শান্তিপুর পুরসভার পুরনো নথি। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
মেটে রাস্তা, খোয়া-বালি পড়েনি কিছুই।
পাঁকাল সেই আঁধার পথে লন্ঠন জ্বালানোর যাবতীয় ব্যবস্থা যখন প্রায় পাকা, বেঁকে বসলেন, নব্য পুরসভার টাউন কমিশনার— ‘যে পথে খোয়া পড়েনি, সেখানে পথবাতি কেন?’
দক্ষিণবঙ্গের প্রথম পুরসভা শান্তিপুরের তখন বছর দশেক বয়স।
লন্ঠনের জন্য বরাদ্দ ৩২৩ টাকা ৫ আনা ১ পয়সা, খুঁটির জন্য ১৫০ টাকা, আর, রেড়ির তেলের জন্য ১৯ টাকা ১৫ আনা ২ পয়সা— পুর বরাদ্দের তা হলে কী হবে? পুর অধিবেশনে ঝগড়া-কথা কাটাকাটির পরে টাউন কমিশনার শিবচন্দ্র পালের আপত্তি মান্যতা পেয়েছিল। ঝোলা লন্ঠনের ‘স্ট্রিট লাইট’ নয়, রাস্তা তৈরিতেই সায় দিয়েছিলেন পুরসভার অন্য কমিশনাররা।
১৮৫৩ সালে, গড়ে ওঠা শান্তিপুর পুরসভার অলিন্দে বাগবিতণ্ডা, আপত্তি-অভিযোগ, আবদার-অনুযোগের সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। যার খোঁজ দিচ্ছে পুরসভার উদ্যোগে তৈরি ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষিত নথিপত্র।
সম্প্রতি কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কেন্দ্র সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এবং রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা দফতরের মিলিত উদ্যোগে দক্ষিণবঙ্গের প্রথম ওই পুরসভার যাবতীয় নথি ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষিত করার কাজ শেষ হয়েছে। আর তা ঘাঁটতে গিয়েই দেখা যাচ্ছে ১৬৪ বছরের পুরনো পুরসভার ‘স্বভাব’ তেমন বদলায়নি।
শুধু তর্ক-বিতর্ক নয়, পুরসভার পুরনো ঝুলিতে রয়েছে এমন আরও লুকোনো বেড়াল!
১৮৮৬-তে শহরে চিতাবাঘের উপদ্রব বেড়ে গিয়েছিল। এখন যেখানে রাতদিন তাঁতিপাড়ার মাকু ঘুরছে অবিরাম, আদতে তা ছিল শাল-সেগুন-শিশুর ঘন বন। পুরসভার আনাচ-কানাচে জলা আর ঝোপ ছিল দেদার। চিতাবাঘ, হায়না, বাঘরোলের অবাধ আস্তানা। টাউন কমিশনারেরা অনেক ভেবেচিন্তে চিতার দৌরাত্ম্য রুখতে শিকারি নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
শিকারি এলেন, সুমেরুদ্দিন শেখ। মাসিক বেতন ১৫ টাকা। দিন কয়েকের মধ্যেই মাচা থেকে সুমেরুদ্দিনের গুলিতে ঝাঁঝরা হল খানকয়েক চিতাবাঘ। খুশি হয়ে সুমেরুদ্দিনকে ২০ টাকা বখশিসও দিলেন পুর কর্তৃপক্ষ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল শান্তিপুর। মরা বাঘ দেখতে সে কী ভিড়! সামাল দিতে বরকন্দাজদের ঘাম ছুটেছিল। যার উল্লেখও রয়েছে ওই নথিতে।
বরকন্দাজদেরই হোগলাপাতার ছাতা দেওয়া নিয়েও কোন্দল বাধে পুরসভায়। টাউন কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই বরকন্দাজদের ছাতা দেওয়ার পক্ষে থাকলেও বেঁকে বসেন অন্যেরা। তাঁদের যুক্তি, বরকন্দাজরা মাসে ৬ টাকা বেতন পান। তাঁরা ওই টাকাতেই দিব্যি ছাতা কিনতে পারবেন।
মান্ধাতা আমলের সেই সব ধুলো-ঢাকা নথি ঢাউস খাতায় পুরসভার সেরেস্তায় পড়েছিল অবহেলায়। ২০০২ সালে পুরসভার দেড়শো বছর পূর্তির সময় পুরপ্রধান অজয় দে-র নজরে পড়ে ওই খাতার স্তূপ। দু’একটি খাতার পাতা উল্টে চমকে উঠেছিলেন তিনি। সেই নথি উদ্ধার করে সযত্নে বাঁধানো হয় তাঁর উদ্যোগেই। সব মিলিয়ে ৭৮টি খণ্ড।
কিন্তু এমন দুর্লভ অতীতকে মলাটবন্দি করে ফেলে রাখলে তো ফের নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ডিজিটাল যুগে আর দ্বিতীয় বার ভাবেননি অজয়। ২০১৫ সালে তাই শুরু হয় ডি়জিটাল সংরক্ষণের কাজ। অজয়বাবুই এখনও পুরপ্রধান। তাঁর দাবি, ‘‘দেড়শো বছর পার করা পুরসভা হয়তো অনেক আছে। কিন্তু ১৬৪ বছরের নথির এমন সুসংরক্ষণ রাজ্যে এই প্রথম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy