পরিকল্পনা ছাড়াই বাঁধের ধারে উঠেছে ঘর। —নিজস্ব চিত্র।
শহরের সমস্ত পরিষেবা মেলা দূর অস্ত, তবু বহিরাগতদের ভিড় বেড়েই চলেছে মেমারিতে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জমির দামও। ফলে শহরের চারপাশে অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠছে জনবসতি। স্বাভাবিক ভাবেই আশঙ্কা জাগছে, এখনই রাশ না টানতে না পারলে পরিকাঠামো গড়ে ওঠার আগেই ভেঙে পড়বে শহর।
এমনিতে কৃষিপ্রধান এলাকা হিসেবেই মেমারি পরিচিত। আলু ও ধানের ব্যবসায় জেলার অন্যতম এ শহর। ফলে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে অনেকেরই আনাগোনা রয়েছে শহরে। গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাঙ্কও। এ রকমই এক ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলেন, ‘‘আমরা সমীক্ষায় দেখেছি বর্ধমানে এই মূহুর্তে উন্নয়নশীল শহর মেমারি। বাণিজ্যিক ভাবেও লাভবান। সেই কারণেই বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলো মেমারিতে শাখা খোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হচ্ছে। আমাদের কাছে খবর আছে, আরও কয়েকটি ব্যাঙ্ক তাদের শাখা খোলার জন্য জায়গা দেখে গিয়েছে।” মেমারি শহরে আইনশৃঙ্খলা নিয়েও বাসিন্দাদের অভিযোগ অনেকটাই কম। বিশেষত, রাতবিরেতেও শহরে নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে পারেন বাসিন্দারা। পুরসভা সূত্রেও জানা গিয়েছে, পানীয় জলের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বড় প্রকল্পের অনুমোদন মিলেছে। এ ছাড়াও শহরের বাসিন্দাদের দীর্ঘ দিনের চাহিদা মেনে দমকল ও স্টেডিয়াম তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে গেল জমির দাম আরও বাড়বে বলে মনে করেন পুরকর্তারা।
তবে ইতিমধ্যেই, গত কয়েক বছরে প্রায় ৪-৫ গুণ জমির দাম বেড়েছে শহরে, পুরনো বাসিন্দাদের কাছে যা কল্পনাতীত। শহরের প্রবীণ বাসিন্দা সনাতন দত্তর মতে, “এমনিতেই অর্থনৈতিক ভাবে সম্বল বাসিন্দারা গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে ঝুঁকছেন। তার মধ্যে মেমারি নিরুপদ্রব হওয়ায় ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় ভিড় আরও বাড়ছে। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে জোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি হলে দাম বাড়বেই।” মেমারির বাসিন্দারাও জানান, শহর ছাড়িয়ে গ্রামীণ এলাকাতেও জমি কেনার চাহিদা বাড়ছে। মেমারি শহর লাগোয়া আমাদপুর, তাতালপুর, নদীপুর, পারিজাতনগর ও নিমো ১ পঞ্চায়েত এলাকায় জমি কেনার চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। শহরের এক যুবক মানস ঘোষের দাবি, “শহরের ভিতর জমি আর সে ভাবে নেই বললেই চলে। তাই শহর লাগোয়া এলাকায় জমি কেনার উৎসাহ দেখা যাচ্ছে।” মূলত শিক্ষক ও ব্যবসায়ীরা এই জমি কিনছেন বলেও জানা গিয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে জানা গিয়েছে, কয়েক বছর আগেও শহরের ভিতর প্রতি কাঠা জমির দাম ছিল এক লক্ষ টাকা, সেই জমিরই এখন দাম অন্তত তিন লক্ষ টাকা। এমনকী বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে ওঠেনি এমন জায়গাতেও পাঁচ লক্ষ টাকা কাঠায় অনায়াসে বিকোচ্ছে জমি। আর সুযোগসুবিধে রয়েছে, গাড়ি যাতায়াত করতে পারে এমন জায়গার দাম মেমারি শহরে ৮ থেকে ১২ লক্ষ টাকা প্রতি কাঠায়। তবে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সরাসরি জমি বিক্রি নিয়ে দরাদরি হলে দাম এমন আকাশছোঁয়া হত না বলেও বাসিন্দাদের অনেকেরই ধারণা। তাঁরাই জানাচ্ছেন, জমি কেনা মানেই দালালের খপ্পরে পড়ে যাওয়া। তাতেই দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে। আবার জমি মালিকদের একাংশের দাবি, জমি বিক্রি মানেই হাজারো সমস্যা। সেখানে দালালকে দায়িত্ব দিলে ভূমি সংস্কার দফতর থেকে জমি নিবন্ধীকরণ দফতরের নানা সমস্যা তাঁরাই মিটিয়ে দেন। ফলে জমি বিক্রি করার সমস্যা অনেকটাই লাঘব হয়। তবে আখের গোছাতে দালালদের একাংশ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে বলেও অভিযোগ। শহরের বাসিন্দারাই জানান, অনেক দালালই ৫-৬ জন মিলে একটি দল গড়ে ‘বিতর্কিত’ জমি কিনছেন। তারপর ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের একাংশ কর্মীর ‘সহযোগিতা’য় জমির নথি ঠিক করে বিক্রির উপযুক্ত করে নিয়ে চড়া দামে বিক্রি করছেন। এভাবে অনেক জমিতেই অপরিকল্পিত ভাবে বসতি গড়ে উঠছে। অদূর ভবিষ্যতে যেখান থেকে নিকাশি সমস্যার মতো বেশি কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে বলেও বাসিন্দাদের আশঙ্কা।
জমির পাশাপাশি শহরে চাহিদা বাড়ছে বাড়ি ভাড়ারও। মেমারির ২টি ব্লক তো বটেই, মন্তেশ্বর, কালনার একটি ব্লক, রায়না, জামালপুর-সহ মেমারি লাগোয়া হুগলি এলাকার শিক্ষকদের একটা বড় অংশ, সরকারি কর্মচারী ও বেশ কিছু ব্যবসায়ী মেমারি শহরের উপর নির্ভরশীল। তাঁরাই মেমারিতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকছেন। বাড়ির মালিকরা জানিয়েছেন, চাহিদা বাড়ায় ভাড়ার মাত্রাও বাড়ছে। তবে এলাকা অনুযায়ী বাড়ি ভাড়ার তারতম্য রয়েছে। যেমন, শহরের নবপল্লি, ডিভিসি পাড়া, মায়ের কোলের মতো কয়েকটি জায়গায় বাড়ি ভাড়া চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে ঘোরাঘুরি করে। আবার অন্য জায়গায় মোটামুটি ভাবে তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকাতেও বাড়ি ভাড়া মেলে। এমনকী শহরে নতুন বাড়ি বানাচ্ছেন যাঁরা, তাঁরাও বাড়ি ভাড়া দেওয়ার পরিকল্পনা করেই বাড়ির নকশা তৈরি করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy