এই অবস্থায় পড়ে আছে প্রস্তাবিত হিমঘর।
ঢাকঢোল পিটিয়ে শিলান্যাস করা হলেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয় না। কোথাও আবার শিলান্যাস করা হলেও মাঝপথে কাজ থমকে যায়। জাঁকজমক করে শিলান্যাসের পরে গোটা প্রকল্পটাই উধাও, এমন উদাহরণও কম নয় বাদুড়িয়ায়। সড়ক ও রেলপথে পরিবহণ ব্যবস্থা এখনও পিছিয়ে। সব মিলিয়ে গ্রামীণ এলাকার চেহারায় থেকে গিয়েছে বাদুড়িয়া পুরসভা।
আড়বালিয়ায় সুপার মার্কেট এবং পৌর মার্কেট কমপ্লেক্সের পাশে হিমঘর বর্তমানে হাড়গোড় বের করা চেহারায় আকাশের দিকে মুখ তুলে চরম পরিণতির অপেক্ষায় দিন গুনছে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা বলেন, “ভেবেছিলাম সুপার মার্কেট হলে ব্যবসা বাড়বে। বদলে যাবে এলাকার চেহারা। আখেরে ক্রেতাদের পাশাপাশি লাভবান হবেন ব্যবসায়ীরাও। কিন্তু কী যে হল, মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গেল বাণিজ্যকেন্দ্র তৈরির কাজ। বাদুড়িয়া পুরসভার বিরোধী দলনেতা পরিতোষ মণ্ডল বলেন, “২০০৯ সালে শিলান্যাসের পরে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে কেবল পিলার তৈরি হয়েছে। কাজ আর এগোয়নি। নতুন করে কাজ শুরুর কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।”
দিলীপ স্কুলের পাশে ডাকবাংলোয় মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কারিগরি শিক্ষা ও বিপণন কেন্দ্রের ফলক থাকলেও প্রকল্পের দেখা মেলে না। একই অবস্থা পুঁড়ার কাছে সরফরাজপুরের হরহাটিতে কারিগরি শিক্ষার কলেজের। এখনও রাস্তার পাশে ফলকের দেখা মিললেও প্রকল্পেরই আর কোনও অস্তিত্ব নেই। এলাকায় শিল্প বলতে পাটজাত ছোট কারখানা, তেলকল, প্লাস্টিক, গুড়, সুপারি এবং পোল্ট্রি ফার্ম। এখানকার বড় অংশের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করেন। মূলত সেই সব পরিবারের মহিলারা কাপড়ের উপরে সুতোর কারুকাজে বেশ পটু। যার এক নাম ‘কাম সেলাই’। সে কথা মাথায় রেখে দিলীপ স্কুলের মাঠের পাশে জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে ২০১১ সালে রাজ্যের তৎকালীন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মন্ত্রী রেখা গোস্বামী বাদুড়িয়া স্বনির্ভর গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তথা মার্কেট কমপ্লেসের শিলান্যাস করেছিলেন। কোনও এক সময়ে ওই দিলীপ স্কুলের মাঠের পাশের পুকুরে স্যুইমিং পুল করা হয়েছিল। কালের স্রোতে তা হারিয়ে গিয়েছে। তারই পাশে প্রায় ৬ কোটি টাকা বাজেটের কারিগরি শিক্ষা এবং বিপণন কেন্দ্র হতে চলেছে দেখে বিশেষ করে মহিলারা উৎসাহিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা। রাখি মণ্ডল, স্বপ্না বিশ্বাস, মনোয়ারা খাতুনরা বলেন, “ঘটা করে শিলা পোঁতা হলেও একটি ইটও গাঁথা হয়নি।” শৈলেন্দ্রনাথ কাবাসি জানান, প্রশিক্ষণ ও বিক্রয়কেন্দ্র বর্তমানে গরু-ছাগলের চারণভূমি এবং গাড়ি রাখার জায়গায় পরিণত হয়েছে।
এখানেই হওয়ার কথা ছিল মার্কেট কমপ্লেক্স।
আর্সেনিক প্রবণ এলাকা হওয়া সত্ত্বেও বারে বারে প্রকল্প করা হলেও বাড়ি বাড়ি তো দূর অস্ত, পাইপ লাইনের মাধ্যমে অধিকাংশ ওয়ার্ডে পানীয় জলই পৌঁছয়নি। একমাত্র পুর কমিউনিটি হলের ছাদের সিলিংয়ের চেহারা অতি ভয়ঙ্কর। সেখান থেকে খসে খসে পড়ছে কাঠবোর্ডের চাঙড়। চেয়ারে বসে উপরের দিকে তাকালে বুক দুরু দুরু করায় আর অনুষ্ঠান দেখতে মন বসে না!
বাস টার্মিনাসের কাছে ২০০২ সালের ২৬ জানুয়ারি রাজ্যের তৎকালীন পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বাদুড়িয়ার স্থানীয় বিধায়ক কাজি আব্দুল গফ্ফরকে সঙ্গে নিয়ে পৌর শিশু উদ্যানের উদ্বোধন করেছিলেন। খেলার সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে সেখানে উচ্ছ্বল শিশুদের পরিবর্তে দেখা মেলে স্তূপীকৃত বিচালির। শিশুদের জন্য তৈরি পার্ক কার্যত পরিণত খাটালে। সব্জি বাজারের ছাউনির অবস্থা এতটাই খারাপ, দ্রুত মেরামতি না হলে যে কোনও মুহূর্তে মাথায় ভেঙে পড়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
কৃষি নির্ভর বাদুড়িয়ায় ৩ লক্ষের উপর মানুষের বাস যার একটা বড় অংশ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত অথচ সেই বাদুড়িয়ায় ফসল সংরক্ষণের জন্য তৈরি হিমঘরের কয়েকটা পিলার, মাথায় খানিকটা ছাদ এবং দু’তলায় ওঠার সিঁড়ি ছাড়া আর কিছুই তৈরি হয়নি। ওই ছাদের তলায় এখন মাছের ব্যবসা চলে। মাছ ব্যবসায়ী স্বপন মণ্ডল বলেন, “পাইকারি বাজার এবং হিমঘরের পরিকল্পনা নিয়ে গত ১৯৯৮ সালে শিলান্যাসের পর হঠাৎ একদিন কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এখন আমরা ১৩ জন মাছ ব্যবসায়ী মাসে তিনশো টাকা ভাড়া দিয়ে চার দিক খোলা এমন জায়গায় ব্যবসা করছি।”
এ তো গেল বাদুড়িয়া পুরসভার এক পারের ১২টি ওয়ার্ডের কথা। ইছামতীর অন্য পারে ৫টি ওয়ার্ডে ক্ষোভও নেহাত কম নয়।
বাঁ দিকে, বন্ধ পড়ে আছে পুলিশ ফাঁড়ি। ডান দিকে, শিশু উদ্যানে পড়ে বিচালির স্তূপ।
বৃটিশ আমলে পুঁড়োতে তৈরি হয়েছিল টিনের চাল দেওয়া পুলিশ ফাঁড়ি। ২০০৩ সালে তার পাশে নতুন বাড়ির উদ্বোধন করেন জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার এমএইচ ভার্মা। ২০০৭ সালে ওই বাড়ির পাশে পুলিশকর্মীদের থাকার জন্য আধুনিক দোতলা আরও একটি বাড়ি তৈরি হয়। স্থানীয় বাসিন্দা সঞ্জয় ঢালি, নিমাই ঢালি, দেবদাস রজকরা বলেন, “পুলিশ ফাঁড়ি হওয়ায় আমরা নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কয়েক দিন কয়েক জন পুলিশকর্মী আসা-যাওয়া করলেও ফাঁড়ির উদ্বোধনের সময় পাননি পুলিশকর্তারা। ফলে পুলিশ ফাঁড়ি এখন দিনের বেলায় তাস খেলা আর গরু-ছাগল চরানোর জায়গা। রাতে দুষ্কৃতীদের আনাগোনা লেগে থাকে সেখানে।”
পুঁড়োর কাছে সরফরাজপুর এলাকার হরহাটি মোড়ে জেলা পরিষদের পাঁচ বিঘা জমিতে সাড়ে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শিল্প প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের শিলান্যাস করা হয়েছিল। তারপর অবশ্য একটি ইটও গাঁথা হয়নি সেখানে।
জেলার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন ১৭৭ বছরের পুরনো বাদুড়িয়া এলএমএস বয়েজ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক দীপক রায় বললেন, “এখানে কোনও ডিগ্রি বা টেকনিক্যাল কলেজ নেই। যাও একটা আইটিআই হচ্ছিল, তা-ও শেষমেশ বন্ধ হয়ে গেল।” তিনি জানালেন, সরকারি সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থা না থাকায় উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় যাতায়াতও বেশ কষ্টসাধ্য। স্থানীয় মানুষের পক্ষে ইতিমধ্যে ‘সিটিজেনস্ ফোরাম’ গড়ে বাদুড়িয়ায় রেল পরিষেবার জন্য দাবি তোলা হচ্ছে। ফোরামের সভাপতি সুকুমার দে বলেন, “জেলার মধ্যে বাদুড়িয়া অন্যতম কৃষিপ্রধান এলাকা। উৎপাদিত ফসল কলকাতার বাজারে সময় মতো পৌঁছতে ট্রেন পরিষেবা দরকার। ছাত্রছাত্রীদেরও তা খুব প্রয়োজন। কিন্তু এখন বাদুড়িয়া থেকে সরাসরি কোনও ট্রেন নেই। আমাদের দাবি, গুমা থেকে বাদুড়িয়া হয়ে ঘোজাডাঙা পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ করা হোক।”
পুরসভা সূত্রে জানা গেল, গত কয়েক বছর আগে নিবিড় বস্তু উন্নয়ন প্রকল্পে প্রায় ১০ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা এসেছিল বাদুড়িয়ায়। সেই টাকায় গরিবদের জন্য ঘর, নর্দমা, বিদ্যুদয়ন, মার্কেট কমপ্লেক্স, কংক্রিটের রাস্তা, বাজার ইত্যাদি করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তার সিকিটুকুও হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। তাঁদের বক্তব্য, রাজনৈতিক দলগুলো যদি এত দিনে আর একটু তৎপর হত, তা হলে প্রাচীন এই জনপদের এত দিনে ভোল বদলে যেতে পারত।
পুরপ্রধান দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “কমিউনিটি হল, বাজার-সহ উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ইতিমধ্যে আড়াই কোটি টাকা চেয়ে নবান্নে সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছে আবেদন করা হয়েছে। টাকা হাতে পেলেই কাজ শুরু করে দেওয়া হবে।”
(শেষ)
—নিজস্ব চিত্র।
কেমন লাগছে আমার শহর?
আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-বাদুড়িয়া’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy