Advertisement
১৮ মে ২০২৪

মিলিত জেদের পুরস্কার, মৃত্যু জয় করে আনন্দ

জন্মের দু’এক দিনের মধ্যেই হাওড়া স্টেশনের কাছে রেললাইনের ধারে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। তাকে তুলে এনে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দেন এক পথচারী।

এনআরএসের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগে আনন্দ। —নিজস্ব চিত্র।

এনআরএসের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগে আনন্দ। —নিজস্ব চিত্র।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:৫৭
Share: Save:

অনাত্মীয় কিছু মানুষ স্বার্থের তোয়াক্কা না-করে একটা জেদ নিয়ে একরত্তি এক শিশুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।

তাঁদের জেদ, কিছু লোককে ভুল প্রমাণিত করা, যাঁরা ভেবেছিলেন জন্মগত প্রতিবন্ধকতার জন্য ভবিষ্যতে শুধুই অন্ধকার অপেক্ষা করছে সেই শিশুর জীবনে। পাছে সেই প্রতিবন্ধী শিশুর দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়ে, তাই একরত্তি অসহায় শিশুটিকে ব্রাত্য করতেও দ্বিধা করেননি ‘আত্মীয়’রা। জন্মের দু’এক দিনের মধ্যেই হাওড়া স্টেশনের কাছে রেললাইনের ধারে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। তাকে তুলে এনে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দেন এক পথচারী। তারিখটা ছিল ২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। নামগোত্রহীন সদ্যোজাত তখন মৃতপ্রায়। জন্ম থেকেই তার সুষুন্মাকাণ্ডের স্নায়ুগুলো বিপজ্জনক ভাবে বাইরে বেরিয়ে ছিল। রেললাইনের ধারে ময়লায় পড়ে থেকে সংক্রমণও শুরু হয়ে গিয়েছিল তাতে। ছোটবড় দু’পায়ের পাতা আবার দু’দিকে বাঁকানো। মলনালী ও মলদ্বার তৈরিই হয়নি শরীরে। কোমরের নীচ থেকে বাকি অংশও অসাড়।

এমন একটা শিশুকে সুস্থ করে বড় করার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, অচিকিৎসক কর্মীরা। নতুন নাম দেন, ‘আনন্দ।’ অস্ত্রোপচার করে তার শরীরে মলত্যাগের জায়গা তৈরি করা হয়। সাত মাসে পা দেওয়ার পর হাসপাতালেরই পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগে আনন্দের মুখেভাত হয়। তখনই একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সকলে। পরিবার-পরিজনহীন আনন্দ যাতে তার সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

আরও পড়ুন: ছেলের পড়ার ‘ঘরে’ ইচ্ছাপূরণ মায়ের

সাড়ে তিন বছর কাটতে চলেছে। আনন্দ নীলরতনেই আছে। সেখানকার চিকিৎসক-অশিক্ষক কর্মীদের কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। চাইলেই আনন্দকে ‘ঝামেলা’ বলে মনে করে কোনও হোমে চালান করে দিতে পারতেন। কোথাকার কোন ফেলে যাওয়া বাচ্চা, নিজেদের দিনগত নানা সমস্যার মধ্যে আবার নতুন করে এই দায়িত্ব কে নিতে চায়? কিন্তু এ ক্ষেত্রে হল অন্য রকম। এখানে জিতে গেল মানবিকতা। নীলরতন হাসপাতালের সকলের চেষ্টায় প্রতিবন্ধকতা জয় করে এখন ছোট্ট-ছোট্ট পা ফেলে গোটা ওয়ার্ড তরতরিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে আনন্দ। বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ। হাসিখুশি। ওয়ার্ডের অন্য শিশুরোগীদের সঙ্গে দিব্যি বকবক করছে, খেলছেও। আবার প্রতিদিন হাসপাতালেই তাকে পড়াতে আসছেন দিদিমণি! তার শারীরিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়ার জন্যই তাকে ডিসচার্জ দেওয়া হয়নি। কারণ, হাসপাতালের সকলে জানেন, ডিসচার্জ করলেই আনন্দকে হোমে পাঠাতে হবে। আর সেখানে রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসনের কাজ ঠিক মতো হবে না।

নীলরতনেই রয়েছে রাজ্য সরকারের একমাত্র ‘রিজিওন্যাল আর্টিফিশিয়াল লিম্ব ফিটিং সেন্টার।’ হাসপাতালের ডেপুটি সুপার দ্বৈপায়ন বিশ্বাসের কথায়, ‘‘ও দাঁড়ানোর চেষ্টা করতো, পারতো না। ওর পায়ের হাড়ের সংযোগস্থলে কোনও জোর ছিল না। তা ছাড়া একটা পা অন্য পায়ের থেকে অনেকটা ছোট। মাটিতে বসে ঘসে ঘসে চলতে গিয়ে পায়ে ফোস্কা আর কড়া পড়ছিল। তখন আমাদের লিম্ব সেন্টারে ওর জন্য বিশেষ ভাবে অ্যাঙ্কেল, নি অ্যান্ড হিপ জয়েন্ট অর্থোসিস তৈরি করা হয়। যে পা-টা ছোট, সেখানে একটা বিশেষ জুতো পরানো হয়।’’ লিম্ব সেন্টারের অর্থোটিক বিভাগের প্রধান আবীর মিত্র বলেন, ‘‘এটা দেওয়ার পর ও দাঁড়াতে পারলো। কিন্তু হাঁটতে গেলেই ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেত। তখন ওকে দেওয়া হল বিশেষ রিভার্স ওয়াকার। তাতেই আনন্দ সোজা হয়ে হাঁটতে শুরু করলো। একটু বড় হলে ওর আর ওয়াকার দরকার হবে না।’’

নীলরতনে আনন্দের পরিবার হয়ে যাওয়া সকলে এখন সারা দুনিয়াকে দেখাতে চান, আনন্দ জীবন যুদ্ধে জয়ের পথে পা ফেলতে পেরেছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE