বিস্ফোরণে মৃতদের জামাকাপড় ঝুলছে গাছে। বৃহস্পতিবার ব্রাহ্মণবাড় গ্রামে। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
একফালি মোরামের রাস্তাটা সটান গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে আধপোড়া বাঁশঝাড়ে।
কোমর থেকে ছিন্ন পা-টা ঝুলে রয়েছে সেখানেই। সেই দেহাবশেষে লেপ্টে থাকা রক্ত-ভেজা হাফপ্যান্টটা হাওয়ায় তখনও দুলছে।
বৃহস্পতিবার সাতসকালে পিংলার ব্রাহ্মণবাড় এমনই এক যুদ্ধদীর্ণ চেহারা নিয়ে পড়ে রয়েছে।
সিভিক ভলান্টিয়ারের জনা কয়েক কর্মী বাঁশের ডগা দিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দেহাবশেষ আর পোড়া বাজি জড়ো করার ফাঁকে নাকে রুমাল বেঁধে বলছেন, ‘‘গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে রে!’’
চারপাশে গাছ-গাছালির মাঝখানে দ্বীপের মতো রামপদ মাইতির ধ্বস্ত বাড়িটার পিছন দিকে পানাপুকুরের সবুজ জলও পোড়া বাঁশ, কাঠের টুকরো আর খানকতক ছেঁড়া ত্রিপলে কালচে মেরে এসেছে।
ভিড়টা জমাট বেঁধে রয়েছে সেই পুকুরের পাড়ে। পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া বাড়ি থেকে এক-একটা করে লাশ বের করা মাত্র শাড়ির আঁচল কিংবা দু-হাতে মুখ ঢাকা গ্রামীণ জনতা হইহই করে উঠছে, ‘‘ওই একটা...ওই যে পা-টা দেখা যাচ্ছে।’’
আস্ত ব্রাহ্মণবাড় অবাক চোখে দেখছে সেই উদ্ধারকাজ। উড়ে আসছে অস্ফূট উক্তি— ‘‘এক রাতে শেষ হয়ে গেল রে বাড়িটা!’’
স্থানীয় মহিলা জানালেন, বুধবার রাত ১০টা নাগাদ যখন কেঁপে উঠল গ্রামটা, তখন ফের ভূমিকম্পের কথাই ভেবেছিলেন। ‘‘গ্রাম জুড়ে সবাই তখন শাঁখ বাজাচ্ছে। বুঝতেই পারিনি আসলে বাজি কারখানাটা পুড়ছে।’’ কারখানার পাশেই বাড়ি প্রণতি টুডুর। তিনি বলছেন, ‘‘রাতে হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ। বেরিয়ে দেখি, কোথায় ভূমিকম্প? ও তো আমাদের গ্রামের বাজির কারখানা জ্বলছে।’’
ভিড় থেকে একটু তফাতে এক প্রবীণ বলছেন, ‘‘ও তো হওয়ারই ছিল। পুলিশ ব্যবস্থা না নিলে যা হয় তা-ই হয়েছে!’’ পাশ থেকে এক জন যোগ করলেন, ‘‘কত বার পুলিশকে বলেছি, গ্রামে বাজি কারখানা চলা ঠিক নয়, পুলিশ শুনলে তো!’’
মানে???
ভিড় থেকেই সমস্বরে ব্যাখ্যা এল— ‘‘থানায় গিয়ে কত বার বলেছি। বাচ্চা ছেলেগুলো কাজ করে ওখানে। একটা বড় অঘটন না হয়ে যায়। তা পুলিশ আমাদের ধমকে তাড়িয়েই দিল।’’ রাস্তার পাশেই চেয়ার টেনে বসে ছিলেন জেলা পুলিশের কর্তারা। তাঁদের কানে এ সব কথা পৌঁছচ্ছিল কি না, তাঁরাই জানেন।
দমকলের ইঞ্জিন রাতেই রওনা হয়েছিল। খড়্গপুর থেকে দু’টি ও মেদিনীপুর থেকে দমকলের একটি ইঞ্জিন পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। সঙ্কীর্ণ মোরাম রাস্তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি ইঞ্জিনই ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে। দমকলের এক কর্মী বলছেন, ‘‘ওই একফালি রাস্তায় কি গাড়ি নামে? এমন জনবহুল গ্রামে বাজি কারখানা চলছিল কী করে সেটাই তো মাথায় ঢুকছে না।’’
জবাব খুঁজছে দমকল। জবাব চাইছে ব্রাহ্মণবাড়ও। ঘুরেফিরে ক্ষোভটা তাই গিয়ে পড়ছে পুলিশের ওপরেই। বিক্ষোভ সামলাতে একটা সময়ে লাঠিও চালাল পুলিশ। ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশ রাতের অন্ধকারে দেহ সরিয়ে ফেলার তাল করেছিল। এলাকার মানুষের বাধায় সেটা আর সম্ভব হয়নি।
জেলা পুলিশের এক কর্তা কিন্তু সেই অভিযোগ কবুল করে নিলেন! বললেন, ক্ষোভ যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে, সেটা তাঁরা আগেই আঁচ করেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের লক্ষ্য ছিল, যে করেই হোক দেহগুলো দ্রুত তুলে সরিয়ে ফেলা।’’ বুধবার রাতেই কিছু দেহাংশ উদ্ধার করে তাড়াতাড়ি বস্তাবন্দি করে ফেলেছিল পুলিশ। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের মর্গে তা চালান করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অন্ধকারে, বাঁশঝাড় থেকে আসশ্যাওড়ার ঝোপ— ছিটকে পড়া হাত-পা কুড়িয়ে জড়ো করা যে সহজ নয়, মেনে নিচ্ছেন পুলিশকর্তারা। তাই সকালেও ইতস্তত দেহাংশ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। সেগুলো আর কুড়িয়ে উঠতে পারেনি পুলিশ।
পোড়া কারখানার পাশে দাঁড়িয়ে একটা পিক-আপ ভ্যান। বিস্ফোরণ চিহ্ন রেখে গিয়েছে তার গায়েও। ‘বাজি’র মশলা আনা ও তৈরি ‘বাজি’ বাজারে পাঠানোর জন্য এই গাড়িই নাকি কাজে লাগানো হত।
‘বাজি’, না ‘বোমা’?
পোড়া বাড়িটার আশপাশে এ দিন সকালেও ছড়িয়ে তুবড়ির খোল, প্লাস্টিকের বল, স্টোনচিপ্স। সে দিকে আঙুল তুলে রাগত স্বরে এক জন বললেন, ‘‘বাজির আড়ালে এখানে বোমা বাঁধার কাজ চলত। ওই যে স্টোনচিপ্সগুলোই তো বোমার স্প্লিন্টার।’’ এমনকী পুলিশের একাংশও বলছে, এই ব্রাহ্মণবাড় থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে মুণ্ডমারি। মুণ্ডমারি থেকে তিনটি আলাদা সড়কপথে বালিচক হয়ে বম্বে রোড, পটাশপুরে ওড়িশাগামী রাস্তা এবং সবংয়ে গিয়ে ওঠা যায়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই তিনটি পথ দিয়েই বোমার মশলা আনা-নেওয়ার কাজ সহজে সারা হতো।
কে করত এই সব?
সকাল থেকেই মুখে মুখে নামটা উঠে আসছিল— রঞ্জন মাইতি!
অনেকেরই অভিযোগ, সামনে রামপদ মাইতি থাকলেও বকলমে বেআইনি বাজি কারখানাটা চালাত এলাকায় তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত রঞ্জনই। তার বাড়ি সংলগ্ন জমিতেই অ্যাসবেস্টসের ছাদ ও জালের ঘেরাটোপের নিভৃতে চলত কারখানা। ঘটনার পরেই রঞ্জন পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল। পরে পিংলার জলচক থেকে রঞ্জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
স্থানীয় বাসিন্দা গীতা প্রধান বলছিলেন, ‘‘রঞ্জন তৃণমূল কর্মী। ও আসলে একটা গুন্ডা। ওর জন্যই আমাদের গ্রামটা জ্বলে গেল।’’ ক্ষিপ্ত বাসিন্দারা সকালে রঞ্জনের বাড়িতেও চড়াও হয়েছিলেন।
বাড়ির দেওয়ালে তখনও জ্বলজ্বল করছে তৃণমূলের ঢাউস পোস্টার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy