শাসক দলের নেতাদের নির্দেশ মেনে হাসপাতাল চালাতে চাননি বলেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল— বুধবার সরাসরি এই অভিযোগ করলেন এসএসকেএম-এর সদ্যপ্রাক্তন অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র।
এ দিন দুপুরে সরকারি গাড়ির বদলে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনের রিসিভিং কাউন্টারে স্বেচ্ছাবসরের চিঠি জমা দিয়ে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একদা ‘অতি আস্থাভাজন’ প্রদীপবাবু। আর তার পরেই তাঁর বিস্ফোরক অভিযোগ, বদলির পিছনে ‘গভীর চক্রান্ত’ রয়েছে। তাঁর অভিযোগের নিশানায় নবান্ন, স্বাস্থ্য ভবন এবং তৃণমূল ভবন। প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘আমাকে এসএসকেএম থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বয়ং। তিনি বিষয়টি পুরো জানতেন।’’
তবে ষড়যন্ত্রীদের তালিকায় জেলে যাওয়া মন্ত্রী মদন মিত্রকে রাখতে চাননি প্রদীপবাবু। মদন দীর্ঘদিন ধরেই
এসএসকেএম-এর একটি কেবিনে আছেন। সেখান থেকে ফোনে তিনি প্রদীপবাবুকে সমবেদনা জানিয়েছেন বলে সদ্যপ্রাক্তন এই অধিকর্তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গিয়েছে। মদন মিত্র জেলে যাওয়ার আগে তাঁর অনুগত হিসেবেই পরচিত ছিলেন প্রদীপবাবু।
মেরুদণ্ড সোজা রেখে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যথা সম্ভব এড়িয়ে তিনি হাসপাতাল চালাচ্ছিলেন বলে দাবি করেছেন প্রদীপবাবু। তাঁর অভিযোগ, শাসক দলের কয়েক জন চিকিৎসক নেতা এবং এসএসকেএম-এর কয়েক জন সহকর্মীর তা পছন্দ হচ্ছিল না। প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘আমি যে পদ্ধতিতে কাজ করছিলাম, তাতে অনেকেরই অস্বস্তি হচ্ছিল। তা-ই হয়তো আমাকে সরানো হল।’’
স্বাস্থ্য ভবন তাঁর বদলিকে রুটিন বললেও তিনি চক্রান্ত বলছেন কেন?
প্রদীপবাবুর ধারণা, তাঁকে সরানোর প্রক্রিয়া বেশ কয়েক মাস আগেই শুরু হয়েছিল। তিনি তা বুঝতে পারছিলেন। এসএসকেএম-এর কোনও যন্ত্র খারাপ হলে, কোনও রোগী পরিষেবা নিয়ে প্রশ্ন করলেই সেই খবর পৌঁছে যাচ্ছিল হরিশ চ্যটার্জি স্ট্রিটে। ভিতরের কারও যোগসাজসের গন্ধও পাচ্ছিলেন তিনি। প্রদীপবাবু ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না— এমন একটা ধারণা তৈরির চেষ্টা চলছিল বলে তাঁর অভিযোগ। এর পিছনে মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান রাজেন পাণ্ডের যোগাযোগেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
ষড়যন্ত্রের আঁচ পেলেও তিনি কি তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন? প্রদীপবাবুর জবাব, ‘‘জানিয়েই বা কী লাভ হত! ’’
মুখ্যমন্ত্রীকেও তো জানাতে পারতেন? এ বার ক্ষোভ উগরে দেন প্রদীপবাবু, ‘‘আগে অনেক বিষয়েই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে আর কী জানাব! ওঁর নির্দেশেই তো আমাকে সরানো হয়েছে। আমার কারণে যাঁদের স্বার্থে ঘা লাগছিল, তাঁদের জন্যই আমাকে সরতে হল।’’ তাঁর দাবি— ওঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে ভুল বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। এর মধ্যে স্বাস্থ্য ভবনের কয়েক জনও রয়েছেন।
সোমবারের মতো বুধবারও স্বাস্থ্য ভবনে গিয়েছিলেন প্রদীপ মিত্র। কিন্তু এ দিন ভেতরে ঢোকেননি তিনি। একতলায় চিঠিপত্র বিভাগে গিয়ে নিজের স্বেচ্ছাবসরের আবেদনপত্রটি জমা দিয়ে এসেছেন। তবে তাঁর স্বেচ্ছাবসরের আবেদন যে মানা হবে না, তা এ দিন জানিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য ভবন। তারা জানিয়েছে, স্বেচ্ছাবসরের আবেদন মানার প্রশ্নই নেই। কারণ এখন স্বাস্থ্য দফতরে স্বেচ্ছাবসর প্রকল্প পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
তা হলে এখন কী করবেন প্রদীপবাবু? তাঁর মন্তব্য, ‘‘আবেদন মানা না-হলে আদালতে যাব। আগে তো অবসরের বয়স ছিল ৫৮ বছর। সেটা বাড়তে বাড়তে ৬৫ হয়েছে। যাঁরা অবসরের বয়স বাড়ানোর বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আমিও ছিলাম। জোর করে কাউকে তো আটকে রাখা যায় না!’’
কিন্তু রাজ্য সরকার যদি নির্দেশ প্রত্যাহার করে তাঁকে পুরনো পদ ফিরিয়ে দেয়?
তাঁর জবাব, ‘‘তা হলে আমি কাজে যোগ দেব। আমি মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না। অযথা গোঁ ধরে বসে থাকতেও চাই না।’’
কুকুর-কাণ্ড নিয়ে তাঁকে একা কাঠগড়ায় তোলাটা যে অন্যায় করা হয়েছে, তা নিয়ে এ দিন সরব হয়েছেন প্রদীপবাবুও। তিনি বলেন, ‘‘যিনি প্রধান দোষী, নেফ্রোলজির প্রধান সেই রাজেন পাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হল না। অথচ তিনিই নিজের বিভাগে কুকুরের ডায়ালিসিসের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি স্বাস্থ্যসচিবকে সব জানিয়েছিলাম। উনিও রাজেন পাণ্ডের ব্যাপারে নীরব থেকেছেন।’’
এ দিন স্বাস্থ্যসচিব মলয় দের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। বার বার ফোন বেজে গেলেও তিনি ফোন ধরেননি। রাজেন পাণ্ডে বলেন, ‘‘আমি ওই সময় ছিলাম না। এমন কোনও নির্দেশও দিইনি। উনি কীসের ভিত্তিতে বলছেন তা উনিই জানেন।’’ একই কথা নির্মল মাজিরও। তিনি বলেন, ‘‘সরানো হয়েছে বলে নানা রকম মনগড়া কথা বলছেন উনি।’’ যদিও এসএসকেএমের নেফ্রোলজি বিভাগের ডাক্তাররা জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে যে নোট চালাচালি হয়েছে, তা দেখলেই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। স্বাস্থ্য দফতর তদন্ত করলেই সব ধরা পড়ত।
স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, যে ভাবে প্রদীপবাবু সরকারি পদে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ এনেছেন, তাতে এসএসকেএমে তাঁর পুনর্বহালের পথ বন্ধ হয়ে গেল। উল্টে প্রকাশ্যে সরকার-বিরোধী মন্তব্য করার জন্য প্রদীপবাবুর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে এখনই কোনও মন্তব্য করব না।
উনি ওঁর কাজ করছেন। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলাটা তো সঠিক কাজ নয়।’’
গোটা বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাও যে যথেষ্ট বিব্রত, তা এ দিন দুপুরে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের একটি অনুষ্ঠানে পরিষ্কার হয়েছে। এক কর্মীর অবসর গ্রহণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন প্রদীপবাবু এবং সুশান্তবাবু। কিন্তু প্রদীপবাবু আসার আধ ঘণ্টা আগে মিনিট পাঁচেকের জন্য ঘুরে যান সুশান্তবাবু। প্রদীপবাবু এসে প্রায় ঘণ্টাখানেক ছিলেন। ঠাট্টার ছলে তিনি বলেন, ‘‘সাংবাদিকদের ভয়েই স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তাকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে হল। উনি থাকলে এক সঙ্গে দুপুরের খাওয়াটা সারতাম!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy