“পুণ্যতোয়া ভাগীরথী কুলু কুলু বহে। গুপ্তিপাড়া-শান্তিপুর দুই তটে রহে।।”
মধ্যযুগ থেকেই গুপ্তিপাড়ার এই খ্যাতি জানা ছিল বাঙালির। সেই গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্যপূর্ণ বৃন্দাবন মন্দিরের ভোলবদলের প্রায় শেষ পর্যায়ে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)। ১৯৩০ সালে তারা সাড়ে চারশো বছরেরও বেশি পুরনো এই মন্দির সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয়। প্রায় ৮৩ বছর বাদে শুরু হয় সংস্কার-প্রক্রিয়া। শীঘ্রই এই পর্যায়ের সংস্কার শেষ হবে বলে সর্বেক্ষণের আশা। গুপ্তিপাড়া-বলাগড় পর্যটন-হাব করার জন্য অতি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে লিখিত প্রস্তাবও জমা পড়েছে।
কথিত, বারোয়ারি দুর্গাপুজো ছাড়াও জগদ্ধাত্রী পুজোর সূত্রপাত হুগলির এই গুপ্তিপাড়ায়। নবাব সিরাজের অন্যতম প্রধান সেনাপতি মোহনলাল জন্মেছিলেন গুপ্তিপাড়ায়। ভোলা ময়রার শহরও এটি। তবে, গুপ্তিপাড়ার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ একলপ্তে চারটি প্রাচীন মন্দির। স্টেশন থেকে বাসে রথতলা, সেখান থেকে মিনিট পনেরো পায়ে হেঁটে বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দির। এর বাঁ দিকে, বিশাল ওই প্রাচীর ঘেরা চত্বরে রামচন্দ্র মন্দির, ডান দিকে কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির ও শ্রীচৈতন্য মন্দির। প্রায় প্রতিটিতেই শুরু হয়েছে সংস্কার ও সংরক্ষণের কাজ।
কী ভাবে হচ্ছে এই কাজ? প্রথমে মন্দিরগুলোর বাইরের ক্ষয়প্রাপ্ত অংশ মেরামতি শুরু হয় ২০১৩-র অক্টোবর মাসে। এখন চলছে বৃন্দাবন মন্দিরের ভিতরের কাজ। এই কাজ শুরু হয়েছে গত জুলাই থেকে। ৮ জনের একটি শিল্পীদলের দায়িত্বে রয়েছেন সরকারি চারু ও কারুকলা কলেজ থেকে পাশ করা এএসআইয়ের বিশেষজ্ঞ। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেন, “শান্তিনিকেতন, হাজারদুয়ারি-সহ নানা ঐতিহ্যপূর্ণ জায়গায় সংরক্ষণের কাজ করেছি। কিন্তু গুপ্তিপাড়ার এই কাজটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।”
বাঁশের ভাড়া বেঁধে ৬০ ফুট উঁচু বৃন্দাবন মন্দিরের দেওয়ালের আবছা হয়ে যাওয়া শিল্পকর্মে তুলি বোলাচ্ছেন শিল্পীরা। এক শিল্পী বলেন, “কেউ কেউ এত কাল বলছিলেন এগুলো ফ্রেসকো। তা নয়, এগুলো ম্যুরাল। আকর্ষণবৃদ্ধি নয়, সব সময়ে মাথায় রাখতে হচ্ছে মূল আদলটাকে ফুটিয়ে তোলা। এখন বাইরের বিচ্ছুরিত আলোর পাশাপাশি বৈদ্যুতিক বাতি আছে, ফ্যানের হাওয়া পাচ্ছি। তাতেও কত ধৈর্য্য নিয়ে সূক্ষ্ম কাজগুলো করতে হচ্ছে। সদ্য নির্মিত মন্দিরে শিল্পীরা গরম এবং অল্প আলোয় কী ভাবে মূল কাজগুলো করেছিলেন, ভেবে সত্যিই অবাক হতে হয়!”
আঁকার কাজ হচ্ছে দেওয়ালের আড়াই হাজার ঘনমিটার অংশে। বৃন্দাবন মন্দিরের ভিতরের প্রবেশ পথের দু’পাশে দেওয়াল ১৬ ইঞ্চি লম্বা, ১২ ইঞ্চি চওড়া ব্লকে ভাগ করা। কোনওটিতে ফুল, কোথাও পৌরানিক নানা আখ্যান, কোথাও বা ভূত-পেত্নির ছবি। মন্দিরের দুটি জায়গায় বৃন্দাবন ও জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার আসন। মন্দিরের টেরাকোটার কাজ দেখার মতো। বাংলার নিজস্ব পুরাকীর্তির পারদর্শিতা ফুটে উঠেছে এতে। মন্দিরগুলো কে, কবে তৈরি করেন, তা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। গুপ্তিপাড়া শ্রীশ্রী বৃন্দাবনচন্দ্র জিউ মঠে প্রশাসক গোবিন্দানন্দ পুরি বলেছেন, “গোড়ায় তৈরি হয় বৃন্দাবন মন্দির। বয়স সাড়ে চারশোর উপর। রামচন্দ্র মন্দিরের বয়স ৩০০ বছরের মতো।”
গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্য তুলে ধরতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আর্জি জানান স্থানীয় সাংসদ রত্না দাস নাগ। তিনি বলেন, “গুপ্তিপাড়ার মন্দিরের কথা অনেকে জানেন না। এখানকার রথের ঐতিহ্যও অপরিসীম। গুপ্তিপাড়া-বলাগড়কে পর্যটন-হাব করতে সংসদে প্রস্তাব জমা দিয়েছি। এটা কার্যকর হলে এলাকার অর্থনীতিও উপকৃত হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy