Advertisement
১৮ মে ২০২৪

আলোয় ফিরে ওঁরা আজ সততার প্রহরী

দস্যু রত্নাকর থেকে মহাকবি হয়েছিলেন বাল্মীকি। সেই বাল্মীকির কাহিনি বাস্তবেও রত্নাকরদের অনেককে নিয়ে এসেছে আলোর পথে। তাঁরা এখন আবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আলোয় ফিরছে অন্ধকারের মুখগুলি।

জহর দে ও মহম্মদ রমজান।—নিজস্ব চিত্র

জহর দে ও মহম্মদ রমজান।—নিজস্ব চিত্র

সুরবেক বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:০২
Share: Save:

দস্যু রত্নাকর থেকে মহাকবি হয়েছিলেন বাল্মীকি। সেই বাল্মীকির কাহিনি বাস্তবেও রত্নাকরদের অনেককে নিয়ে এসেছে আলোর পথে। তাঁরা এখন আবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আলোয় ফিরছে অন্ধকারের মুখগুলি।

জহর দে-র জন্য ট্যাংরার রাধানাথ চৌধুরী রোডে শিল্প তালুকের কিছু কারখানার মালিক এখন খুশি। তাঁদের শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ মালপত্র সরাতেন, মাস দুয়েক সে সব বন্ধ। সকাল ন’টা পর্যন্ত ডিউটি থাকলেও কেউ কেউ অন্য জায়গায় খুচরো খাটতে সরে পড়তেন ভোর পাঁচটায়। তাঁদের বেরোনোও বন্ধ। মালিকেরা এ সবের কৃতিত্ব দিচ্ছেন ৪৪ বছরের জহরকে। একটি কারখানার মালিক, নন্দকিশোর খান্ডেলওয়ালের কথায়, ‘‘জহর খুব ভাল মানুষ। নজরদারিতে কড়া। ওকে কেন যে আগে পাইনি!’’

বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে বিবি চ্যাটার্জি রোডের এই জহর দে এক সময়ে ছিলেন লেক, কালীঘাট, আলিপুর, গড়িয়াহাট, ভবানীপুর, টালিগঞ্জ, কসবা ও যাদবপুর এলাকার ত্রাস। বিশেষ করে প্রোমোটারদের কাছে। ১৯৯৯-তে পঞ্চাননতলা আর তার পরের বছর মনোহরপুকুর রোডের বস্তিতে দু’বার পুলিশের গুলি খেয়েও মরতে মরতে বেঁচে যান। ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে তোলাবাজি-সহ নানা অভিযোগে বন্দি ছিলেন জহর।

জেল থেকে বেরিয়ে জহর প্রথমে মূর্তি আর থার্মোকলের থালা-গ্লাসের দোকান দেন। এখন মাসে হাজার দশেক টাকা মাইনেয় নিরাপত্তারক্ষীর চাকরিও করছেন। জেলে থাকার সময়ে যে ভাবে সব বন্দিদের তল্লাশি করা হত রোজ, সেই অভিজ্ঞতাই শিল্প তালুকে অনিয়ম ঠেকানোর পিছনে কাজে লাগিয়েছেন জহর দে। ডিউটি শেষে বেরোনোর সময়ে জহরকে ব্যাগ খুলে না দেখালে নিস্তার নেই।

জহর যখন জেলে যান, তাঁর বড় মেয়ের বয়স তিন, ছোট মেয়ের এক বছর। এখন তাদের এক জন ক্লাস নাইনে, অন্য জন এইটে। ‘‘আমার মেয়েরা ওদের বাবার অতীতের কথা সব জানে। এখন এটাও জানে, ওদের বাবা সৎপথে খেটে টাকা রোজগার করছে। তাই, ওরা খুশি। আর আমি নিজে গর্বিত,’’ বলার সময়ে চকচক করে ওঠে জহরের চোখজোড়া।

প্রেসিডেন্সি জেল থেকেই চার বছর সাজা খেটে ২০১১-তে বাইরে বেরোন মহম্মদ রমজানও। সিআইটি রোডের রমজান ও তাঁর বন্ধুরা মহম্মদ আলি পার্কের সামনে এক ব্যবসায়ীকে বেধড়ক পিটিয়ে লুঠ করেছিলেন। রড ও ছুরির আঘাতে কোমায় চলে যান সেই ব্যবসায়ী। তিন মাস লুকিয়ে থাকার পর রমজানকে পুলিশ টেনে বের করে নিউ মার্কেটের কাছে দিলখুশা স্ট্রিটের গোপন ডেরা থেকে।

বছর সাতাশের রমজান এখন হাওড়ার ক্যারি রোডে একটি আবাসন চত্বরে নিরাপত্তারক্ষীদের সর্দার। ওই চৌহদ্দি যত বড়, সে তুলনায় রক্ষীর সংখ্যা কম। তাই রক্ষীদের বহাল করেছে যে সংস্থা, তারা রমজানের উপর গুরুদায়িত্ব দিয়েছে। এই ভরসাটা নিজে অর্জন করেছেন রমজান। বছর দুই আগে গড়িয়ায় অলঙ্কার বিপণির একটি নির্মীয়মাণ শোরুমে বড়সড় চুরি আটকে দিয়েছিলেন তিনি। ওই বিপণির কর্ণধার অনর্ঘ্য চৌধুরীর কথায়, ‘‘আমাদের পরিবারের বহু পুরনো গয়না ও প্রাচীন জিনিসপত্র হাপিস করার তালে ছিল ঠিকাদার ও তার মিস্ত্রিরা। রমজান যে ভাবে চুরি আটকেছিল, কোনও তুলনা হয় না।’’

কী করে ছকটা টের পেলেন রমজান? উত্তর এল, ‘‘এমনিতে এক কাপ চা চাইলেও ঠিকাদার খিঁচিয়ে উঠত। সে দিন সকালে নিজে থেকে চা, কোল্ড ড্রিঙ্ক খাওয়াতে চাইল দেখেই সন্দেহ হয়।’’ ২০১৫ সালে বিয়ে করেছেন রমজান। বললেন, ‘‘আমার স্ত্রী আমার অতীত জানে। তবে ওটা আমি ভুলে যেতে চাই। যা করেছি, খুব খারাপ করেছি।’’ নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে মাসে তাঁর বেতন সাত হাজার টাকা আর সেই সঙ্গে মিষ্টির দোকানে ফলের রসের কাউন্টার চালিয়ে আরও কিছু রোজগার। রমজানের কথায়, ‘‘মানুষ মরার পর নাকি
পুনর্জন্ম হয়। আমার তো জীবিত অবস্থাতেই পুনর্জন্ম হয়েছে। সৎ পথে আছি বলে হিম্মত এসেছে।’’

এই আত্মবিশ্বাস জোগানোর মূলে যিনি, তাঁরও এক জন্মে জন্মান্তর হয়েছে। তিনি নাইজেল আকারা। অলকানন্দা রায়ের পরিচালনায় কয়েদি থাকাকালীনই অভিনয় করেছিলেন ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য়। সেই থেকেই নাইজেলের সুখ্যাতির শুরু। নাইজেল এখন বড় পর্দার
পরিচিত মুখ, বহু মানুষের রোল মডেল। তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘মুক্তধারা’র মতো ছবি। জেল থেকে বেরিয়ে সেই নাইজেলই তৈরি করেছেন ‘কলকাতা ফেসিলিটিস ম্যানেজমেন্ট’। যাদের অন্যতম কাজ, বিভিন্ন সংস্থায় নিরাপত্তারক্ষী বহাল করা। সেই সংস্থাই কাজ জুগিয়ে দিয়েছে জহর আর রমজানকে। দু’জনে বললেন, ‘‘জেলেই আলাপ নাইজেল ভাইয়ের সঙ্গে। জেল থেকে বেরোনোর পর কেউ কাজ দিচ্ছিল না। তখন যোগাযোগ করায় নাইজেল ভাই বলল, সৎপথে থাকতে চাইলে আমার সঙ্গে আসতে পারো।’’

এ ভাবেও তবে ফিরে আসা যায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tangra jail security guard
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE