Advertisement
১৪ জুন ২০২৪

কংগ্রেসের মালা খসে ফের সেই তৃণমূলে

অসম্মানিত হচ্ছেন— এই অভিযোগে দশ বছর আগে তৃণমূল ছেড়েছিলেন। তার পর থেকে বরাবরই তাঁকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে দেখেছে বাংলার মানুষ। এমনকী, গত লোকসভা ভোটে মমতার খাসতালুক দক্ষিণ কলকাতায় তাঁরই ঘনিষ্ঠ সুব্রত বক্সীর বিরুদ্ধে প্রার্থীও হয়েছিলেন তিনি।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে নবান্নে মালা রায়। রয়েছেন শোভন চট্টোপাধ্যায়ও। শনিবার। ছবি: প্রদীপ আদক।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে নবান্নে মালা রায়। রয়েছেন শোভন চট্টোপাধ্যায়ও। শনিবার। ছবি: প্রদীপ আদক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৫ ০৩:০১
Share: Save:

অসম্মানিত হচ্ছেন— এই অভিযোগে দশ বছর আগে তৃণমূল ছেড়েছিলেন। তার পর থেকে বরাবরই তাঁকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে দেখেছে বাংলার মানুষ। এমনকী, গত লোকসভা ভোটে মমতার খাসতালুক দক্ষিণ কলকাতায় তাঁরই ঘনিষ্ঠ সুব্রত বক্সীর বিরুদ্ধে প্রার্থীও হয়েছিলেন তিনি। সেই মালা রায় যখন এ দিন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে নবান্নে ঢোকেন, তত ক্ষণে চাউর হয়ে গিয়েছে দশ বছর পরে পুরনো দলে ফিরছেন পুরসভার কংগ্রেস দলনেত্রী! কংগ্রেস ছেড়ে আসার কারণ হিসেবে এ দিনও মালার মুখে ছিল একই অভিযোগ: কংগ্রেসে তাঁকে অসম্মান করা হচ্ছে!

মুকুল রায়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার আবহে এবং রাজ্যে বিজেপির উত্থানে চাপে থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সাদরে টেনে নিয়েছেন তাঁর পুরনো সহকর্মী মালাদেবীকে।

কংগ্রেসের আর এক কাউন্সিলর অরুণ দাসও শনিবার তৃণমূলে যোগ দেন। এই পুরবোর্ডে কংগ্রেসের কাউন্সিলর সংখ্যা ছিল সাকুল্যে পাঁচ। তার মধ্যে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুমন সিংহ কয়েক দিন আগেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।

এ বার মালা-অরুণ যাওয়ার পরে পড়ে রইলেন প্রকাশ উপাধ্যায় এবং সন্তোষ পাঠক। অনেকে এ সব দেখেশুনে বলছেন, পুরভোট আসতে আসতে হারাধনের পাঁচটি সন্তানের আর ক’জন পড়ে থাকবেন, কে জানে! মালা যে তৃণমূলে যাচ্ছেন, সেটা পুরসভায় বসেই বলে ফেলেন মেয়র। এ দিন ছিল পুরসভার অন্তর্বর্তী বাজেট। অন্যান্য দিনের মতোই বেলা ১টায় অধিবেশন শুরুর মুখে বিরোধী বেঞ্চে গিয়ে বসেন মালা। মিনিট দশেকের মধ্যে ‘ভোট অন অ্যাকাউন্ট’ পেশ করে বক্তৃতা শেষ করেন মেয়র। পুরভোটের আগে শেষ অধিবেশন বলে এর পরে প্রথা মেনে সকলকে নিয়ে ছবি তোলেন তিনি। সে সময় তাঁর পাশে গিয়ে বসেন পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী, সিপিএমের রূপা বাগচি। তখন মেয়রকে জনৈক কাউন্সিলর অনুরোধ করেন, আর এক বিরোধী নেত্রী মালাদেবীকেও পাশে নিয়ে ছবি তুলুন। এ বার কিছুটা স্বগতোক্তি করেই মেয়র বলেন, “আর ঘণ্টাখানেক পরে উনি আর বিরোধী থাকছেন না!” মেয়রের এই কথাই দ্রুত চাউর হয়ে যায়।

ছবি-পর্বের পরে দু’টো নাগাদ মালাদেবী রওনা দেন নবান্নের পথে। তাঁকে নিয়ে মেয়র নিজেই সোজা চলে যান মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে। পরে অবশ্য মেয়র বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ওঁর সরাসরি কথা হয়েছে। আমি অনুঘটক মাত্র।” নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কথা হয় মালার। বৈঠকে ছিলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও। নবান্ন থেকে বেরনোর মুখে মালাদেবী বলেন, “আমি কাজের লোক, কাজ করতে চাই। তৃণমূলে কাজ করার সুযোগ অনেক বেশি বলে যোগ দিচ্ছি।” তাঁর স্বামী তথা কংগ্রেস নেতা নির্বেদ রায়ও কি তৃণমূলে যোগ দেবেন? এই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে মালাদেবী বলেন, “আমার আলাদা সত্তা, ওঁর আলাদা সত্তা।”

মালা রায়

এর পরে অরুণবাবুর সঙ্গে তৃণমূল ভবনে যান মালাদেবী। সেখানে গিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “তৃণমূল প্রতিষ্ঠার সময় দলে যে ১৬ জন কাউন্সিলর ছিলেন, আমি তাঁদের মধ্যে এক জন। পুুরনো দলে ফিরতে পেরে ভাল লাগছে।” তিনি পুরভোটে তৃণমূলের টিকিটে লড়বেন কি না জানতে চাইলে মালাদেবীর বক্তব্য, “এ ব্যাপারে যা বলার, দলীয় নেতৃত্বই বলবেন।” যদিও নবান্ন থেকে বেরনোর সময় মেয়রই ঘোষণা করেন, “মালাদি ৮৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকেই তৃণমূল প্রার্থী হবেন।” তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, পুরভোটের আগে কংগ্রেসের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা দলে যোগ দেওয়ায় আমাদের শক্তি বাড়ল।

শুধু মালা-অরুণ নন, কংগ্রেসের মধ্যে বিক্ষোভের ধোঁয়া ক্রমেই বাড়ছে। মালা ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, কংগ্রেসে এখন তাঁদের মতো নেতানেত্রীরা অসম্মানিত হচ্ছেন। একই অভিযোগ তুলেছেন শঙ্কর সিংহ, শিবাজি সিংহরায়ের মতো নেতারাও। তবে এখনই তাঁরা দল ছাড়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। অরুণবাবু দল ছাড়ার কারণ জানাতে গিয়ে বলেন, “মান-সম্মান নিয়ে আর কংগ্রেস থাকা যাচ্ছে না।”

যে মালা গত দশ বছর ধরে বরাবর মমতার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ছিলেন, তিনি আচমকাই তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় কংগ্রেসে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ক্ষোভ উগরে দিয়ে কংগ্রেস কাউন্সিলর প্রকাশ উপাধ্যায় বলেন, “এটা সুবিধাবাদের রাজনীতি!” প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরী অবশ্য মনে করেন, “দেহ থেকে চর্বি খসলে যেমন দেহ ঝরঝরে হয়, কংগ্রেস থেকে তেমনি রাজনৈতিক ফন্দিবাজরা বেরিয়ে যাওয়ায় দল অনেক চাঙ্গা ও তরতাজা হবে।” তাঁর কথায়, “লাভ-ক্ষতির হিসেব কষে যে-ই দেখলেন তৃণমূলে গেলে লাভ, তাই সেখানে চলে গেলেন! মমতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে এক দিন বেরিয়ে এসেছিলেন তৃণমূল থেকে। আজ ফের সেই মমতারই পায়ে গিয়ে পড়লেন!” প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও বলেন, “ক্ষমতায় থাকার জন্য কাজের অজুহাতে যাঁরা দলত্যাগ করছেন, তাঁরা মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছেন।” হতবাক সিপিএম কাউন্সিলর এবং পুরসভার বিরোধী দলের মুখ্য সচেতক অমল মিত্রও। তাঁর কথায়, “পাঁচ বছর ধরে তৃণমূলের সঙ্গে ঝগড়া করে শেষ দিনে দলবদল করবেন, তা ভাবতেই পারিনি।”

কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। মালাদেবীর দলত্যাগকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মানসবাবু প্রশ্ন তোলেন, “দলের প্রবীণ নেতানেত্রী এবং জনপ্রতিনিধিরা কেন এত মানসিক কষ্ট নিয়ে দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছেন? দিল্লির নেতৃত্ব ব্যবস্থা না নিলে বাংলার কংগ্রেস সঙ্কটে পড়বে।” ৯ কংগ্রেস বিধায়কের দলত্যাগের কথাও স্মরণ করিয়ে মানসবাবুর পরামর্শ, “অধীরবাবুকে অনুরোধ করব সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসুন।”

দলবদল করতেই কিন্তু ‘পুরস্কার’ জুটল মালাদেবীর কপালে। পুরসভা সূত্রের খবর, ১০ মার্চ মালা রায়ের ওয়ার্ডে কেওড়াতলা শ্মশানঘাটে একটি কাঠের চুল্লি উদ্বোধন করা হবে। সেই অনুষ্ঠানের জন্য যে আমন্ত্রণপত্র তৈরি হচ্ছিল, তাতে নাম ছিল না মালাদেবীর। এ দিন জরুরি ভিত্তিতে কার্ডের বয়ান বদল করা হয়। লেখা হয় ‘গেস্ট অব অনার’ মালা রায়! মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ বলেন, “উনি আমাদের দলে যোগ দিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর নাম তো থাকবেই।”

যা দেখেশুনে শাসক দলের এক সমর্থকের টিপ্পনি: লকেট খুইয়ে মালা পেল তৃণমূল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

congress tmc mala roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE