হাওড়ার বেতড়ে আর জি করের জন্মভিটে।
সরস্বতী নদী একদা বয়ে যেত হাওড়ার বেতড়ের এই বাড়িটার সামনে দিয়ে। কালের কশাঘাতে হেজেমজে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে সেই সরস্বতী। এই বাড়িটায় সরস্বতীর যে-বরপুত্রের জন্ম, শারীরিক ভাবে তিনিও আর নেই। তবে তাঁর কীর্তি অক্ষয় হয়ে আছে নানান প্রবাদে, কিংবদন্তিতে। আর তাঁর স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উত্তর কলকাতার আর জি কর হাসপাতাল।
অথচ বেতড়ের এই করবাড়িই যে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রাণপুরুষ রাধাগোবিন্দ করের জন্মভিটে, কয়েক দিন আগে পর্যন্তও তা জানত না ওই কলেজের শতবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি। ওই কমিটির সদস্যদের ধারণা ছিল, প্রবাদপ্রতিম এই চিকিৎসকের আদি বাড়ি ঢাকায়। আর উত্তর কলকাতায় তাঁর বসতবাড়িটি হস্তান্তরিত হয়ে গিয়েছে বহু বছর আগেই। বাঙালি কতখানি ইতিহাস-বিমুখ, তা টের পেয়ে ব্যথিত হয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। এ ক্ষেত্রে বিস্মৃত ইতিহাস উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বিশেষ সূত্রে হাওড়ার বাড়ির খবর মেলায়। সেই খবরের সত্যতা যাচাই করার পরে হাতে সময় ছিল মাত্রই তিন দিন। সেই তিন দিনেই সেজে উঠল করবাড়ি। রবিবার, ২৩ অগস্ট রাধাগোবিন্দবাবুর ১৬৬তম জন্মদিন উদ্যাপিত হল ওই বাড়িতেই।
সেখানেই তাঁর ১৬৬তম জন্মদিন উপলক্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য।
কোনা এক্সপ্রেসওয়ে থেকে কিছুটা দূরে তস্য গলির ভিতরে ভাঙাচোরা বিশাল ইমারত। সামনে, আশেপাশে আগাছার জঙ্গল। রাধাগোবিন্দবাবু যে-ঘরে জন্মেছিলেন, তার কয়েকটা খিলান ছাড়া বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই। ৩০ ফুট উঁচু ঠাকুরদালানও যেন ভেঙে পড়ছে। এই অবস্থায় তড়িঘড়ি সামনের এবড়োখেবড়ো জমি সমতল করে, আগাছা কেটে ভদ্রস্থ করে তোলা হয় ৪৬ নম্বর শাস্ত্রী নরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি রোডের বাড়িটিকে। সাজিয়েগুজিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এক চিলতে অংশে।
কর পরিবারের প্রবীণতম সদস্যা অঞ্জলি করকে সংবর্ধনা জানানো হয় এ দিনের অনুষ্ঠানে। কর পরিবারের সদস্য অতনু কর বাড়িটির আমূল মেরামতির প্রয়োজনের কথা বলেন। শতবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটির সদস্যেরা জানালেন, নিছক এক দিনের উদ্যাপনেই থামবেন না তাঁরা। এ শুধু সূচনা মাত্র। এর পরে ধাপে ধাপে তাঁরা এই বাড়িতে যথাযথ সংস্কারের কাজ চালিয়ে যাবেন।
১৭৫৪ সালে তৈরি ওই বাড়িতে এখন কর পরিবারের তিন শরিকের বাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বা়ড়িটিকে নানা ভাবে ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশরা। তারই একটি ঘরে ১৮৫০ সালের ২৩ অগস্ট ভূমিষ্ঠ হন রাধাগোবিন্দ কর। বেশ কিছু বছর সেখানে ছিলেন তিনি। তার পরে হেয়ার স্কুল, মেডিক্যাল কলেজের পাট চুকিয়ে পড়তে যান লন্ডনে। বিলেত থেকে ফেরার পরে উত্তর কলকাতায় একটি বাড়ি কিনে সেখানেই বসবাস এবং প্র্যাক্টিস শুরু করেন। তবে তার পরেও বেতড়ের বাড়িতে যাতায়াত বন্ধ হয়নি তাঁর।
সেই দেশবরেণ্য চিকিৎসকের বাড়িটিকে যে বিক্রি না-করে এখনও রেখে দেওয়া হয়েছে, তার জন্য কর পরিবারকে বারবার ধন্যবাদ জানালেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ও বর্তমান পড়ুয়ারা। এ দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ শুদ্ধোদন বটব্যাল, সুপার প্রবীর মুখোপাধ্যায়, ডেপুটি সুপার সুপ্রিয় চৌধুরী, প্রবীণ চিকিৎসক পরমেশ কর, ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ পালিত প্রমুখ।
পুরনো নানা ঘটনার উল্লেখ, রাধাগোবিন্দবাবুকে নিয়ে প্রচলিত গল্পের ভাঁড়ার এ দিন উপুড় করে দেন প্রবীণ চিকিৎসকেরা। আর সেই গল্পের হাত ধরেই উঠে আসে সাইকেলে চড়ে লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিখরচায় রোগী দেখা এক ডাক্তারবাবুর ছবি। কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিই যাঁকে নিজের অবস্থান থেকে এক চুল নড়াতে পারেনি।
এ দিনের অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা, আর জি করের প্রাক্তন ছাত্র, চিকিৎসক উমাপ্রসন্ন ঘোষাল বলেন, ‘‘আমরা চাই, এই জন্মভিটে সংরক্ষণ করে এখানে একটি সংগ্রহালয় গড়ে তোলা হোক।’’ এ ছাড়া রাধাগোবিন্দের নামে রাস্তা, বেতড় মোড়ে তাঁর মূর্তি বসানো, সাঁতরাগাছি স্টেশনকে আর জি করের নামে চিহ্নিত করার দাবিও জানাচ্ছেন তাঁরা। উমাপ্রসন্নবাবু জানান, এই সব দাবিই প্রস্তাবের আকারে রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হচ্ছে। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে রাধাগোবিন্দবাবুর নামে একটি ‘চেয়ার’ চালু করার প্রস্তাবও আছে।
রবিবার দীপঙ্কর মজুমদারের তোলা ছবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy