Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
State News

ডিএ-রায়: ‘ঘেউ ঘেউ’ মন্তব্য ফিরিয়ে নিন মুখ্যমন্ত্রী, বলছে সব বিরোধী

এই রায়কে কর্মী সংগঠনগুলি স্বাগত জানাচ্ছে। ডিএ-কে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছে, এটা খুব বড় জয়— বলছে কনফেডারেশন বা সরকারি কর্মচারী পরিষদের মতো সংগঠনগুলি।

হাইকোর্টের রায় বেরতেই বিরোধীদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

হাইকোর্টের রায় বেরতেই বিরোধীদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৮ ১৯:১৭
Share: Save:

বড়সড় ধাক্কা রাজ্য সরকারের জন্য। কলকাতা হাইকোর্ট শুক্রবার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল, মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) পাওয়া সরকারি কর্মীদের আইনসিদ্ধ অধিকার। আর এই রায়ে জেনেই বিরোধীরা সম্মিলিত ভাবে বহুচর্চিত ‘ঘেউ ঘেউ’ মন্তব্য নিয়ে কটাক্ষ ছুড়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে। ওই মন্তব্যের জন্য এ বার ক্ষমা চান মুখ্যমন্ত্রী, উঠল এমন দাবিও।

আইএনটিইউসি অনুমোদিত কর্মী সংগঠন ‘কনফেডারেশন’-এর মামলার প্রেক্ষিতেই মূলত এই রায় দিল হাইকোর্ট। রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দিচ্ছে না এবং বিপুল পরিমাণ ডিএ বকেয়া পড়েছে— এই অভিযোগ তুলে প্রথমে রাজ্য প্রশাসনিক ট্রাইবুনালের (স্যাট) দ্বারস্থ হয় কনফেডারেশন। কিন্তু স্যাটে রাজ্য সরকার জানায়, ডিএ কর্মীদের অধিকার নয়। বরং তা সরকারের ইচ্ছার উপরে নির্ভরশীল। স্যাটও সরকারের সেই তত্ত্বেই সিলমোহর দেয়। তার পরেই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় কর্মী সংগঠন। ১৭ মাস শুনানি চলার পরে কিছু দিনের জন্য রায় রিজার্ভ রেখেছিল আদালত। শুক্রবার হাইকোর্ট জানাল, স্যাটের রায় খারিজ করা হচ্ছে। ডিএ অবশ্যই কর্মীদের অধিকার, তা সরকারের ‘দয়ার দান’ নয়।

এই রায়কে কর্মী সংগঠনগুলি স্বাগত জানাচ্ছে। ডিএ-কে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছে, এটা খুব বড় জয়— বলছে কনফেডারেশন বা সরকারি কর্মচারী পরিষদের মতো সংগঠনগুলি। কিন্তু ডিএ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশ্নের নিষ্পত্তি কিন্তু হাইকোর্টে হয়নি। কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স বা সিপিআই মেনে ডিএ-র হার নির্ধারিত হবে কি না, বছরে ক’বার ডিএ ঘোষণা হবে, কোন সময়ে ডিএ ঘোষণা হবে, কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুসরণ করেই রাজ্য চলবে কি না— সে সব প্রশ্নের নিষ্পত্তি হওয়া এখনও বাকি। হাইকোর্টে শুনানি চলাকালীন যে হেতু এ নিয়ে বিশদে আলোচনা হয়নি, সে হেতু হাইকোর্ট এ দিন ওই সব বিষয়ে কোনও রায় দেয়নি। ডিএ-কে সরকারি কর্মীদের অধিকার হিসেবে মান্যতা দিয়ে কলকাতা হাইকোর্ট জানিয়েছে, বাকি প্রশ্নগুলির মীমাংসা স্যাট-ই করবে।

ডিএ মামলার রায় নিয়ে বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া।

কলকাতা হাইকোর্টের এই রায়কে কী ভাবে দেখছে রাজ্যের রাজনৈতিক শিবির? রায় বেরোতেই বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নানের মন্তব্য, ‘‘যাঁরা রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ঘেউ ঘেউ করা জীবের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, এটা তাঁদের পরাজয়।’’ তিনি বলেন, ‘‘সারা ভারতেই ডিএ হল সরকারি কর্মীদের একটি স্বীকৃত অধিকার। এ রাজ্যের কর্মীদেরকে দিনের পর দিন সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছিল। আমি আশা করি আর তা হবে না।’’

আরও পড়ুন: ‘দয়ার দান’ নয়, মহার্ঘ ভাতা আইনি অধিকার, রায় হাইকোর্টের, মুখ পুড়ল রাজ্যের

বামেদের প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র। বিধানসভার বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বিধানসভার গেটে মিডিয়ার মুখোমুখি হন। সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর বেতন নিয়ে শ্লেষাত্মক মন্তব্য করেন তিনি। সুজন বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজের মাইনেটা বাড়িয়ে নিলেন ১২ গুণ। আর শ্রমিক, কর্মচারী, মাস্টারমশাই, বোর্ড কর্মচারী, অশিক্ষক কর্মচারী— তাঁরা সব অন্যায় করেছেন? তাঁদের ডিএ দেবেন না? দয়ার দান!’’ হাইকোর্টের এই রায় আসলে ‘মানুষের জয়’, মনে করছেন সুজন।

আরও পড়ুন: বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত নিয়েও মমতার কাছে নালিশ দলেরই

কিন্তু ডিএ কী হারে দেওয়া হবে, কবে দেওয়া হবে, সিপিআই অনুযায়ী দেওয়া হবে কি না— সে সব হাইকোর্ট নির্ধারণ করে দিল না। সে সব নির্ধারণ করবে স্যাট। সেই স্যাট, যে ডিএ-কে কর্মীদের অধিকার বলে মানতে রাজিই হয়নি। সুবিচার কি হবে তা হলে? সুজনের ব্যাখ্যা, ‘‘ডিএ-কে আইনি অধিকার বলে দেওয়ার পরে স্যাটে পাঠানো হল, অর্থাৎ একটা ফ্রেম বেঁধে স্যাটে পাঠানো হল। তার বাইরে যাওয়া আর উচিত নয় স্যাটের। অযৌক্তিক হবে। আর যদি হয়, রাস্তার লড়াইতে তো মানুষ আছেনই।…রাস্তার লড়াই এবং আদালতের লড়াই, এই দুটো লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই অধিকারটাকে রক্ষা করতে হবে।’’

আর এক সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্যও এই রায়ের পরে তীব্র কটাক্ষে বিঁধেছেন মুখ্যমন্ত্রীকে। তিনি বলেছেন, ‘‘কেউ ঘেউ ঘেউ করবেন না— এই মন্তব্য করার জন্য মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী অন্তত এক বার দুঃখপ্রকাশ করুন এ বার।’’ তবে হাইকোর্টের রায়কে সরকার কতটা মানবে, তা নিয়ে তন্ময়বাবু সংশয় প্রকাশ করেন। এই সরকার আইন-কানুন-সংবিধান কিছুই মানে না বলে উত্তর দমদমের বিধায়কের মত।

বিজেপির বক্তব্যও ঠিক একই রকম। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র সায়ন্তন বসু বলেছেন, ‘‘এই সরকার রাজ্যের প্রকৃত উন্নয়ন বা মানুষের প্রকৃত সুরাহা নিয়ে ভাবে না। খেলা-মেলা-উৎসবের পিছনে পয়সা খরচেই এই সরকারের উৎসাহ বেশি। তাতে কারও প্রকৃত উন্নয়ন হোক বা না হোক, সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়। তাই কলকাতা হাইকোর্ট যে রায়ই দিক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উপরে তার খুব একটা প্রভাব পড়বে বলে আমরা মনে করছি না।’’

কিন্তু আদালত জানিয়ে দিয়েছে যে ডিএ কর্মীদের অধিকার। এর পরে সরকার তা অগ্রাহ্য করবে কী ভাবে? সায়ন্তনের ব্যাখ্যা, ‘‘আদালত তো সিদ্ধান্ত রূপায়ণ করবে না। আদালত শুধু নির্দেশ দেবে। রূপায়ণটা রাজ্য সরকারকেই করতে হবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংবিধান মানেন না। আদালতে তাঁর সরকার বার বার হারে। কিন্তু তার পরেও আদালতের নির্দেশ তিনি মানেন না। কোনও না কোনও ভাবে আদালতের নির্দেশকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রেও সে চেষ্টাই হবে।’’

বিরোধীদের আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নয়, তার আঁচ সরকার পক্ষের প্রতিক্রিয়া থেকেই পাওয়া গিয়েছে এ দিন। মুখ্যমন্ত্রী নিজে বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি। কিন্তু মন্ত্রিসভার হাই প্রোফাইল সদস্য তথা তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘সরকারের আর্থিক অবস্থাটার কথাও তো ভাবতে হবে।’’ ডিএ কর্মীদের অধিকার নয়, এ কথা সরকার কখনও বলেনি বলে পার্থবাবু দাবি করেছেন। তবে রাজ্যের কোষাগারের হাল না ভেবে ডিএ দেওয়ার নির্দেশ কতটা সঙ্গত, তা নিয়ে প্রশ্নবোধক অবস্থান নিয়েছেন পার্থবাবু।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE