Advertisement
১৯ মে ২০২৪

বিকল্প পদ্ধতিতে চাষ করে অনেকের কাছে ‘দৃষ্টান্ত’ হয়ে উঠেছেন কৃষ্ণপদ

বছর দ’শেক আগেও উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগর থানার অম্বরপুর এলাকার বাসিন্দা কৃষ্ণপদ বিশ্বাসের এলাকায় পরিচিতি ছিলেন এক জন হাতুড়ে চিকিসত্‌ক হিসেবে। কিন্তু গঙ্গানন্দপুর পঞ্চায়েতের কৃষি প্রযুক্তি সহায়ক আশিস বসুর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের পরই জীবনে পরিবর্তন ঘটে যায়। আশিসবাবু তাঁকে প্রথমে একটি কৃষি সংক্রান্ত মিটিংয়ে নিয়ে যান। সেখানে জৈবকৃষি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন তত্‌কালীন বনগাঁ মহকুমার কৃষি আধিকারিক আশিসকুমার হুই। তাঁর আলোচনা শুনে ভাল লেগে যায় কৃষ্ণপদর। তিনি সিদ্ধান্ত নেন পারিবারিক জমিতে চাষবাস করবেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
গোপালনগর শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৪ ০০:২৬
Share: Save:

বছর দ’শেক আগেও উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগর থানার অম্বরপুর এলাকার বাসিন্দা কৃষ্ণপদ বিশ্বাসের এলাকায় পরিচিতি ছিলেন এক জন হাতুড়ে চিকিসত্‌ক হিসেবে। কিন্তু গঙ্গানন্দপুর পঞ্চায়েতের কৃষি প্রযুক্তি সহায়ক আশিস বসুর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের পরই জীবনে পরিবর্তন ঘটে যায়। আশিসবাবু তাঁকে প্রথমে একটি কৃষি সংক্রান্ত মিটিংয়ে নিয়ে যান। সেখানে জৈবকৃষি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন তত্‌কালীন বনগাঁ মহকুমার কৃষি আধিকারিক আশিসকুমার হুই। তাঁর আলোচনা শুনে ভাল লেগে যায় কৃষ্ণপদর। তিনি সিদ্ধান্ত নেন পারিবারিক জমিতে চাষবাস করবেন।

যেমন ভাবনা, তেমনি কাজ। তবে প্রচলিত পদ্ধতি মেনে চাষ করতে তাঁর প্রথম থেকেই ছিল প্রবল আপত্তি। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার কী ভাবে করা যায় বা রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার কেঁচো সারের ব্যবহার নিয়ে তিনি রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে প্রশিক্ষণ নেন অচিরাচরিত শক্তিকে কী ভাবে চাষের কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পাওয়া জ্ঞান তিনি নিজের জমিতে প্রয়োগ করেন। সাফল্যও আসতে শুরু করে। তাঁকে দেখে এলাকার অন্য চাষিরাও অবাক হয়েছিলেন। কৃষ্ণকে দেখে অন্য চাষিরাও জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা শুরু করেন। নিজের শেখা উন্নত চাষের বিদ্যা তিনি এলাকার চাষিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। তুলনায় অল্প খরচে বেশি আয়ের মুখ দেখতে থাকেন চাষিরা।

অঞ্চলের সামগ্রিক কৃষি উত্‌পাদনে ও কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণে কৃতিত্বের জন্য রাজ্য সরকার কৃষ্ণপদবাবুকে ২০১৩ সালে ‘কৃষক রত্ন’ পুরস্কার দিয়েছে। এখন তিনি রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কৃষকদের তাঁর সাফল্যের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। কৃষি দফতরও তাঁকে ওই কাজে ব্যবহার করছে।

বাবা প্রয়াত হৃষিকেশ বিশ্বাসও ছিলেন এলাকার একজন আদর্শ কৃষক। দুই ভাই বোনের মধ্যে কৃষ্ণবাবুর বড় বোন সুভদ্রার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিএ পরীক্ষাও দিয়েছিলেন কৃষ্ণবাবু। কিন্তু পড়া শেষ করা হয়নি। স্থানীয় পাঁচপোতা বাজারে শুরু করেন হাতুড়ে চিকিত্‌সকের কাজ। দশ বছর ওই কাজ করেছেন। পারিবারিক ছ’বিঘে জমি অন্য চাষিদের কাছে লিজ বা ভাগে দেওয়া ছিল। যাঁদের কাছে জমি ভাগে দেওয়া ছিল তাঁরা যথেচ্ছ পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে খেতে মাটি নষ্ট করে দিয়েছিলেন। জমির মাটি অনুর্বর হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া, ভাগের ফসল তাঁরা ঠিক মতো পাচ্ছিলেন না। প্রশিক্ষণ শেষ করে কৃষ্ণবাবু ২০০৪ সাল থেকে কৃষিকাজ শুরু করেন। পারিবারিক যে জমি লিজে দেওয়া ছিল তা তিনি ফিরিয়ে নেন। প্রথমেই জমির মাটি স্বাভাবিক উর্বরতায় ফিরিয়ে আনেন। কেঁচোসার গোবরসার-সহ নানা জৈবসারের মাধ্যমে তিনি সব্জি, কলা, ফুল, ধান, পাট চাষ করেন।

পাট চাষে কী ভাবে খরচ বাঁচিয়ে বেশি লাভ করা যায়, তা নিয়েও ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন তিনি। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন পাট পচানোর ক্ষেত্রে চাষিরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। পাট পচানোর পর আঁশ ছাড়ানো হলে পাটের গুণগত মান কমে যায়। চাষি দাম কম পান। তা ছাড়া খাল-বিল-নদী-নালা-বাওরে অনেক সময় জলের অভাবে পাট পচানো যায় না। পরিবহণ খরচাও এখন অনেক। মাথা খাটিয়ে তৈরি করে ফেলেন একটি যন্ত্র, যা দিয়ে তুলনায় অনেক কম খরচে কাঁচা পাটের আঁশ ছাড়ানো যায়। তার ওই যন্ত্রের স্বীকৃতিও দিয়েছে রাজ্য সরকার। ২০০৯ সালে রাজ্য সরকার তাঁকে ‘রাজ্য উদ্ভাবন পুরস্কার’ দিয়েছে।

কৃষ্ণবাবু বলেন, “প্রথমে আমার যন্ত্রটি ছিল হস্তচালিত। খড়্গপুর আইআইটির এক বিজ্ঞানীর পরামর্শে যন্ত্রটি আরও আধুনিক ভাবে তৈরি করি। এখন ইঞ্জিন চালিত করা হয়েছে। পুরস্কার পাওয়ার পরও যন্ত্রটিকে বর্তমান অবস্থায় আনতে আরও চার বছর লেগে গেল।” সম্প্রতি বনগাঁ ব্লক কৃষি দফতরে ওই যন্ত্রের প্রদশর্নীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বহু চাষি তা দেখতে এসেছিলেন। ইতিমধ্যেই কৃষ্ণবাবুর কাছে প্রচুর বরাত এসেছে ওই যন্ত্রের।

বনগাঁর সহ কৃষি অধিকর্তা শঙ্কর বিশ্বাস বলেন, “কৃষ্ণবাবুর আগে বনগাঁ ব্লকে বিক্ষিপ্ত ভাবে কেঁচোসারের ব্যবহার করতেন চাষে। কৃষ্ণবাবুই প্রথম সংগঠিত ভাবে কেঁচোসারের ব্যবহার শুরু করেন। চাষে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছেন। তাঁর তৈরি কাঁচা পাটের আঁশ ছাড়ানোর যন্ত্র ব্যবহারে পাট চাষের খরচ কমবে। গুণগত মানও বাড়বে। কেউ আমাদের কাছে ওই যন্ত্র চাইলে আমরা কৃষ্ণবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।” কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এখন পাট পচানোর জলের অভাব। নোংরা জলে পাট পচানো হলে পাটের রঙের পরিবর্তন হয়ে কিছুটা কালচে হয়ে যায়। ফলে চাষিরা দাম কম পান। ওই যন্ত্র দিয়ে কাঁচা পাটের আঁশ ছাড়ানোর ফলে বিঘে প্রতি এক কুইন্ট্যাল পাট বেশি পাওয়া যায়। পাট পচানোর জায়গাও খুবই কম লাগে। পরিবহণ খরচও কমে যায়। কৃষ্ণবাবু বলেন, “সাধারণ পদ্ধতি মেনে পাট কাটা থেকে শুকনো পর্যন্ত এক বিঘে জমিতে খরচ প্রায় ছ’হাজার টাকা। যন্ত্রের মাধ্যমে খরচ পড়বে ২৩০০ টাকা। আগে আঁশ ছাড়ানোর ফলে বাড়িতেই ছোট গর্ত করে তাতে পলিথিন পেতে পাটের আঁশ ভেজানো যায়।” কমলশঙ্করী, অগ্নিবীণা, নাগেশ্বরী প্রভৃতি দেশি ধানের বীজ তিনি সংরক্ষণ করেন এবং চাষ করেন অন্যকে ওই চাষ করতে উত্‌সাহও দেন। এতে চাষের খরচ কমে। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে বাড়িতে একটি কৃষি বিদ্যালয় করবার ইচ্ছে আছে কৃষ্ণবাবুর।

অসীত সিকদার নামে অম্বরপুরের এক চাষি লিজ ও পারিবারিক মিলিয়ে ৭ বিঘে জমিতে ধান, পাট, বেগুন, পটল, ফুল চাষ করেন। তাঁর কথায়, “অতীতে রাসয়ানিক সার দিয়ে চাষ করতাম। খরচ অনেক বেশি হত। রোগপোকা ফসলে বেশি আক্রমণ করত। আমি নিজেও সার ব্যবহারের জন্য অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। কৃষ্ণদার কাছ থেকে জৈব সারের ব্যবহার শিখে চাষ করছি। আয় বেড়েছে। সুস্থও আছি।” শৈলেন্দ্রনাথ বিশ্বাস নামে আর এক চাষি বলেন, “কৃষ্ণবাবুই প্রথমে জৈব পদ্ধতি মেনে চাষ করতে আমাদের উত্‌সাহ দিয়েছিলেন। জৈবসারে খরচ কম।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE