Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪

এ বার মদনকে জেরা করতে চায় সিবিআই

মন্ত্রীর প্রাক্তন আপ্ত সহায়কের বাড়িতে সিবিআই হানা এবং পরপর দু’দিন তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে জেরার মধ্যেই ইঙ্গিতটা ছিল। শুক্রবার সিবিআই সূত্রে জানিয়ে দেওয়া হল, সারদা কেলেঙ্কারিতে এ বার পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় তারা। সিবিআই অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হা সম্প্রতি বলেছিলেন, সারদা-কাণ্ডে যাঁর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে, তাঁকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৪৪
Share: Save:

মন্ত্রীর প্রাক্তন আপ্ত সহায়কের বাড়িতে সিবিআই হানা এবং পরপর দু’দিন তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে জেরার মধ্যেই ইঙ্গিতটা ছিল। শুক্রবার সিবিআই সূত্রে জানিয়ে দেওয়া হল, সারদা কেলেঙ্কারিতে এ বার পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় তারা।

সিবিআই অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হা সম্প্রতি বলেছিলেন, সারদা-কাণ্ডে যাঁর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে, তাঁকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ দিন তদন্তকারীদের বক্তব্যের সমর্থন মিলেছে তাঁর কথাতেও। অধিকর্তা বলেছেন, “আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মামলা গুটিয়ে আনছি। অফিসারদের পেশাদার মনোভাব নিয়ে তদন্ত করতে বলা হয়েছে।”

পরিবহণমন্ত্রী গত কয়েক দিন ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন। শুক্রবারই ছাড়া পান। বাড়ি ফেরার পথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে মদনবাবু বলেন, “এ নিয়ে আমি কিছু বলব না।” কবে মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, তা এখনও ঠিক করেনি সিবিআই। তদন্তকারীরা জানান, মদনবাবু একটু সুস্থ হলেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

সিবিআই-সূত্রে বলা হচ্ছে, গত দু’দিনে কলকাতার নানা জায়গায় হানা দিয়ে তারা যে তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে, তার ভিত্তিতেই এ বার পরিবহণমন্ত্রীকে জেরা করার সময় এসেছে। মদনবাবুর সঙ্গে যে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট প্রমাণ মিলেছে। এ-ও জানা গিয়েছে, দু’জনের মধ্যে সেতুর কাজ করতেন মদনবাবুর ঘনিষ্ঠ এবং প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক রেজাউল (বাপি) করিম। বৃহস্পতিবার বাপির বাড়িতে হানা দিয়েছিল সিবিআই। ওই দিন দুপুরে সল্টলেকে জেরা করা হয় তাঁকে। শুক্রবার দুপুরে বাপিকে ফের জেরা করে সিবিআই। জেরার পর বাপি দাবি করেন, তাঁর ও মদনবাবুর সঙ্গে সারদা কেলেঙ্কারির কোনও সম্পর্ক নেই। সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগও তোলেন তিনি।

কী করে সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে নাম জড়াল মদনবাবুর?

সুদীপ্ত সেন গা ঢাকা দেওয়ার পরেই জানা যায়, সারদার বেশ কিছু অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন মদনবাবু। অনুষ্ঠানে নিজের বক্তৃতায় তিনি প্রশংসা করেছেন সারদা কর্তার। তার ফুটেজও পেয়েছে সংবাদমাধ্যম। পরে মদনবাবু অবশ্য দাবি করেন যে, সারদার ব্যাপারে বিস্তারিত না জেনেই তাদের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তিনি।

গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, বাপি করিমকে জেরা করে জানা গিয়েছে, কখনও মদনবাবুর সঙ্গে, কখনও একা সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে যেতেন তিনি। বেশির ভাগ সময়েই যেতেন রাতের অন্ধকারে। সারদার অফিসে পৌঁছনোর পরে বাপির সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতেন সুদীপ্ত। সে সময়ে ঘরে অন্য কারও প্রবেশাধিকার থাকত না। সারদার বহু কর্মীও মিডল্যান্ড পার্কে বাপির যাতায়াতের কথা জানিয়েছেন। অভিযোগ, সুদীপ্তর কাছ থেকে মোটা-পাতলা নানা ধরনের খাম আনতেন বাপি। সারদার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কখনও মদনবাবুর সঙ্গে, কখনও তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে থাকতেন বাপি। এ সব তথ্যই সিবিআইয়ের কাছে আছে। বাপি অবশ্য এ দিন দাবি করেন, তাঁর সঙ্গে সুদীপ্তর দেখা হয় মাত্র তিন বার। এক বার মিডল্যান্ড পার্কে, দু’বার নেতাজি ইন্ডোরে।

তদন্তকারীদের কাছে সুদীপ্ত দাবি করেছিলেন, মিডিয়া ব্যবসায় নামতে গিয়েই তাঁর ভরাডুবি হয়েছে। দু’টি বাংলা চ্যানেল কেনার সময়ে তৃণমূলের কেউ তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখছে সিবিআই। সারদা বন্ধ হওয়ার পরে একটি চ্যানেল চালানোর টাকা দিত রাজ্য। ঘটনাচক্রে, শুক্রবারই একটি টিভি সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সুদীপ্তর মিডিয়া ব্যবসা থেকে দল ও সরকারের দূরত্ব স্পষ্ট করে দেন। তিনি জানান, কোনও সাংবাদিক তাঁর সঙ্গে কথা বলতেই পারেন। তাঁর কাছে আসতেই পারেন। তাঁর অর্থ এই নয় যে, সেই সংবাদমাধ্যমের মালিক সম্পর্কে তাঁকে সব জেনে রাখতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, চ্যানেলের ছাড়পত্র দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাই চ্যানেলের মালিক সম্পর্কে তথ্য কেন্দ্রেরই রাখার কথা।

বৃহস্পতিবার তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসে সারদা তদন্ত প্রসঙ্গ টেনে এনে মুখ্যমন্ত্রী ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’র অভিযোগ তোলেন। অনেকেই বলেছিলেন, সিবিআই তদন্তে যে ভাবে তৃণমূলের একাধিক নেতা-মন্ত্রীর নাম উঠে আসছে, তার উদ্বেগই ধরা পড়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যে। একই সুরে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বসিরহাটে বলেন, “অমিত শাহকে সিবিআই চার্জশিট দিয়েছিল। কংগ্রেস আমলে নরেন্দ্র মোদীকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ১৯ ঘণ্টা জেরা করেছিল সিবিআই। ফলে সিবিআই যে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, তা সকলের জানা।”

সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার তুলে দেওয়ার সময়ে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল যে, এই কেলেঙ্কারিতে বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। যে সব নেতার নামে অভিযোগ উঠেছে, তদন্তে নেমে সিবিআই তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কি না, এত দিন সে দিকেই চোখ ছিল বিভিন্ন মহলের। সেই সূত্রেই পরিবহণমন্ত্রীকে সিবিআই ডাকতে চলেছে বলে ইঙ্গিত।

রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি সিবিআইয়ের নজরে রয়েছেন রাজ্য পুলিশের একাধিক কর্তাও। তদন্তে নামা ইস্তক রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে আসছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। গত এক বছর ধরে তদন্তের নাম করে রাজ্য পুলিশের কয়েক জন অফিসার বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করে ফেলেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

বস্তুত, সেই চেষ্টা এখনও চলছে বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ। বৃহস্পতিবার তৃণমূলের এক নেতার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী আসিফ খানের বাড়িতে হানা দেয় সিবিআই। এর দিন কয়েক আগে রাজ্য পুলিশের একটি দলও হানা দিয়েছিল আসিফের বাড়িতে। সিবিআইয়ের প্রশ্ন, রাজ্য পুলিশ হঠাৎ আসিফের বিরুদ্ধে কী এমন অভিযোগ পেল যে, তাঁর বাড়িতে হানা দিতে হল? এই হানার আসল উদ্দেশ্য প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা কি না, সেটাই ভাবছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। রাজ্য পুলিশের দু’একজন উচ্চপদস্থ অফিসারকে কয়েক দিনের মধ্যে ডেকে জেরা করা হবে বলে সিবিআইয়ের তরফে ইঙ্গিত মিলেছে। এবং তদন্তকারীদের একাংশ বলছেন, রাজ্য পুলিশের কর্তাদের একাংশের এই তথ্য-নথি নষ্টের চেষ্টা সত্ত্বেও প্রমাণ তাঁদের হাতে আসছে। এই কর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে সিবিআই সূত্রে ইঙ্গিত।

এ দিন ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতুকে আদালতে পেশ করা হয়। সিবিআই তাঁকে আর হেফাজতে চায়নি। বিচারক তাঁর ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন। সিবিআইয়ের বক্তব্য, সেবি ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অফিসারদের সঙ্গে সুদীপ্তর তরফে মধ্যস্থতা করতেন নিতু। তাঁর কাছ থেকে আরবিআইয়ের একাধিক কর্তার নাম জানা গিয়েছে। সিবিআইয়ের হাতে ধৃত ব্যবসায়ী সন্ধির অগ্রবালের অফিস থেকে একটি ল্যাপটপ উদ্ধার হয়েছে। সেখান থেকেও বহু তথ্যপ্রমাণ মিলেছে।

শুক্রবার তল্লাশি চলে অসমেও। মনোরঞ্জনা সিংহকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর খারগুলি ও রুক্মিণীগাঁওয়ের বাড়িতে তল্লাশি চালায় সিবিআই। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহের প্রাক্তন স্ত্রী মনোরঞ্জনাকে জেরাও করা হয়। মনোরঞ্জনা বলেন, “আমার অনুরোধেই কলকাতায় সিবিআই আমায় ও সুদীপ্ত সেনকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করে। তাঁর সামনেই সব মেল, এসএমএস সিবিআইকে দেখাই। যেখানে স্পষ্ট যে, সুদীপ্তকে আমি ঠকাইনি। বরং তিনিই আমাদের সাহায্য করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।” সিবিআই সূত্রের খবর, অসমের কয়েকটি কাগজে লগ্নি করেছিলেন সুদীপ্ত। সেগুলির মালিক-সম্পাদকদেরও ডাকা হতে পারে।

তল্লাশি চলে অসমের প্রাক্তন ডিজি জি এম শ্রীবাস্তবের বাড়িতেও। অসমের গায়ক ও চিত্র পরিচালক সদানন্দ গগৈ-কে শুক্রবার কলকাতায় এনে জেরা করা হয়। সিবিআই সূত্রের খবর, হিমন্ত বিশ্বশর্মা অসমের শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন সদানন্দকে অসম প্রকাশন পরিষদের সচিব পদে বসান। সিবিআইকে লেখা সুদীপ্তর চিঠি প্রকাশিত হওয়ার পরেই পদত্যাগ করেন সদানন্দ। গোয়েন্দাদের দাবি, সুদীপ্তর সঙ্গে হিমন্তর যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিলেন এই সদানন্দ।

অসমের ছাত্র সংগঠন আসু-র সভাপতি শঙ্করপ্রদাস রায় ও হিমন্তর স্ত্রীর মালিকানাধীন চ্যানেলের অন্যতম কর্তা রাজীব বরার বাড়িতেও তল্লাশি চালায় সিবিআই। শঙ্করপ্রসাদ ও আসুর উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য দাবি করেন, যে কোনও ব্যবসায়ী সংগঠনের কাছ থেকে যেমন তাঁরা চাঁদা নেন, তেমনই সারদার থেকেও তারা সাড়ে সাত লক্ষ টাকা চাঁদা নিয়েছিলেন। তদন্তে উঠে এসেছে তেজপুরের বর্তমান বিজেপি সাংসদ আর পি শর্মার নামও। এ দিন গুয়াহাটিতে রোজ ভ্যালির সদর দফতর সিল করে দেয় পুলিশ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE