Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
ক্ষোভ এত্তা জঞ্জালে

ছ’বিভাগেই ডাহা ফেল আসানসোল

স্বচ্ছতার তালিকায় শেষ দিক থেকে দু’নম্বরে ঠাঁই পেয়েছে আসানসোল শহর। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের সমীক্ষায় দেশের ৭৩টি শহরের মধ্যে সাফসাফাইয়ের প্রশ্নে আসানসোলের নীচে রয়েছে একমাত্র ধানবাদ।

কালিপাহাড়ির কাছে জাতীয় সড়কের পাশে জমেছে আবর্জনার স্তূপ। মঙ্গলবার ছবিটি তুলেছেন শৈলেন সরকার।

কালিপাহাড়ির কাছে জাতীয় সড়কের পাশে জমেছে আবর্জনার স্তূপ। মঙ্গলবার ছবিটি তুলেছেন শৈলেন সরকার।

সুশান্ত বণিক
আসানসোল শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:২৩
Share: Save:

স্বচ্ছতার তালিকায় শেষ দিক থেকে দু’নম্বরে ঠাঁই পেয়েছে আসানসোল শহর। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের সমীক্ষায় দেশের ৭৩টি শহরের মধ্যে সাফসাফাইয়ের প্রশ্নে আসানসোলের নীচে রয়েছে একমাত্র ধানবাদ। প্রতিযোগিতায় মাপদণ্ড ছিল মূলত ছ’টি— মাঠেঘাটে মলমূত্র ত্যাগ বন্ধে কী ব্যবস্থা, স্বচ্ছতার জন্য সচেতনতার প্রসার, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ, বর্জ্য পদার্থের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা, সবর্জনীন শৌচাগার নির্মাণ ও প্রতিটি বাড়িতে শৌচাগারের ব্যবস্থা করা। সচেতনতার প্রচার ও সর্বজনীন শৌচাগার তৈরিতে টেনেটুনে কিছু নম্বর পেলেও বাকি সব ক্ষেত্রে যে আসানসোলের রীতিমতো করুণ দশা, শহর ঘুরলেই তা মালুম হয়।

জমে থাকে জঞ্জাল

আসানসোল শহরে ঢোকার মুখে কালিপাহাড়ি রেল সেতুর ডান দিকে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে প্রায় একশো মিটার এগোলেই চোখে পড়ে দু’পাশে আবর্জনার স্তূপ। দুর্গন্ধে নাকে কাপড় চাপা দিতে হয়। শহরের যাবতীয় আবর্জনা গত কয়েক দশক ধরে এখানেই ফেলা হয়। জোরে বাতাস বইলে সেখান থেকে রাশি-রাশি প্লাস্টিক উড়ে আসে পাশের বসতি অঞ্চলে। শহরে সবুজায়নের জন্য জাতীয় সড়কের দু’পাশে বনসৃজনের ব্যবস্থা করেছিল বন দফতর। কিন্তু আবর্জনার পাহাড় সেই জায়গাও দখল করেছে। পুরসভা এই এলাকা পাহাড়া দেওয়ার জন্য চার জন নিরাপত্তা কর্মী ও দু’জন মুন্সি নিয়োগ করেছে। রাজীব ঘোষাল নামে এক মুন্সি জানান, দৈনিক প্রায় একশো ট্রাক আবর্জনা ফেলা হয় এখানে। মঙ্গলবার দুপুরে দেখা দেল, জঞ্জালের স্তূপের একটি অংশ দাউদাউ করে জ্বলছে। কটূ গন্ধের কালো ধোঁয়ায় ভরেছে আশপাশ। দুই নিরাপত্তা কর্মী দাবি করেন, ময়লার স্তূপে জমা গ্যাস থেকে আগুন লেগেছে। তাঁরা জানান, প্রতিদিনই এমন আগুন লাগে। গরমে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়। মাঝে-মধ্যে জল ছিটিয়ে নেভানো হয়। বাসিন্দারা জানান, জঞ্জালের দুর্গন্ধ, গ্যাস, ধোঁয়ায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। পুরসভাকে বলেও ফল হয়নি।

রাস্তায় ডাঁই

শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরলেই চোখে পড়ে ইচ্ছে মতো ডাঁই করা আবর্জনার স্তূপ। শহরবাসীর অভিযোগ, তা নিয়মিত সাফ করা হয় না। সপ্তাহে দিন দুয়েক দেখা মেলে সাফাইকর্মীদের। মঙ্গলবার সকালে দেখা যায়, আসানসোল হাসপাতাল চত্বরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে রক্তমাখা তুলো, গজ, ব্যান্ডেজ। অন্তত পাঁচ জায়গায় ডাঁই করে রাখা আছে বর্জ্য। দেখে বোঝা যায়, সাফাই হয়নি বেশ কয়েক দিন। এসবি গড়াই রোড ধরে যাওয়ার সময়ে একাধিক জায়গায় দেখা গিয়েছে আবর্জনার স্তূপ। একই অবস্থা জিটি রোড লাগোয়া মূল বাজার এলাকায়। সেখানে হাঁটাচলাই দায়। ভ্যাট উপচে পড়ছে বর্জ্য। নাকে কাপড় চাপা দিচ্ছেন ব্যবসায়ী থেকে পথচারীরা। শহরের অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত উষাগ্রাম অঞ্চলেও রাস্তার পাশে জমে রয়েছে নোংরা। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহের পরিকল্পনা এই শহরে এখনও বাস্তবায়িত হয়নি বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা। রাস্তার উপরেই তাই বর্জ্য ঢেলে দিয়ে যাচ্ছেন অনেকে।

নেই প্রক্রিয়াকরণ

কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের মতে, একটি বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র তৈরি হলে এই জমা জঞ্জালের সমস্যা থেকে রেহাই পেত শহর। কিন্তু আসানসোলে তেমন কোনও প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, বছর কয়েক আগে রানিগঞ্জের মঙ্গলপুরে তৎকালীন রানিগঞ্জ পুরসভার তরফে একটি প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছিল। আসানসোলের বর্জ্যও সেখানে নিয়ে গিয়ে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু সেটি দীর্ঘ দিন বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। কেন বন্ধ, সে ব্যাপারে কোনও তরফেই কোনও জবাব মেলেনি। আসানসোল পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, এক সময়ে ৩৫ ট্রাক বর্জ্য ওই কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তা খরচে পোষায়নি। বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র তৈরির জন্য আসানসোলে একটি জায়গা দেখা হয়েছিল। কিন্তু জায়গা চিহ্নিত হওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ এখনও এগোয়নি।

মলমূত্র যত্রতত্র

রবীন্দ্রভবন অঞ্চলে গেলে দেখা যায়, রেললাইনের ধার ঘেঁষে সার বেঁধে রয়েছে কাঁচা ও অবৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরি শৌচাগার। সেখানকার বর্জ্য জমা হচ্ছে খোলা জায়গায়। বার্নপুরের শান্তিনগর ও সুভাষপল্লির শেষ প্রান্তেও একই চিত্র। বর্জ্য গিয়ে পড়ছে পাশের নর্দমায়। বাসিন্দারা জানান, নর্দমা নিয়মিত সাফাই হয় না। ফলে, এলাকায় দূষণ ছড়ায়। রহমতনগরের বেশির ভাগ অঞ্চলে অবস্থা আরও করুণ। আসানসোল রেলপাড়ের খাটা শৌচাগারের বর্জ্য গিয়ে পড়ে গাড়ুই নদীতে। কালিপাহাড়ির কাছে রেললাইনের ধারে বসতি অঞ্চলেও এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক শৌচাগার দেখা গিয়েছে। সব বাড়িতে উপযুক্ত শৌচাগার তৈরির ডাক দেওয়া হলেও আসানসোল পুরসভা এলাকায় এখনও কয়েক হাজার খাটা শৌচাগার রয়ে গিয়েছে বলে পুরসভা সূত্রে খবর।


শহরের মধ্যেই দেখা যায় এই দৃশ্য। নিজস্ব চিত্র।

ঢোকা দায়

শহরে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু সর্বজনীন শৌচাগার। কিন্তু তার অনেকগুলির দরজা এখনও খোলা হয়নি। বার্নপুর রোডে এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের উল্টো দিকে, রবীন্দ্র ভবন চত্বর-সহ নানা জায়গায় তালাবন্ধ পড়ে রয়েছে এমন শৌচাগার। বেশ কয়েকটির অবস্থা এত খারাপ যে মানুষজন সেগুলি ব্যবহারই করতে পারেন না। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ হয় না বলে বাইরে যেখানে-সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করতে দেখা যায় লোকজনকে। আসানসোল সিটি বাসস্ট্যান্ড, বাজার অঞ্চল, আদালত চত্বর, পুরসভা-সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় সাধারণ শৌচাগারের এমন হাল।

শেষমেশ প্রচারে

স্বচ্ছতার তালিকা প্রকাশের পরে মুখ পুড়েছে শহরের। তার পরে কোমর বেঁধে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন পুর কর্তৃপক্ষ। কী ভাবে হাল ফেরানো যাবে? মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারি দাবি করেন, প্রচার চলছে জোরকদমে। লিফলেট বিলি। পোস্টার, হোর্ডিং, এমনকী বাড়ি-বাড়ি গিয়ে পুরসভার কর্মীরা শহর সাফ রাখার আর্জি জানাচ্ছেন। তিনি নিজেও নানা অঞ্চলে সাফাইকাজে যোগ দিয়েছেন। শহরে আলোচনাসভা, কর্মশালার আয়োজনও হচ্ছে। মেয়র বলেন, ‘‘তিন মাস আগে দায়িত্ব নিয়েছি। ‘ক্লিন আসানসোল গ্রিন আসানসোল’ স্লোগানে জোরকদমে কাজ শুরু করেছি। কিছু সময় লাগবে। আমরাও প্রথম দশে উঠে আসব।’’ সাফাই দফতরের মেয়র পারিষদ লক্ষ্মণ ঠাকুর বলেন, ‘‘এখন আমাদের স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় বাইশশো সাফাইকর্মী রয়েছে। তা পর্যাপ্ত নয়। আরও কর্মী দরকার।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Burdwan UrbanDevelopment Cleanliness
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE