জলমগ্ন দুর্গাপুরের মেনগেট এলাকার স্টিল পার্ক।
জলাশয় ভরাট বা নদীর গতিপথ আটকে নির্মাণ নিয়ে বারবারই সরব হয়েছেন বাসিন্দারা। এই বেনিয়মের ফল কতটা খারাপ হতে পারে, গত এক মাসের মধ্যে দু’বার ভারী বৃষ্টি তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল খনি-শিল্পাঞ্চলে।
শনিবার থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। মঙ্গলবার পর্যন্ত দফায়-দফায় তা চলেছে। আর তার জেরে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে আসানসোল, জামুড়িয়া থেকে দুর্গাপুর, কাঁকসার বিস্তীর্ণ এলাকা। বেশ কিছু মাটির বাড়ি ভেঙে পড়েছে। অনেক জায়গায় বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চলে। ব্যবস্থা হয়েছে ত্রাণের। অনেক এলাকাতেই বাসিন্দাদের অভিযোগ, নিকাশি ব্যবস্থা সংস্কারের অভাব ও জলাশয় বা নদীর পাড় ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার জেরে বৃষ্টি হলেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
আসানসোল পুরসভায় ২৩, ৩০, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। গাড়ুই নদী দীর্ঘদিন নদী সংস্কার না হওয়ায় জল উপচে আশপাশে ঢুকে পড়েছে। আসানসোলের ২ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে কাল্লা যাওয়ার রাস্তাটিতে গাড়ুইয়ের উপরের সেতুটি জলে ডুবে যাওয়ায় যাতায়াত সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। দিলদারনগরের নিচুপাড়ার অনেকাংশ জলমগ্ন হয়েছে। বাসিন্দারা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। জলের তোড়ে তিনটি মাটির বাড়ি ভেঙে পড়েছে। তবে কেউ হতাহত হননি।
অন্ডালের বহুলা তুরিপাড়ায় ভেঙে পড়ল বাড়ি।
কুলটির ৬১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রিয়া কলোনিও জলের তলায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, কুলটিতে জিটি রোডে কয়েকটি কালভার্ট তৈরির জন্য নালার জল আটকে রাখায় এলাকা বেশি জলমগ্ন হচ্ছে। বারাবনিতেও অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চলগুলি জলমগ্ন হয়েছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, যথেচ্ছ পুকুর ও জলাশয় ভরাট ও নদীর গতিপথ আটকে নির্মাণের জন্যই বর্ষায় এই সমস্যা হচ্ছে।
জামুড়িয়ার বীজপুরে বাউরি ও আচার্য পাড়ার তিনটি মাটির বাড়ি ভেঙে পড়েছে। পুকুরের জল উপচে বেশ কয়েকটি বাড়ি জলমগ্ন হয়। রানিগঞ্জের বল্লভপুরে নিচু এলাকায় নর্দমার জল ঢুকে গিয়েছে কৃষিজমিতে। ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। মঙ্গলবার জামুড়িয়ার বাঁকশিমুলিয়া যাওয়ার প্রধান রাস্তার একাংশ ধসে গিয়েছে। বৃষ্টির জেরে মাটি আলগা হয়েই এই বিপত্তি বলে এলাকাবাসীর দাবি। অন্ডালের বহুলায় তুরিপাড়াতেও মাটির বাড়ি ভেঙেছে।
মঙ্গলবার আসানসোলে জলমগ্ন নানা এলাকা পরিদর্শন করে পুরসভার একটি দল। রেলপাড়ের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত পুর কর্তৃপক্ষ। মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারি বলেন, ‘‘দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, অবিলম্বে গাড়ুই সংস্কারে জোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া শহরের নর্দমাগুলি পরিষ্কারেও নজর দেওয়া হবে। চার দিনের প্রবল বৃষ্টিতে রেলের প্রত্যেকটি ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাসগুলি কী অবস্থায় রয়েছে তা দেখতে রেলের আধিকারিকেরা ঘুরে গিয়েছেন। জলবাহিত রোগের প্রকোপ রুখতে স্বাস্থ্য ও নিকাশি দফতরকে নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র।
জামুড়িয়ার বাঁকশিমুলিয়ায় ধস রাস্তায়।
দুর্গাপুর পুর এলাকায় ১৩, ১৪, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে পরিস্থিতি বেশ খারাপ। তামলা খালের পাড়ে বেআইনি নির্মাণের অভিযোগে বেশ কিছু দিন আগে থেকেই সরব হয়েছেন বাসিন্দারা। সোমবার রাত থেকে সেই খাল উপচে জল ঢুকতে শুরু করে আশপাশে। কাদা রোড, ওয়ারিয়া, মেনগেট এলাকায় জল জমতে শুরু করে। দামোদরের পাড়ে বীরভানপুর বা অঙ্গদপুরের নীচের দিকেও জল জমতে শুরু করে। সগড়ভাঙার আরআইপি প্লটেও জল জমে। রাতেই মেনগেট ও তামলা নালার আশপাশের কিছু বাসিন্দাকে উঁচু জায়গায় সরিয়ে নিতে হয়। মেনগেট এলাকার বহু একতলা বাড়িই ডুবে গিয়েছে। মহকুমাশাসক (দুর্গাপুর) শঙ্খ সাঁতরা হাসপাতালের সুপারকে দ্রুত মেডিক্যাল টিম পাঠানোর আর্জি জানান। টানা বৃষ্টিতে জল জমে ইস্পাতনগরীর কিছু এলাকায়। রাতুড়িয়ার কাছে তামলা নালার উপরে সেতুর নীচের অংশে ফাটল দেখা গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, বর্ষণের জেরেই এই ফাটল। মহকুমা বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের আধিকারিক দেবেশ চট্টোপাধ্যায় ও ডেপুটি মেয়র অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখেন। ডেপুটি মেয়র বলেন, ‘‘পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসনের সঙ্গে এগোনো হচ্ছে। তবে এর পরেও বৃষ্টি চললে কী ভাবে সামলানো যাবে তা বলা মুশকিল।’’
দুর্গাপুর মহকুমার নানা ব্লকেই ক্ষতি হয়েছে। তবে সবিস্তার রিপোর্ট হাতে না আসায় নিশ্চিত ভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি বলে প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে। লাউদোহায় টুমনি নদী উপচে বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। চারটি মাটির বাড়ি ভেঙে পড়েছে কাঁকসার সিলামপুরে। কাঁকসার হাজরাবেড়া, কুলডিহা, আমলাজোড়ার বিভিন্ন জায়গা জলমগ্ন হয়েছে। সোমবার ব্লক প্রশাসনের কর্তারা সিলামপুরে দামোদরের পরিস্থিতি দেখতে যান। জল বাড়ায় সেখানকার মানুষজনকে সতর্ক করা হয়েছে বলে বিডিও অরবিন্দ বিশ্বাস জানান। কুনুর-সহ বিভিন্ন খালের জলও বেড়েছে।
নদী উপচে আসানসোলে জলের তলায় সেতু।
মঙ্গলবার ছবিগুলি তুলেছেন বিকাশ মশান, শৈলেন সরকার ও ওমপ্রকাশ সিংহ।
মহকুমাশাসক জানান, সব ব্লককে পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহকুমা বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের আধিকারিক দেবেশবাবু বলেন, ‘‘চাল ও ত্রিপল যা ছিল ইতিমধ্যে বিলি করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের কাছে আরও ত্রাণ সামগ্রী চেয়ে পাঠানো হয়েছে।’’
দুর্গাপুরের অঙ্গদপুরে পুরসভার প্রধান জলশোধনাগারে দামোদর থেকে জল আসার ক্যানালে আশপাশের কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য-সহ জল মিশেছে বলে দাবি এলাকার অনেকের। ডেপুটি মেয়র বলেন, ‘‘এই খবর শুনে পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। জলের গুণমান পরীক্ষা করে সন্ধে পর্যন্ত খারাপ কিছু মেলেনি। তবে জল পরিশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। দিন কয়েক আগে কারখানাগুলিকে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে বলেছিল প্রশাসন। ফের পদক্ষেপ করতে আর্জি জানানো হচ্ছে প্রশাসনকে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy