নিজের বাগানে দীপালিদেবী। —নিজস্ব চিত্র।
গাছ ভর্তি লঙ্কা। উড়ে আসে টিয়ার ঝাঁক।
দারচিনির পাতা ছেঁড়ে বুলবুলি।
সাতসকালে ছাতারের দল লবঙ্গ গাছের ডালে দোল খায়।
প্রতিদিন এ ভাবেই ‘রাঁধুনি’-তে এসে বসে পাখির দল। ওড়ান না রাঁধুনি-মালকিন দীপালি অধিকারী। ভালই লাগে তাঁর। ‘পাখি সব, করে রব’।
শ্যামনগরে চৌরঙ্গি কালীবাড়ির কাছে গঙ্গার ধারে দীপালিদেবীদের দোতলা বাড়ির ছাদটাই ‘রাঁধুনি’। আসলে মশলার বাগান। সঙ্গের চিলেকোঠার সিঁড়ি থেকে ছাদ পর্যন্ত গাছ আর গাছ। টবে জিরে, ধনে, হলুদ, গোলমরিচ— কিছুই বাদ নেই। টবে অ্যালোভেরাও চাষ করেছেন দীপালিদেবী। আর তাঁর এই মশলার বাগান দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন পাড়ার অন্য গৃহিনীরাও। বাড়ির ছাদে মশলা চাষ এখন তাঁদেরও নেশার মতো।
ছেলেবেলা থেকেই টবে ফুলগাছ লাগানো ছিল দীপালিদেবীর শখ। বছর পাঁচেক আগে মশলা-চাষের ভাবনাটা তাঁর মাথায় আসে। কত লোক তো সমাজের জন্য কত কিছু করে! না হয় জায়গা নেই, টবের এক ছটাক মাটিই হোক। যত্ন করলে কি আর ফল দেবে না? টবের মধ্যে পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, বট, নিম তো আছেই। এ বার ভেষজ চাষও শুরু করা যাক।
দেখতে দেখতে এই পাঁচ বছরে দীপালিদেবী প্রায় ৬০ রকম মশলার গাছ চাষ করে ফেলেছেন। জায়ফল, জয়িত্রীর মতো দামি চারাও রয়েছে তাঁর টবে। তাঁর কথায়, ‘‘বাঙালি, কন্টিনেন্টাল, থাই, চাইনিজ— কত রকম রান্নার পদ আছে! সব রান্নার মশলার জোগান আছে আমার বাগানে। যে কোনও রান্না বলুন, মশলা রয়েছে আমার রাঁধুনিতে।’’
আশপাশের বাড়ির রান্নাঘরেও দীপালিদেবীর রান্নার মশলা যায়। তাঁর শখে সামিল হয়েছেন স্বামী, সেনাবাহিনীর কর্মী দেবেন্দ্রনাথবাবুও। একজন গাছ লাগান, তো অন্য জন বালতিতে জল এনে দেন। সুযোগ পেলে দু’জনেই মশলার চারা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। চেনা-পরিচিত যাঁরা গাছ লাগাতে ভালবাসেন, তাঁদের বিলোতে যান। কখনও আবার অপরিচিত মানুষের বাড়িতেও গাছপালা আছে দেখলে ঢুকে পড়ে অনুরোধ করেন, নিজেদের তৈরি করা চারা লাগানোর জন্য।
এই শখেই আজীবন ডুবে থাকতে চান দীপালিদেবী। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের একমাত্র মেয়ে এখন কলেজে পড়ছে। ওর বিয়ে হয়ে গেলে এই সব গাছ আর পাখিরাই তো থাকবে। একটা ডাল থেকে যে দিন আস্ত গাছ তৈরি হল, সে দিন মনে হল একটি প্রাণের জন্ম দিলাম। সেই থেকেই নেশাটা ধরল। থেকেও যাবে সারা জীবন।’’
দীপালিদেবীর নেশার শরিক এখন প্রতিবেশীরাও। তাঁরাও দীপালিদেবীর কাছ থেকে মশলার গাছের চারা নিয়ে গিয়ে লাগাতে শুরু করেছেন। আশপাশের বাড়ির ছাদেও এখন দু’দশটা টবে দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গের গাছ উঁকি দিচ্ছে।
ওই পাড়ার বাসিন্দা অমর ধরের কথায়, ‘‘কখনও ভাবিনি ছাদে মশলা ফলাতে পারব। দীপালিদির জন্যই সম্ভব হল। উনিই গাছ লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। আমাদেরও খুব নেশা হয়ে গিয়েছে।’’
দীপালিদেবীর পড়শি অনিমা ঘোষ এ বারই ছাদে তেজপাতা, হলুদ, ধনে ও ক্যাপসিকাম গাছ লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘বাড়িতে গাছ লাগানোর জায়গা নেই। ছাদে টবে যে ও সব লাগানো যায়, তা দিদিই শেখালেন।’’
মশলার নেশা ছড়াচ্ছে গঙ্গাপারের ছোট্ট পাড়ায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy