Advertisement
১৯ মে ২০২৪
প্রেসিডেন্সিতে তিরোল

ক্যাশলেস ভাল, তবে গরিবকে কষ্ট দিয়ে নয়

সকাল এগারোটা। এক মঞ্চে অর্থনীতির দুই নোবেলজয়ী। তাঁদের মধ্যে এক জন কল‌েজেরই প্রাক্তনী। দ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানের সূচনায় এর চেয়ে ভাল ছবি আর কী-ই বা পেতে পারত প্রেসিডেন্সি?

দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতার অতিথি বক্তা জঁ তিরোল ও অমর্ত্য সেন। বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতার অতিথি বক্তা জঁ তিরোল ও অমর্ত্য সেন। বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

অমিতাভ গুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:১২
Share: Save:

সকাল এগারোটা। এক মঞ্চে অর্থনীতির দুই নোবেলজয়ী। তাঁদের মধ্যে এক জন কল‌েজেরই প্রাক্তনী। দ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানের সূচনায় এর চেয়ে ভাল ছবি আর কী-ই বা পেতে পারত প্রেসিডেন্সি?

দুপুর একটা দশ। বক্তৃতা শেষ। ডিরোজিও হলের সামনে কার্যত একা দাঁড়িয়ে টুলুস স্কুল অব ইকনমিক্স-এর তারকা অধ্যাপক, প্রেসিডেন্সির দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতার অতিথি-বক্তা জঁ তিরোল। আয়োজকদের কেউ ধারেকাছে নেই। ভিড় ঠেলে কোনও মতে একটা গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অমর্ত্য সেনকে। মিনিট কয়েক দাঁড় করিয়ে রাখার পর আয়োজকদের এক জন এসে তিরোলকে হাঁটিয়েই নিয়ে গেলেন মূল ভবনের দিকে।

বঙ্গসমাজের মানানসই ছবি, তবে ‘আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’-এর পক্ষে গৌরবের নয়।

মাঝের দু’ঘণ্টা সাক্ষী থাকল এক বিরল বৌদ্ধিক চর্চার। তিরোল ব্যাখ্যা করলেন, অর্থনীতির দুনিয়ায় ‘মূল্যবোধ’ শব্দটির অর্থ কী। বাজার অর্থনীতিতে কোথায়, কেন ধাক্কা খেতে পারে সেই মূল্যবোধ। বললেন, কর্পোরেট সংস্থা যেমন মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হতে পারে, সরকারও পারে। এক জন প্রশ্ন করলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটকে কি ‘কর্পোরেট গভর্ন্যান্স ফেলিওর’ হিসেবে দেখা উচিত নয়? প্রশ্নটি যাঁর, বহু আলোচনাসভায় তিনিই উত্তরদাতার ভূমিকায় থাকেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ, সাংসদ সুগত বসু। তিরোল বললেন, ‘‘তার চেয়েও বেশি, শুধু সরকারের ব্যর্থতা। সরকার ব্যাঙ্কগুলোকে যথেচ্ছাচার করে যেতে দিয়েছিল। ব্যাঙ্কগুলো জানত, বিপদে পড়লে সরকারই উদ্ধার করবে।’’

ভারতে যে ভঙ্গিতে ডিমনিটাইজেশন হল, তার মধ্যেও কি মূল্যবোধের অভাব প্রকট নয়? দর্শকাসন থেকে প্রশ্ন এল। উত্তরে নির্দ্বিধ তিরোল। বললেন, ‘‘নগদহীন অর্থনীতি ব্যাপারটা খারাপ নয়। সে দিকেই যেতে হবে। কিন্তু ভারতে যে কালো টাকা ছিল, ডিমনিটাইজেশনে তা তো ধরা পড়েনি।...তবে দেশকে ক্যাশলেস করে তোলার জন্য তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। এমন ভাবে, ধাপে ধাপে করতে হবে যাতে গরিব মানুষের গায়ে আঁচ না লাগে।’’

নিজেই ডেনমার্কের প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। বললেন, ‘‘সেখানকার গরিব আর ভারতের গরিব এক নয়। সেখানে সরকার গরিব মানুষের হাতে প্রি-পেড ডেবিট কার্ড তুলে দিয়েছে, যাতে নগদের অভাবে তাঁদের সমস্যায় না পড়তে হয়।’’

এমআইটি-র অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও একমত। তিনি বললেন, ‘‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সঙ্গে ভারতের তুলনা করার অর্থ হয় না। ওখানে যারা একেবারে গরিব, তারাও ভারতের মধ্যবিত্তদের সমান। এ দেশেও মধ্যবিত্তরা দ্রুত ক্যাশলেস অর্থনীতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু গরিবদের কী হবে?’’

ক্যাশলেস অর্থনীতির যে নিজস্ব খরচ আছে, অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিলেন তা-ও। বললেন, ‘‘পাঁচ টাকার মুড়ি কিনে যদি আমি ডেবিট কার্ডে সেই দাম মেটাতে চাই, তার জন্য বাড়তি দু’টাকা খরচ হয়। সেটা কে দেবে? ডিমনিটাইজেশন করে কার লাভ হবে, কী লাভ হবে, সেটাই আমার কাছে পরিষ্কার নয়।’’

আগে বলেছেন তাঁর মত। ডিমনিটাইজেশন নিয়ে এ দিন আর কথা বলতে রাজি হলেন না অমর্ত্য সেন। তিরোলকে নিয়ে তিনি ঘুরে দেখলেন প্রেসিডেন্সির পোর্টিকো। দেখলেন ২০০ বছরের কৃতী ছাত্রদের নামের তালিকা দেওয়ালে খোদাই করা হয়েছে। সেখানে তাঁর নাম জ্বলজ্বল করছে। এই কলেজ তাঁর কাছে কেন তাৎপর্যপূর্ণ, সে কথা বলতে গিয়ে আরও এক বার ফিরে গেলেন কলেজের গোড়াপত্তনের দিনগুলোয়। আবারও মনে করালেন, প্রেসিডেন্সিই সম্ভবত বিশ্বের প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যার সঙ্গে কখনও ধর্মের কোনও সম্পর্ক ছিল না, আর যা তৈরি হয়েছিল সম্পূর্ণ নাগরিক সমাজের উদ্যোগে। সরকার উচ্চশিক্ষার টাকা জোগালেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি হস্তক্ষেপ যে সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত, সেটা এই ডিরোজিও হল-এই আগে বলে গিয়েছিলেন তিনি। নাগরিক উদ্যোগের কথা স্মরণ করানোর মধ্যে সেই বার্তাটিও মনে পড়ে গেল অনেকেরই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jean Tirole Amartya Sen Cashless economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE