Advertisement
০৫ মে ২০২৪

খড়-পাটকাঠি বাতিল, বরজ সবুজ নেটে

সাগরদ্বীপে যেদিকে তাকানো যায়, দু’রকম সবুজ চোখে পড়ে। পান পাতার কালচে সবুজ রঙের চারপাশে ঘন সবুজ রঙের নেট। চাষিরা বলেন, ‘এসি নেট’ বা ‘শেড নেট।’ চাষিরা জানান, কাঠ, বাঁশ, খড় দিয়ে পান বরজের প্রথাগত কাঠামো তৈরির খরচ বেড়েছে অনেক।

শিবনাথ মাইতি
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:০৫
Share: Save:

সাগরদ্বীপে যেদিকে তাকানো যায়, দু’রকম সবুজ চোখে পড়ে। পান পাতার কালচে সবুজ রঙের চারপাশে ঘন সবুজ রঙের নেট। চাষিরা বলেন, ‘এসি নেট’ বা ‘শেড নেট।’ চাষিরা জানান, কাঠ, বাঁশ, খড় দিয়ে পান বরজের প্রথাগত কাঠামো তৈরির খরচ বেড়েছে অনেক। তার উপর বছর দু’য়েক যেতে না যেতেই রোদেজলে তা পচে-গলে যায়। সেখানে নেট দিয়ে বরজ বানালে পাঁচ-ছয় বছরের জন্য নিশ্চিন্ত। কৃত্রিম তন্তুতে তৈরি নেট সহজে পচে না। আর খুব হাল্কা হওয়ায় ফাইবার রডে নেট টাঙিয়ে আচ্ছাদন ধরে রাখা যায়। লোহার রডের কোনও প্রয়োজন হয় না।

তবে বারবার কাঠামো তৈরির কষ্ট থেকে বাঁচতে পকেটে রেস্ত থাকলে কেউ কেউ পুরো কাঠামোটা লোহার পাইপ দিয়ে বানিয়ে ফেলছেন। আর তাতে আচ্ছাদন ব্যবহার করছেন শেড নেট। তার ফলে ঝড়ের মুখেও সুরক্ষিত থাকছে বরজ। জাতীয় উদ্যান পালন মিশনের আওতায় ভর্তুকি দিয়ে লোহার জিআই পাইপ দিয়ে বরজের কাঠামো তৈরি হচ্ছে। আচ্ছাদন হিসেবে শেড নেটের ব্যবহার হচ্ছে। পান গাছে জল দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে স্প্রিংলার। চাষিকে তার জন্য এ বছর ৩৫ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। পরীক্ষামূলক ভাবে ২০১১ সালে কাকদ্বীপে ওই লোহার কাঠামো-সহ শেড নেটের ব্যবহার শুরু হয়। তার পর থেকে পান বরজে আচ্ছাদন হিসেবে শেড নেটের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। রামকৃষ্ণ মিশন নিমপীঠ -এর উদ্যানবিদ্যা বিভাগের বিশেষজ্ঞ চন্দনকুমার মণ্ডল জানান, লোহার কাঠামোর পাশাপাশি এ বছর বাঁশের কাঠামো তৈরি শুরু হয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ভাল ছড়িয়ে পড়েছে নেটের ব্যবহার। তা ছাড়াও উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া এবং দুই মেদিনীপুরের কোনও কোনও এলাকায় এর ব্যবহার হচ্ছে।

সাগরদ্বীপের মানুষের কাছে পানের বরজ হল লক্ষ্মীর ঝাঁপির মতো। সময়ে-অসময়ে পান ভেঙে ‘পান মার্কেট’-এ নিয়ে গেলে দু’টো কাঁচা পয়সা হাতে পান চাষিরা। এখানে মীন বাদ দিলে সাগরের সাধারণ মানুষের রোজগারের উপায় বলতে পান। তাই পানের বরজের দিকে নজর দিতে কোনও খামতি রাখেন না চাষিরা।

কিন্তু নজর রাখা সহজ নয়। বেশি বৃষ্টিতে পান গাছের গোড়ায় যাতে জল না জমে, রোদে যাতে পানপাতা পুড়ে বা কুঁকড়ে না যায়, সে দিকে সব সময় খেয়াল রাখতে হয়। শীতকালে উত্তুরে হাওয়ায় পানগাছের ‘বাড়’ যাতে থেমে না যায় তার জন্য প্লাস্টিক দিয়ে বরজ মুড়তে হয়। আবার বরজের মধ্যে যাতে পর্যাপ্ত আলো পৌঁছয় তাও খেয়াল রাখতে হয়। সব দিক বজায় রাখতে গিয়ে এত দিন বাঁশ-কাঠ দিয়ে কাঠামো তৈরি করা হত। কাঠামোর উপরে ‘ছই’ বা পাটকাঠি দিয়ে আচ্ছাদন তৈরি করা হত। কাঠামোর গায়ে দড়ি বেঁধে খড় ঝুলিয়ে আধোআলো পরিবেশে পানের চারা রোপণ করা হত।

এতে পানগাছ রক্ষা করা গেলেও বছর দু’য়েক ঘুরতে না ঘুরতেই বাঁশের খুটির গোড়া পচে যায়। পাটকাঠি বা ছই দিয়ে তৈরি আচ্ছাদনও রোদেজলে জীর্ণ হয়ে ঝুর ঝুর করে ঝরতে থাকে। এতে পানের বরজ নোংরা হয়। আবার ঝড়ে খুঁটি উপড়ে একবার পড়ে গেলে পুরো বরজটাই নষ্ট হয়ে যায়। তাই দু’একবছর যেতে না যেতেই বরজের কাঠামো বানাতে হয়। এভাবে বরজ ‘ঝাড়া’তে লাভের গুড় মাঠেই মারা যেত। তার উপর দিন দিন খড়ের দাম আকাশ ছোঁয়া হচ্ছে। তাই বিকল্প হিসেবে নানা জিনিস দিয়ে কাঠামো তৈরির পরীক্ষানিরীক্ষা চলছিল। কিন্তু কোনওটাই তেমন জুতসই হচ্ছিল না। এখন নেট ব্যবহারের দিকে ঝোঁক বেড়েছে চাষিদের।

স্থানীয় পানচাষি শুভেন্দু দাস বলেন, “গোড়ায় খরচটা একটু বেশি হলেও অন্তত পাঁচ-ছ’বছর নিশ্চিন্তে থাকা যায়। আর খুব হাল্কা হওয়ায় ঝড়ের সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় না। যদি বরজ পড়েও যায়, তা তুলতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। বরজ নষ্ট হওয়ার ভয়ও থাকে না।” তিনি জানান, শেড নেট দিয়ে বরজ বানাতে তাঁর খরচ১৬ হাজার টাকা। খড়-পাটকাঠি দিয়ে বানালে হাজার ছয়েক টাকা বাঁচত। কিন্তু শেড নেট যতদিন টিকবে, তার মধ্যে বার কয়েক খড় ও অন্তত দু’বার পাটকাঠি বদলাতে হত। খরচ পড়ত বেশি। শেড নেট বিক্রেতা রবীন তিওয়ারি বলেন, “আগের চেয়ে শেড নেটের চাহিদা বেড়েছে। বিক্রিও তাই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।” পান দুই ধরনের হয় ‘খাড় পান’ ও ‘পালা পান’। কিছু কিছু চাষির ধারণা রয়েছে শেড নেটের ব্যবহারে পালা পানের ফলন তেমন হয় না। তাঁদের দাবি উড়িয়ে রবীনবাবু বলেন, “নিজের পানের বরজে এই নেট লাগিয়েছি। কিন্তু পালা পানের ফলনে কমতি দেখছি না।”

তবে সকলের অভিজ্ঞতা সমান নয়। সাগরের ফুলবাড়ি গ্রামের পান চাষি কালীপদ মাঝি জানান, বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখতে তিনি একই সঙ্গে দুটো পান বরজ করেছিলেন। একটি নেটের। অন্যটি খড়-পাটকাঠির। তিনি বলেন, “খড় পাটকাঠির বরজে পালা পানের ফলন ভালো হলেও শেড নেটের বরজে তেমন হচ্ছে না।” সূর্যের আলো বরজের ভেতরে কম ঢোকায় এমন হচ্ছে, মত তাঁর। উদ্যান পালন দফতরের প্রাক্তন কর্তা রজতকুমার রায় অবশ্য মনে করেন, প্রাথমিক সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠবেন চাষিরা। তিনি বলেন, “প্রথমে চাষিরা ওই নেট ব্যবহারে রাজি না হলেও এখন ধীরে ধীরে তার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

shibnath maity net boroj southbengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE