Advertisement
১৬ মে ২০২৪
Durgapur Temperature

ঠান্ডায় কাঁপছেন ওঁরা, উত্তাপ বহু দূর

ঝাঁ চকচকে শহর দুর্গাপুরের এক দিকে যখন নাগরিক-বিনোদনের নানা উপকরণ, তখন শীতে কাঁপছেন বহু মানুষ, নিরাশ্রয় ভবঘুরেরা। প্রশ্ন উঠছে, কী করছে প্রশাসন।

দুর্গাপুর স্টেশনে। ছবি: বিকাশ মশান

দুর্গাপুর স্টেশনে। ছবি: বিকাশ মশান

সুব্রত সীট
দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৩ ০৭:৪৬
Share: Save:

রাত ৮টা। দুর্গাপুর স্টেশন। তাপমাত্রা প্রায় ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বছর ছয়েকের ছেলেকে নিয়ে গুটিসুটি মেরে সবে শুয়েছিলেন এক মহিলা। কম্বল টেনে কাঁপতে-কাঁপতে বললেন, “বড় ঠান্ডা। বিশেষ করে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত খুব কষ্ট পাই। ছেলেটাকে নিয়ে বেশি চিন্তা হয়।”

— শুধু ওই মহিলাই নন, ঝাঁ চকচকে শহর দুর্গাপুরের এক দিকে যখন নাগরিক-বিনোদনের নানা উপকরণ, তখন শীতে কাঁপছেন বহু মানুষ, নিরাশ্রয় ভবঘুরেরা। প্রশ্ন উঠছে, কী করছে প্রশাসন। নাগরিক দায়বদ্ধতাই বা কোথায় দাঁড়িয়ে।

দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের রাতের তাপমাত্রা গত কয়েক দিন ধরেই ৯-১০ ডিগ্রির আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। খুব দরকার না পড়লে, বাড়ির বাইরে লোকজন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। প্রবীণদের অনেকেই গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলছেন, “এমন ঠান্ডা গত কয়েক বছরে পড়েনি।”

অথচ, রাতে বেরোলেই দুর্গাপুর স্টেশন, সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ড এবং বাজার মিলিয়ে শ’খানেক ভবঘুরের দেখা মেলে। দুধের শিশু, অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী, মধ্যবয়স্ক— নানা বয়সের বহু মানুষের ভিড় সেইভবঘুরের দলে।

দুর্গাপুর স্টেশন লাগোয়া বাসস্ট্যান্ড। মাথার উপরে খোলা আকাশ। হিম পড়ছে। খোলা চত্বরেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া কম্বল মুড়ে কোনও রকমে শীতের সঙ্গে চলছে লড়াই। ও-দিকে স্টেশনের সামনের চত্বরেও একই ছবি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁদেরই এক জন, বছর ৪০-এর এক ব্যক্তি বললেন, “রেল পুলিশ মাঝেমধ্যে আসে। সরিয়ে দেয়। হাতেপায়ে ধরে, তবুও মাথা গুঁজে থাকি। খুব ঠান্ডা এ বার। কম্বল দিয়ে মাথা মুড়ে শুয়ে থাকি। কিন্তু মাঝ রাতের পরে শীত যেন আর বাগ মানতে চায় না।” কাছেই থাকা এক বৃদ্ধও জানান, গায়ে নেওয়ার মতো মোটা জামা, কম্বল কিছুই ছিল না তাঁর। তবে তিনি বলেন, “কিছু দিন আগে কয়েক জন কম্বল দিয়ে গিয়েছে। কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি।”— শুনতে-শুনতে মনে হতে পারে, এ যেন এক নেই-রাজ্য। একই ছবি বেনাচিতির প্রান্তিকা বাসস্ট্যান্ড, সিটি সেন্টার বাসস্ট্যান্ডেও।

দীর্ঘদিন ধরেই মাঝেমধ্যে সঙ্গীদের নিয়ে রাতে ভবঘুরেদের মধ্যে খাবার বিলি করেন সন্তোষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর একটি রাজনৈতিক পরিচয়ও রয়েছে। তবে, সে সব দূরে সরিয়ে রেখে, স্টেশন চত্বরে খাবার বিলি করতে-করতে তিনি বলেন, “ভবঘুরেদের বেশির ভাগেরই দিন কাটে ভিক্ষাবৃত্তি করে, চেয়েচিন্তে। তাঁরা অন্য কোথাও যেতে চান না। তবে শীত আর বর্ষার সময়টা ওঁদের খুব কষ্টে কাটে।”

কিন্তু কী করছে প্রশাসন? দুর্গাপুর পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, শহরের ভবঘুরে ও আশ্রয়হীনদের মাথা গোঁজার জন্য ২০১৭-য় আধুনিক চারতলা বাড়ি গড়ে ওঠে বিধাননগরের ভ্যাম্বে কলোনি লাগোয়া এলাকায়। নাম, ‘অভয়াশ্রম’। নির্মাণে খরচ হয়েছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা। বিছানাপত্র, খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসার দায়িত্ব পুরসভার। পুর-প্রশাসক অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে অভয়াশ্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেটির তরফে অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, রাতে ভবঘুরে ও আশ্রয়হীনদের খুঁজে রাস্তা থেকে তুলে অভয়াশ্রমে আনার চেষ্টা করেন তাঁরা। তবে সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, ভবঘুরেদের অনেকে অভয়াশ্রমে আসতে চান না। আবার অনেকে এসেও চলে যান। অরিন্দম বলেন, “অভয়াশ্রমে এসে নিয়মের বেড়াজালে থাকতে চান না অনেকে। জোর করে কাউকে আটকে রাখা যায় না। তবে আমরালাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাই।”

চেষ্টা হয়তো চালাচ্ছেন কেউ কেউ। কিন্তু তার পরেও শীতের থাবা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন কি ওই ভবঘুরেরা? প্রশ্ন মাথায়, নাগরিক আলোয় পিছলে যাওয়া শহুরে পথে হাঁটতে হাঁটতে যেন মনে হতে পারে— “সূর্য!/ তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে/ উত্তাপ আর আলো দিও,/ আর উত্তাপ দিও/ রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।’ (‘হে সূর্য’, সুকান্ত ভট্টাচার্য) (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durgapur Winter season
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE