Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪

নাম বদলের গুঁতোয় ‘কলকাতা’ হচ্ছে হাইকোর্টও

নামে কী বা আসে যায়! কথাটা কবেই বলেছিল শেক্সপিয়রের জুলিয়েট। গোলাপকে যে নামেই ডাকো, তার খুশবুতে ফাঁকি থাকে না।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৬ ০৩:১৮
Share: Save:

নামে কী বা আসে যায়! কথাটা কবেই বলেছিল শেক্সপিয়রের জুলিয়েট। গোলাপকে যে নামেই ডাকো, তার খুশবুতে ফাঁকি থাকে না।

সে না থাক, দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের যায়-আসে না। সে এখন নাম পাল্টানোর নেশায় মেতেছে। মাস তিনেক আগে গুড়গাঁওয়ের নাম বদলে করা হয়েছে গুরুগ্রাম। এ বার নাম বদলের ধাক্কা দেশের প্রাচীনতম হাইকোর্টে। ‘ক্যালকাটা হাইকোর্ট’ খাতায়-কলমে ‘কলকাতা হাইকোর্ট’ হওয়ার পথে এগোচ্ছে। বম্বে ও মাদ্রাজ হাইকোর্টও রেহাই পাচ্ছে না। তাদের নতুন নাম হবে যথাক্রমে ‘মুম্বই হাইকোর্ট’ ও ‘চেন্নাই হাইকোর্ট।’

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই টেলিকমমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বিষয়টি ঘোষণা করেন। জানান,
তিন শহরের নাম পাল্টে আগেই কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাই হয়েছিল। সেই মতো তিন শহরের তিন হাইকোর্টেরও নাম বদলাচ্ছে। প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সারতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এ দিনই ‘দ্য হাইকোর্টস বিল (অলটারেশন অব নেমস), ২০১৬’ সংসদে পাশ করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জায়গা বা প্রতিষ্ঠানের নাম ঘিরে ভাবাবেগ বা স্পর্শকাতরতা ভারতে নতুন কিছু নয়। ঔপনিবেশিক অতীত মুছে ফেলতে কিংবা ‘মরাঠি অস্মিতা’ জাগিয়ে ‘বম্বে’ সরিয়ে ‘মুম্বই’ প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক শক্তির তৎপরতা কম দেখা যায়নি। তেমনই ‘ক্যালকাটা’ ছেঁটে ফেলে কলকাতাকরণে বাঙালির একাংশের উৎসাহও কম ছিল না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায়, ২০০১-এ ‘কলকাতা’য় সরকারি সিলমোহর পড়ে। ক্রমশ কলকাতা পুলিশ, পুরসভার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নাম থেকেও ‘ক্যালকাটা’
বিদায় নিয়েছে।

এ বার হাইকোর্টের আঙিনাতেও সেই ধারার প্রতিফলন। যদিও এই বদল সমাজবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ বা সাবেক কলকাতাপ্রেমীদের অনেককে খুশি করতে পারছে না। তাঁদের মতে, বাঙালির মুখের বুলিতে কলকাতা নামটির অস্তিত্ব ঢের পুরনো হলেও তা কখনও সর্বজনীন ছিল না। কলকাতা হাইকোর্টের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। সমাজবিজ্ঞানী আন্দ্রে বেতেই তাই সহাস্যে বলছেন, ‘‘এ এক ধরনের জনমোহিনী পদক্ষেপ (পপুলিস্ট মেজার)। তবে সবই সয়ে যাবে...!’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এ ভাবে উপনিবেশের ছাপ মোছা যায় না। আমাদের আঁতে ঘা লাগলেও হাইকোর্ট বা গোটা আইনি ব্যবস্থাটাই তো উপনিবেশের ধাঁচে গড়া! এ দেশের সাবেক আইনি ব্যবস্থা অনেক অন্য রকম ছিল।’’

তা হলে শুধু নাম বদলানোর কী মানে?

‘‘কোনও মানে হয় না! আমার নাম তরুণকুমার হলে কি আশি বছর বয়সে আমায় প্রবীণকুমার বলে ডাকতে হবে?’’— পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ছেন লেখক শঙ্কর। যাঁর লেখার পরতে পরতে কলকাতা হাইকোর্ট চত্বরের নানা গন্ধ মিশে আছে। অনেকেরই অভিমত, সাবেক নামের সঙ্গে ইতিহাসের এই গন্ধটাই মিশে থাকে। ইতিহাসবিদ সুরঞ্জন দাস অবশ্য হাইকোর্টের নামবদলের প্রসঙ্গে ঢুকতে চাননি। শুধু বলেছেন, ‘‘একটা শহরের নাম পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে তার বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানগুলির নামও পাল্টে ফেলাটা কখনওই জরুরি নয়।’’

ঘটনা হল, কাগজে-কলমে ‘কলকাতা হাইকোর্ট’ নাম প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের প্রেক্ষিতে এ শহরের আরও একটি ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ ঘিরে প্রশ্ন উঠছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এখনও খাতায়-কলমে ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্যালকাটা।’ সে নামও যদি পাল্টে ফেলা হয়?

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য (বর্তমানে যাদবপুরের উপাচার্য) সুরঞ্জনবাবুর তাতে ঘোর আপত্তি। ‘‘ইউনিভার্সিটি অব ক্যালকাটা নামেই প্রতিষ্ঠানটি গোটা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়স্তরের শিক্ষার পথিকৃৎ ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার অনেকটাই ছিল তার ছত্রচ্ছায়ায়। হঠাৎ নাম বদলালে সেই ইতিহাসের উত্তরাধিকার থেকেও যেন সরে আসা হবে।’’— পর্যবেক্ষণ সুরঞ্জনবাবুর। আর এক ইতিহাসবিদ সুগত বসু অবশ্য নামের সঙ্গে ইতিহাসের মাত্রা মিশিয়ে ফেলতে চাইছেন না। তবে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টর গ্রুপের চেয়ারম্যান সুগতবাবুও ‘ক্যালকাটা হাইকোর্ট’ বা ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্যালকাটা’র মতো নামগুলো বাদ দেওয়ার পক্ষপাতী নন।

অন্য মতও আছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবগঠিত সিন্ডিকেটের সদস্য তথা কবি সুবোধ সরকার যেমন বলেছেন, ‘‘সরকার নাম পাল্টাতে চাইলে আমার আপত্তি নেই। শহরের নাম যখন পাল্টেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পাল্টানোই তো স্বাভাবিক।’’

নাম নিয়ে টানাটানি অন্তহীন।

অন্য বিষয়গুলি:

calcutta kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE