Advertisement
০২ জুন ২০২৪

ঘরের বুথেই ভোট দিল জিলিং সেরেং

সাঁওতালি ভাষায় ‘জিলিং’ মানে লম্বা। ‘সেরেং’ হল গান। অযোধ্যার পাহাড়চুড়োয় জিলিং সেরেং গ্রামে প্রথম বার ভোটের সুর শুনতে সত্যিই লম্বা সময় লেগে গেল।

দোরগোড়ায় বুথ! এই প্রথম। সাত কিলোমিটার উজিয়ে নয়, এ বার নিজের গ্রামেই ভোট দিলেন প্রতিবন্ধী গুরুদাস মুর্মু। —নিজস্ব চিত্র

দোরগোড়ায় বুথ! এই প্রথম। সাত কিলোমিটার উজিয়ে নয়, এ বার নিজের গ্রামেই ভোট দিলেন প্রতিবন্ধী গুরুদাস মুর্মু। —নিজস্ব চিত্র

ঋজু বসু
অযোধ্যা পাহাড় শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪৯
Share: Save:

সাঁওতালি ভাষায় ‘জিলিং’ মানে লম্বা। ‘সেরেং’ হল গান। অযোধ্যার পাহাড়চুড়োয় জিলিং সেরেং গ্রামে প্রথম বার ভোটের সুর শুনতে সত্যিই লম্বা সময় লেগে গেল।

অযোধ্যা পাহাড়ে কম্প্রিহেনসিভ এরিয়া ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের (সিএডিসি) অতিথিশালা নীহারিকা ও মালবিকা পার হয়ে ২৪ কিলোমিটার উজিয়ে জিলিং সেরেং। নামমাত্র পিচের আধভাঙা রাস্তায় ঠোক্কর খেতে খেতে সোমবার সাত-সকালে ন্যাড়া রুখাসুখা গ্রামে পৌঁছে দেখা গেল, বেশ একটা খুশির হাওয়া। বৃদ্ধ মাতাল পাহাড়িয়া নতুন ধুতিতে সেজেছেন। হেঁটো ধুতির নীচে লিকপিকে ঠ্যাংগুলোয় কিন্তু আজ অফুরান ‘এনার্জি’। স্ত্রী বিজলাকে সঙ্গে নিয়ে বুথে যাচ্ছেন মাতাল। ঘামতে ঘামতে হাতের উপরে ভর দিয়েই ঘষটে ভোট দিতে চলেছেন জন্ম প্রতিবন্ধী যুবক গুরুদাস মুর্মুও। দু’জনেরই জন্মের পরে এই প্রথম নিজের গ্রামে ভোট দিতে যাওয়া।

এত দিন কোথায় ভোট দিতেন?

জিলিং সেরেং প্রাইমারি স্কুলের বুথে ঢোকার আগে উল্টো দিকের জঙ্গলে আঙুল দেখিয়ে সত্তরোর্ধ্ব মাতাল বললেন, ‘‘ওই হোথায় বুকাডিতে। গোটা দিনটাই লেগে যেত বটে।’’ জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের ফাঁকে ঢাল বেয়ে ওই রাস্তা ঠাহর করাই দায়। সাত দশকের স্বাধীন রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু প্রতিষ্ঠা করতে এত দিন সেই পথে সাত কিলোমিটার নেমে যেত প্রান্তিক সাঁওতাল গ্রাম। এখনও নামে নিত্য দিন। বুকাডি ছাড়িয়ে বুড়দা গ্রাম। জঙ্গলের কাঠ বেচে কোনওমতে জীবন নির্বাহে হপ্তায় দু’দিন বুড়দার হাটই ভরসা। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র কেড়েঞার মোড়ে, নামতে হয় আরও কিলোমিটার তিনেক। আর দু’ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে আড়শায় হাইস্কুলে যায় গ্রামের দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া সর্বেশ্বর মুর্মু।

এ যাত্রা রাজ্যে বিধানসভা ভোটের প্রথম দিনেই প্রথমবার পাহাড়চুড়োর এই অনেক কিছু ‘না-পাওয়ার’ গ্রামে ভোটের বুথ বসল। পুরুলিয়া টাউনের কাছে বোঙ্গাবাড়ি জুনিয়র স্কুলের ইংরেজির মাস্টারমশাই তথা প্রিসাইডিং অফিসার সন্দীপ পাত্র জানালেন, ভোটার সাকুল্যে ১৮৫ জন। তবু এঁদের জীবনে সামান্য স্বাচ্ছন্দ্য দিতেই প্রথম ভোটের আসর। আর তার সৌজন্যেই গাঁয়ের লোক দেখল, কয়েক ঘণ্টাতেই স্কুল-বাড়িটার সামনে বসেছে দু’-দু’টো টিউবওয়েল। জল অবশ্য নামমাত্র ওঠে। তবু রবীন্দ্রনাথ কিস্কু, কলেবর পাহাড়িয়াদের আশা, ভোট শেষে দু’টি নলকুপ স্কুলের পড়ুয়াদের অন্তত কাজে আসবে।

প্রথমবার ভোটযন্ত্রের শব্দ শুনল অযোধ্যা পাহাড়চুড়োর আর এক গ্রাম বাঁধঘুটু। বুথ হয়েছে মারাংবুরু আদিবাসী বিদ্যালয়ে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত ২০ জন পড়ুয়ার স্কুলের দিদিমণি সুনীতা মারডি বলছিলেন, এত দিন জঙ্গলের ঢাল বেয়ে ১৩ কিলোমিটার নেমে ভোট দিতে বাড়েরিয়ায় যেতে হতো। এই গ্রামের ছবিও জিলিং সেরেং-এর মতো। সব থেকে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্র পাহাড়ি গ্রাম অযোধ্যায়, পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সাহেবডিহি, বাঁধঘুটু, বড়ুয়াজায়া, দুলগুবেড়া, টাঁড়পানিয়া গ্রামের ৩৯১ জন ভোটার এ বারই প্রথম ঘরের কাছে বাঁধঘুটুর বুথে এসে ভোট দিলেন।

জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা জোট প্রার্থী নেপাল মাহাতোর শক্ত ঘাঁটি বাঘমুন্ডির এই প্রান্তিক বুথ দু’টি তাই যেন খানিক দলছুট। প্রথমবার গ্রামে ভোট হওয়ার আনন্দে রাজনীতির রেষারেষিও ফিকে। কংগ্রেসের পোলিং এজেন্ট পুলেন বেসরা মস্করায় মাতলেন তৃণমূলের এজেন্ট সুধীর বেসরার সঙ্গে। দুপুরে বাঁধঘুটুর বুথে প্রিসাইডিং অফিসার, রসায়নের শিক্ষক বিভাস মাহাতো বলছিলেন, ‘‘সকাল থেকেই ভোট পড়েছে একেবারে টি-২০ ধাঁচে!’’

তবে শুধু গ্রামে বুথ বসাই নয়, জিলিং সেরেং বা বাঁধঘুটুর জীবনও সহজ হয়েছে— জানালেন পুরুলিয়ার জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী। পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব ছাপিয়ে অবশ্য প্রথম বার ভোটের উত্তেজনাতেই মশগুল জিলিং সেরেং ও বাঁধঘুটু। দিনের শেষে দুই গ্রামের বুথে ভোট পড়েছে যথাক্রমে ৮৮ ও ৯১ শতাংশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE