চিকিৎসাধীন চন্দ্রশেখর (বাঁ দিকে) ও গোবিন্দ।—নিজস্ব চিত্র।
অর্থলগ্নি সংস্থায় রাখা টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে এজেন্টের সঙ্গে ধারাল অস্ত্র নিয়ে মারপিটে জড়িয়ে পড়লেন এক আমানতকারী। বুধবার সন্ধ্যায় উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগরের সাতবেড়িয়ার এই ঘটনায় জখম দু’জনকেই ভর্তি করা হয়েছে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে।
গোবিন্দ হালদার নামে র্যামেল ইন্ডাসট্রিজ লিমিটেডের ওই এজেন্টের বাড়িতে আসেন স্থানীয় বাসিন্দা চন্দ্রশেখর দাস। সংস্থায় টাকা রেখেছিলেন পেশায় বাসচালক চন্দ্রশেখর ও তাঁর ছেলে পরিমল। কিন্তু টাকা ফেরত পাননি। সংস্থাটির বনগাঁর কার্যালয় ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
গোবিন্দর কাছে টাকা ফেরত চাইলে চন্দ্রশেখরের সঙ্গে তাঁর বচসা বাধে। দু’জনেই দা-কাটারি নিয়ে একে অন্যের উপরে চড়াও হন। চন্দ্রশেখরবাবুর মাথায় ১৪টি সেলাই পড়েছে। গোবিন্দবাবুর শরীরেও আঘাত লেগেছে। বাঁ হাতের অনামিকা বাদ গিয়েছে তাঁর।
চন্দ্রশেখরবাবুর দাবি, বছর খানেক আগে তিনি ও তাঁর ছেলে পরিমল মাসে মাসে টাকা জমাতে শুরু করেছিলেন ওই সংস্থায়। প্রায় ৪০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন তাঁরা। তিন মাস হল ছেলের লগ্নির মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু চড়া সুদ তো দূরের কথা, আসল টাকাও ফেরত পাননি তাঁরা। পরিমল অটো চালান। সেটি ক’দিন আগে খারাপ হয়। আজ না হয় কাল টাকা ফেরত দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন গোবিন্দ। অটো সারানোর জন্য টাকাটা খুবই দরকার হয়ে পড়ে পরিমলের। জামাইষষ্ঠীর আগে টাকা ফেরত চান তাঁরা। কিন্তু কোনও সদুত্তর মেলেনি।
চন্দ্রশেখরবাবু জানান, বুধবার বিকেলে টাকা চাইতে গেলে বচসা বাধে গোবিন্দর সঙ্গে। ওই যুবক তাঁকে দা দিয়ে মাথায় কোপ মারে। পাল্টা মারের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। চন্দ্রশশেখরবাবু জানান, স্ত্রী ঝুনু আশেপাশের লোকজন ডেকে তাঁকে উদ্ধার করেন।
গোবিন্দর আবার পাল্টা দাবি, সংস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে কোনও টাকাই পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি জানান, একটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে সোনা-রুপোর কারবার করেন। নিজের আয়ের টাকা থেকে সামান্য কিছু টাকা ধীরে ধীরে সকলকে শোধ দিচ্ছিলেন। তাঁর সমস্যার কথা বিবেচনা না করেই জামাইষষ্ঠীর আগে পুরো টাকাটা এক সঙ্গে ফেরত চেয়ে বসেন চন্দ্রশেখরবাবু। কিস্তিতে টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাসেও কাজ হয়নি। গোবিন্দববাবুর অভিযোগ, চন্দ্রশেখরই দা নিয়ে চড়াও হন। তিনি শুধু আত্মরক্ষা করেছেন।
সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তভার নেওয়ায় এবং ইডির কর্মকাণ্ডের জেরে সম্প্রতি অন্য লগ্নি সংস্থার আমানতকারীদের মধ্যে টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে নতুন করে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। কিন্তু লগ্নি সংস্থাগুলির বেশির ভাগই ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এজেন্টদের উপরে হামলার ঘটনা ঘটছে নতুন করে। এজেন্টের পাল্টা মারে আবার বেড়াচাঁপায় সম্প্রতি আমানতকারী এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগও উঠেছে। প্রতিবাদে ওই এজেন্টের বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে, ধানের গোলায় আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
এ দিনের ঘটনায় র্যামেলের অন্য এজেন্টদের মধ্যে আতঙ্ক আরও ঘণীভূত হয়েছে। এ দিন বেশ কিছু এজেন্ট আসেন বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে। তাঁদেরই এক জন সাতবেড়িয়া এলাকার বাসিন্দা পেশায় গৃহশিক্ষক পরিতোষ ঘোষ। জানালেন, প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা আমানতকারীদের থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। বেশির ভাগ টাকাই ফেরত দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। এ দিকে, লগ্নি সংস্থাটি বন্ধ। পাওনাদাররা বাড়িতে নিয়মিত চাপ দিচ্ছেন। নিজের রোজগার থেকে সামান্য টাকা ধীরে ধীরে তিনি ফেরত দিচ্ছেন বলেও জানালেন। একই অবস্থা গৌতম মণ্ডলের। বই-খাতার দোকান আছে তাঁর। ব্যক্তিগত ভাবে তিনিও পাওনাদারদের টাকা অল্প অল্প করে ফেরত দিচ্ছেন বলে জানান। এই সব এজেন্টদের বক্তব্য, “প্রতিনিয়ত চাপ আসছে। এ ভাবে এক সময় এলাকায় থাকাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।” এজেন্টদের দাবি, চাপ সহ্য করতে না পেরে গোপালনগরের ব্যারাকপুরের এক এজেন্ট ইতিমধ্যে আত্মহত্যাও করেছেন। অন্য এক জন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রের খবর, এক বছরের বেশি সময় ধরে র্যামেলের বনগাঁ শাখার অফিস বন্ধ। বনগাঁর বিস্তীর্ণ এলাকায় র্যামেলের এক সময় রমরমা ছিল। বহু মানুষ টাকা রেখেছিলেন এই সংস্থায়। প্রথম দিকে কিছু কিছু টাকা ফেরত পাওয়া গেলেও ঝাঁপ বন্ধের পরে কিছুই মিলছে না। বনগাঁর শক্তিগড়ের বাসিন্দা কার্তিক সাহার কথাই ধরা যাক। নিজে টাকা তো রেখেইছিলেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজনকেও বুঝিয়ে বেশ কিছু টাকা রাখার ব্যবস্থা করেন র্যামেলে। ইদানীং শ্বশুরবাড়িতে যেতেও অস্বস্তি বোধ করেন বলে জানালেন।
সংস্থার কর্ণধার রামেশ্বর পোদ্দার এখন জেলহাজতে রয়েছেন। সিবিআই যে ৪৪টি সংস্থাকে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে, তার মধ্যে র্যামেলও একটি। শ্যামল সেন কমিশন এবং সিবিআইয়ের কাছে সংস্থার নথিপত্র জমা আছে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এজেন্টের দাবি, এই সংস্থার বিভিন্ন সম্পত্তি ক্রোক করে বিক্রির ব্যবস্থা করা হোক। তা থেকে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া যাবে। নিজেদের সুরক্ষার জন্যও সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy