক জনের কথায়, “আমরা কিন্তু এখানে একে অন্যের হয়ে জোটবদ্ধ হয়ে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে লড়াই করি। অথচ সভায় গিয়ে শুনি, আমরা নাকি সব আলাদা। রেশনকার্ড, পরিচয়পত্র নিয়ে তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে বসবাস করেও আমাদের নাকি শরণার্থী হিসাবে পুনরায় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে!”
কিছু জায়গায় সভায় ভিড় বাড়াতে ভোটযন্ত্র নিয়েও প্রচার সারতে দেখা যায়। হয় তো ভিড় বাড়ানোর জন্যই শাঁড়াপুলে একটি সভায় নাচের অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল। তবে এই সভায় এখন মানুষের একটাই পাওনা, বিনা টিকিটে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখার সুযোগ মিলছে বার বার। তাদের কন্ঠে গান শোনা যাচ্ছে। এমন সুযোগ তো আর সব সময় মেলে না। সে কারণে ইচ্ছা না থাকলেও একাংশ সভায় যাচ্ছে দুষ্কৃতীদের শাসানিতে। আর এক দল যাচ্ছে তারকাদের দেখতে। স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতায়, ভোট এলে তাঁদের কোনও হেলদোল হয় না। কারণ কে ভোটে জিতল কী জিতল না, গ্রামের মানুষের জন্য তাঁরা কেউই যে নড়ে বসবেন না, সে কথা দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকে বিলক্ষণ জানেন এই সব এলাকার মানুষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy