সপরিবার: স্ত্রী ললিতা ও মেয়ে রাজির সঙ্গে মহেশ। নিজস্ব চিত্র
হারানো বৌ-মেয়েকে নিয়ে বহরমপুর থেকে পূর্ণিয়ার আলমনগরে ফিরছিলেন খেতমজুর মহেশ শর্মা। বুধবার দুপুরে ভাগলপুরে ফোনে ধরা গেল তাঁকে। মহেশ বলছিলেন, “বহু কষ্টে ‘বিবি-বেটি’কে বঙ্গালের হাসপাতালে ফিরে পেয়েছি। আমি ঠিক পারব, ওদের দেখভাল করতে। কিছুতেই হাতটা ছাড়ব না।”
বহরমপুরে মঙ্গলবার বিকেলে এই তিন জনের মিলন দৃশ্যের মুহূর্তের সাক্ষী, বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের কয়েক জন ডাক্তার, নার্স, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী এবং সরকারি অনুদানপুষ্ট শিশুসদনের কেয়ারগিভার ‘মা’য়েরা। দিনের পর দিন না-খেয়ে কোলের মেয়ে রাজিকে নিয়ে কৃষ্ণনগরে ঘুরছিলেন ললিতাদেবী। ২০১৯-এর ২৮ মার্চ কৃষ্ণনগরে আদালতের নির্দেশে তাঁদের বহরমপুরে পাঠানো হয়। সেই দিনটির সঙ্গে এ দিনের ফারাক আকাশ-পাতাল। শিশুসদনের কর্ত্রী নীতা মজুমদার বলছিলেন, “বাচ্চাটির মাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হলেও মেয়েকে আমাদের হোমে পাঠায় সরকারি শিশুকল্যাণ সমিতি। বাচ্চাটির বয়স বছর দেড়েকের হলেও তখন বসতে পারত না। অনাহারে বা রাস্তায় উল্টোপাল্টা খেয়ে পেট ফেঁপে ফুলে কাহিল অবস্থা। শিশুটি রক্তাল্পতায় একেবারে নিস্তেজ ছিল।” ডাক্তারি পরামর্শে রক্ত দিয়ে নাগাড়ে চিকিৎসা, যত্নে শিশুটিকে বাঁচিয়ে তোলা গিয়েছে। নীতাদেবী বলেন, “গত পৌনে দু’বছর শিশুটি মায়ের কোলছাড়া। কিন্তু অত দিন বাদে দেখা হতে মা রাজি বলে ডাকতেই সে নিশ্চিন্তে মায়ের কোলে চলে গেল। শিশুটিকে সারিয়ে তুলে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে তৃপ্তি হচ্ছে।”
হাসপাতাল সূত্রের খবর, কিছু মানসিক জটিলতা ও অবসাদের দরুন কোলের মেয়েটিকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ললিতাদেবী। তাঁর মোট ছ’টি মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে বিবাহিতা। বহরমপুরের হাসপাতালে কিছুটা সুস্থ হয়েই মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন মা। হাসপাতালের সহযোগী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে ‘ভিডিয়ো কলে’ মেয়েকে দু-একবার দেখেনও মা। এক জন নার্সকে আলমনগর থানার কথাও বলেন ললিতা। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীদের মাধ্যমে খবর পেয়ে থানাও এগিয়ে আসে ললিতার ঠিকানার খোঁজে। থানার মাধ্যমে ‘হারানো বৌ’য়ের খবর পেয়ে মহেশও দেরি করেননি। বহরমপুরে চলে আসেন। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী স্বরূপ রায় বলছিলেন, “গোড়ায় একটু জড়োসড়ো থাকলেও স্ত্রী, মেয়ের প্রতি মহেশের টানটাও স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে।”
অতিমারির বছরে মহেশের ২৫০ টাকা রোজের জীবিকাও রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছে এ বছর। বৌ নিখোঁজ থাকার সময়ে মেজমেয়ে সামলাচ্ছিলেন সংসারের ভার। ফোনে কথা বলার সময়েও এ দিন বৌকে সময়মতো ওষুধ খাওয়ানো নিয়ে চিন্তায় ছিলেন তিনি। সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের অভিজ্ঞতায়, “অনেক সময়ে কিছু সম্পন্ন পরিবারও অসুস্থ আত্মীয়ের দায় এড়াতে হাসপাতালে ফেলে রেখেই নিশ্চিন্ত থাকে। আবার গ্রামীণ ভারতে নানা অভাব, অনটনেও অসুস্থ অসহায় আত্মীয়ের প্রতি আশ্চর্য টান চোখে পড়ে।” স্বাস্থ্য আধিকারিক, পুলিশ, সমাজকর্মী সবার সমন্বয়ে বিচ্ছেদের ঝড় পার হয়ে জুড়ে গিয়েছে ললিতাদেবীর পরিবার। অনেক কিছু হারানোর বছরে এই ফিরে পাওয়ার গল্পে লেগে থাকল প্রাপ্তিরও স্বাদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy