সুরেন্দ্র সাহু ও মহম্মদ সামসাদ
মাঝেরহাট সেতুর নীচে রাতের অন্ধকারে তিনটি বড় ট্যাঙ্কার দাঁড়িয়ে। সেগুলি থেকেই চুপিসাড়ে নামিয়ে নেওয়া হচ্ছে স্পিরিট। যে স্পিরিটে ৯৭ শতাংশ অ্যালকোহল থাকে।
এই কুকর্ম হাতেনাতে ধরে ফেলেছে রাজ্য আবগারি দফতর। বেরিয়ে পড়েছে জাল মদ তৈরির একটি চক্রের হদিস। জানা গিয়েছে, এ ভাবেই মাঝরাস্তায় বিশুদ্ধ স্পিরিট চুরি করে তার সঙ্গে জল মেশানো হয়। কখনও কখনও জল ছাড়া সে স্পিরিটের সঙ্গে মিথাইল অ্যালকোহলও মিশিয়ে দেওয়া হয়। এর পরে পুরনো মদের বোতলে নকল লেবেল সেঁটে, নকল ছিপি তৈরি করে সেই মদ ছড়িয়ে দেওয়া হয় বাজারে।রাজ্য আবগারি দফতরের কালেক্টর সুব্রত বিশ্বাস জানিয়েছেন, কম দামি নকল হুইস্কি, রাম, ভদকা এবং দেশি মদ হিসেবে সেই তরলীকৃত স্পিরিট বোতলে ভরে রাজ্যের বিভিন্ন বেআইনি লাইসেন্সবিহীন শুঁড়িখানা, ধাবা, বার-এ সরবরাহ করা হয়। এ ভাবেই সমান্তরাল এক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল এই চক্র।
জানা গিয়েছে, সম্প্রতি আবগারি দফতরের কাছে খবর আসে যে, তিনটি ট্যাঙ্কার নুরপুরের একটি কারখানা থেকে বেরিয়ে ডানকুনির এক বটলিং প্লান্টে যাচ্ছে। মাঝপথে আবগারি দফতরের সিল না ভেঙেই সেই ট্যাঙ্কারগুলির থেকে নামিয়ে নেওয়া হচ্ছে প্রচুর পরিমাণ স্পিরিট।
ঘটনার দিন আবগারি অফিসারেরা হানা দিলে দু’টি ট্যাঙ্কারের চালক ও অন্যেরা পালিয়ে গেলেও মহম্মদ সামসাদ নামে এক চালক ধরা পড়ে যান। জানা যায়, কারখানা থেকে স্পিরিট ভর্তি ট্যাঙ্কার নিয়ে বেরোনোর পরে সেই তথ্যটি চক্রের পাণ্ডার কাছে চালান করে দেওয়াই ছিল সামসাদের কাজ। কখন, কোথায় এসে ট্যাঙ্কার নিয়ে দাঁড়াতে হবে, তা সামসাদকে বলে দেওয়া হতো। ‘কাজ’ শেষ হয়ে গেলে ট্যাঙ্কার নিয়ে ফের সামসাদেরা রওনা হতেন বটলিং প্লান্টের দিকে।
আবগারি দফতর সূত্রের খবর, কারখানা থেকে ট্যাঙ্কার ভর্তি স্পিরিট পাঠানো হয় বটলিং প্লান্টে। সেই বটলিং প্লান্টে এই স্পিরিট তরলীকৃত করে তা দেশি হুইস্কি বানানোর কাজে লাগানো হয়। এক-একটি ট্যাঙ্কারে ২০ হাজার লিটার স্পিরিট থাকে। কারখানা থেকে বেরোনোর মুখে রাজ্যের আবগারি দফতর সেই ট্যাঙ্কার সিল করে দেয়।
সুব্রতবাবু জানান, কারখানা থেকে ট্যাঙ্কারে করে ২০ হাজার লিটার বেরোলেও রাস্তায় ঝাঁকুনি, তাপমাত্রার হেরফের ও বিভিন্ন কারণে তার পুরোটা বটলিং প্লান্টে পৌঁছয় না। সুব্রতবাবুর কথায়, ‘‘এই হিসেবটা খুব ভাল করে জানে চক্রের লোকেরা। ফলে, এক-একটি ট্যাঙ্কার থেকে ‘হিসেব’ মতো স্পিরিট নামিয়ে নেয় তারা। সিল অটুট অবস্থায় ট্যাঙ্কার বটলিং প্লান্টে পৌঁছনোর পরে যদি দেখা যায় ৫০-১০০ লিটার কম রয়েছে, তাতে গা করেন না প্লান্টের লোকজন।’’
সামসাদকে জেরা করে বেশ কিছু ফোন নম্বর পান অফিসারেরা। হানা দেওয়া হয় বন্দর এলাকায়। এক জমি ও গাড়ি বিক্রেতাকে ধরে জেরা করা হয়। তিন-চার দিন ধরে এ ভাবে একাধিক লোককে জেরা করার পরে উঠে আসে সুরেন্দ্র সাহুর নাম। জানা যায়, সে এই চক্রের অন্যতম পাণ্ডা। এই চক্রের জাল ছড়িয়ে রয়েছে বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাবেও। পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বে সুরেন্দ্র। প্রায় ৮টি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সে। তার বেশির ভাগ সিম-ই নেওয়া ভুল ঠিকানা দিয়ে। আসল বাড়ি ঝাড়খণ্ডের গিরিডিতে। গত ১২ বছর ধরে কলকাতার বাসিন্দা। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও কিছুতেই পুলিশের জালে ধরা পড়ছিল না সুরেন্দ্র। শেষ পর্যন্ত সুরেন্দ্রর পরিচিত এক জমি বিক্রেতাকে দিয়ে টোপ ফেলা হয়। বেহালায় মেয়ের স্কুলের সামনে ওই জমি বিক্রেতাকে ডেকে পাঠায় সুরেন্দ্র। সোমবার এ ভাবেই ধরা পড়ে সে।
বেহালায় সুরেন্দ্রর নিজের বাড়ি আছে। দু’টি গাড়ি এবং চারটি মোটরবাইকও রয়েছে তার। সুব্রতবাবু জানান, এ সমস্ত টাকাই সে চোরাই স্পিরিট বিক্রি করে পেয়েছে। তার বাড়িতে হানা দিয়ে নগদ সাড়ে তিন লক্ষ টাকাও মিলেছে। বিষয়টি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে বলেছে আবগারি দফতর। সুরেন্দ্র হাওয়ালা মারফত বিদেশে টাকা পাঠানোর সঙ্গেও জড়িত বলে আবগারি অফিসারদের আশঙ্কা। মঙ্গলবার আদালতে তোলা হলে তাকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। তবে, সুরেন্দ্রকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে আরও জেরা করতে চায় আবগারি দফতর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy